শেষ আপডেট: 7th March 2023 13:41
ইউক্রেন যুদ্ধ (Russia Ukraine War) এক বছরে পড়ল। এখনও থামার লক্ষণ নেই। এখনকার দিনে যে কোনও যুদ্ধের প্রভাব পড়ে বিশ্ব জুড়ে। যুদ্ধ হয় দু'টি দেশের মধ্যে। কিন্তু তার জন্য সারা বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমত যুদ্ধের জন্য উৎপাদন মার খায়। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের ওপর দিয়ে পণ্য চলাচল ব্যাহত হয়। এর অবশ্যম্ভাবী ফল, মূলবৃদ্ধি। ইতিপূর্বে উপসাগরীয় যুদ্ধ ও আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণের সময় বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধের আঁচ টের পাওয়া গিয়েছিল।
কোভিড অতিমহামারীর জন্য বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র ও অনাহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ওপরে যদি নতুন করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, তাহলে বহু দেশে বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপুঞ্জে বলেছেন, শীঘ্র যুদ্ধ না থামলে বিশ্ব জুড়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা সংকটে পড়বে।
গতবছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হানা দেয়। একইসঙ্গে ইউক্রেনের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে রুশ ফৌজ আক্রমণ করে। কয়েকদিনের মধ্যেই তারা ইউক্রেনের দুই বৃহত্তম শহর কিভ ও খারকিভে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সেই সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়া হয়।মার্চে রাশিয়া খারসন অঞ্চল দখল করে। ওই সময় সর্বাধিক সংখ্যক নিরীহ মানুষ নিহত হন। এপ্রিলে রাশিয়া কিছুদূর পিছু হটতে বাধ্য হয়। এপ্রিলে ইউক্রেনীয় ফৌজ দেশের উত্তরের কিছু এলাকা পুনর্দখল করে। কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা ডুবিয়ে দেয় তারা।
মে মাসে ফের বদলে যায় যুদ্ধপরিস্থিতি। রুশ ফৌজ মিরিউপোল দখল করে। ওডেসা বাদে কৃষ্ণসাগরের উপকূল অঞ্চলও দখল করে নেয় তারা। জুন মাসে ইউক্রেনের বাহিনী রাশিয়ার থেকে কেড়ে নেয় স্নেক আইনল্যান্ড। জুলাই মাস থেকে আমেরিকা খোলাখুলি ইউক্রেনকে সাহায্য করতে থাকে। এই সময় রাশিয়া লুহানস্ক দখল করে। দোনবাস অঞ্চলে রক্তাক্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। জাপোরোজিয়ে পরমাণু কেন্দ্র নিয়ে আশঙ্কা দেখা দেয়।
অগাস্টে খারসন অঞ্চল থেকে পালটা আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেন। এক্ষেত্রে তারা মূলত আমেরিকার দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছিল। সেপ্টেম্বরেও পুরো দমে চলতে থাকে পালটা আক্রমণ। ইউক্রেন রুশ ফৌজের হাত থেকে খারকিভের অধিকাংশ এলাকা উদ্ধার করে। কয়েকটি রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়।
অক্টোবরে রাশিয়া ইউক্রেনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি লক্ষ্য করে আঘাত হানে। ইউক্রেনের পূর্বদিকে নিপ্রো অঞ্চলে জোর লড়াই শুরু হয়। নভেম্বরে ইউক্রেনের ড্রোন বিমানগুলি রাশিয়ার সেনা ঘাঁটিতে বোমা ফেলে। ২০২২ সালের শেষদিক থেকে যুদ্ধে একপ্রকার অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
২০২৩ সালের শুরুতে আমেরিকা, ব্রিটেন ও জার্মানি ঘোষণা করে, তারা ইউক্রেনে ট্যাঙ্ক পাঠাবে। ফেব্রুয়ারিতে আচমকাই কিয়েভে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি ইউকেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলিনস্কির সঙ্গে দেখা করেন।
আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের সাহায্যেই এতদিন ধরে রাশিয়াকে ঠেকাতে পেরেছে ইউক্রেন। নইলে অনেকদিন আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যেত। আগামী দিনে পশ্চিমী দেশগুলি ইউক্রেনকে আরও বেশি অস্ত্রশস্ত্র দেবে বলেছে। সেক্ষেত্রে ইউক্রেনের প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হবে। বাড়বে যুদ্ধের তীব্রতা।
এই যুদ্ধে কার্যত রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে চিন। বেজিং একবারও বলেনি, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ করা উচিত কাজ হয়েছে। কিন্তু এই হানাদারীর নিন্দাও করেনি। উপরন্তু যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার অপপ্রচারকে সমর্থন করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে ইউক্রেন নিয়ে ভোটাভুটির সময় রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে।
যুদ্ধ যদি আরও বেশিদিন গড়ায় তাহলে সারা বিশ্ব দু'টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাবে। একদিকে থাকবে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলি। অন্যদিকে থাকবে রাশিয়া ও চিন। ভারতের মতো যে দেশগুলি এখনও পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে, তাদের ওপরেও কোনও শিবিরে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে আর একটা বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যুদ্ধের পাশাপাশি চলছে শান্তিপ্রক্রিয়া। ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর চারদিন বাদে বেলারুশে প্রথম শান্তিবৈঠক বসে। এরপরে কয়েক দফা শান্তি আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সফল হয়নি।ভারত একাধিকবার যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চিন থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জে শান্তিপ্রক্রিয়া চালানোর জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে নানা দেশের বহু জোট, মঞ্চ ইত্যাদি রয়েছে। দিল্লিতেই কিছুদিন আগে কোয়াড গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন। কয়েকমাস পরেই দিল্লিতে জি-২০ গোষ্ঠীর শীর্ষ সম্মেলন হবে। এখনও পর্যন্ত কোনও জোটই যুদ্ধ থামাতে পারেনি। আমেরিকার মতো দেশগুলি আদৌ যুদ্ধ থামাতে চায় কিনা, তাও পরিষ্কার নয়।
এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ থামানোর জন্য ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিকেই বড় ভূমিকা নিতে হবে। কারণ যুদ্ধ আরও কিছুদিন চললে যে অর্থনৈতিক ধাক্কা আসবে, তা সামলানোর মতো ক্ষমতা তাদের নেই।