ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতেই এখন অতলান্তিকের দুই পারের ভূরাজনৈতিক অঙ্কের উত্তর লুকিয়ে।
শেষ আপডেট: 20th July 2024 17:58
একটা ফোন। তাতেই রাতারাতি বদলে গেল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির গলার সুর!
সৌজন্যে, সেই তিনি। এক ও অদ্বিতীয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বন্দুকবাজের হামলা কাটিয়ে ক্রমশই স্বাভাবিক হচ্ছেন ট্রাম্প। এখনও কানে ব্যান্ডেজ। তার মাঝেই শুক্রবার রাতে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে জেলেনস্কির ফোনে 'খুব ভাল কথা হয়েছে'। সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টে লিখেছেন, 'আজ একটু আগেই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে খুব ভাল কথা হল। উনি আমাকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমার ওপর হওয়া খুনের চেষ্টার বিরুদ্ধেও নিন্দে করেছেন। বলেছেন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমেরিকানদের এগিয়ে আসাকে তিনি সাধুবাদ জানাচ্ছেন।' সঙ্গে যোগ করেন, 'প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির এইভাবে কথা বলাকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কারণ আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমিই পারব পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে।'
জেলেনস্কিও পরে এক্স হ্যান্ডলে এই ফোনের কথা জানিয়ে লিখেছেন, তিনি ট্রাম্পের সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন। 'আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে বাঁচাতে আমেরিকার দুই দলের সমর্থনই আমাদের দরকার', বলেছেন জেলেনস্কি।
কিন্তু এই ফোনের পরেই ক্রমশ অতলান্তিকের দুই পারের ভূরাজনীতি টাল খেতে শুরু করেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক নিয়ে বহু চর্চা হয়েছে। হোয়াইট হাউসের অন্দরের খবর, পুতিনকে অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখেন ট্রাম্প। পুতিনের খামখেয়ালি মেজাজ, লৌহসম কাঠিন্য, বজ্রমুষ্টিতে একনায়কতান্ত্রিকভাবে দেশ চালানো... এসবই বেজায় পছন্দ করেন ট্রাম্প। শোনা গিয়েছিল, ২০১৬ সালে তাঁর নির্বাচনের সময়েও রুশ গোয়েন্দারা কলকাঠি নেড়েছিলেন। তা নিয়ে তদন্ত চলছে। ট্রাম্প যদিও বলেছেন, ওসব ভুয়ো অভিযোগ! কিন্তু তদন্তকারী আধিকারিক রবার্ট মুলার দেখিয়েছেন, ট্রাম্পের প্রচারদলের সঙ্গে রুশ সরকারের অন্দরের লোকজনের যোগাযোগ ছিল।
ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করার পরেও অবশ্য পুতিনের প্রতি ভালবাসায় একটুও ছেদ পড়েনি ট্রাম্পের। একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পুতিনের এই পদক্ষেপ বেশ ধুরন্ধর কাজ। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'দিস ইজ জিনিয়াস! আপনাকে মানতেই হবে, দ্যাটস প্রিটি স্যাভি!' পরে নিজেই বলেছিলেন, 'আমি পুতিনকে খুব ভাল চিনি। আমাদের ভালই সখ্য। উনি আমাকে পছন্দ করেন। আমিও ওঁকে পছন্দ করি।'
এদিকে যুদ্ধ থামেনি। বেড়ে চলেছে এবং ক্রমশ ইউক্রেনের এক বিরাট অংশ রাশিয়ার গোলাবর্ষণে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনি চাইলে মাত্র একদিনেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারেন। কোন পথে থামাবেন, যথারীতি এসব তুচ্ছ প্রশ্নে কান দেননি। এদিকে বিস্তর সমালোচনা হয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া অবধি বলেছেন, 'আমার মনে হয় না এটা একদিনে থামানোর মত বিষয়!'
কিন্তু এইবার আমেরিকার রাজনীতির হালচাল দেখে সমস্ত হিসেব নতুন করে কষছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তারই প্রথম ধাপ হতে পারে এই ফোন করা!
এই মুহূর্তে মার্কিন রাজনীতির যা অবস্থা, তাতে খুব এদিক-সেদিক না হলে এই বছরের শেষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বদলাতে চলেছে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দার নাম। জো বাইডেনের অবস্থা সুবিধের নয়। সামনের ভোটে যুযুধান মুখোমুখি তিনি ও ট্রাম্প। কিন্তু সিএনএনের বিতর্কে বাইডেন যেভাবে ট্রাম্পের সামনে ল্যাজেগোবরে হয়েছেন, তারপরে আর তাঁর ওপর ভরসাই রাখতে চাইছেন না ডেমোক্র্যাটিক দলের একাংশ। পাল্টা কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী করার জন্য দাবি উঠছে। বাইডেন নিজে অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁর সরে দাঁড়ানোর কোনও প্রশ্নই নেই। তিনিই থাকছেন, থাকবেন এবং ট্রাম্পকে হারাবেন। কিন্তু এতে চিঁড়ে ভিজছে না। ৮১ বছরের বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বারের জন্য আদৌ হোয়াইট হাউস ও এয়ার ফোর্স ওয়ানের সওয়ার হওয়ার উপযুক্ত থাকবেন তো? প্রশ্ন উঠেছে। সব রকমের সমীক্ষাও তাঁর বিপরীতেই আছে। কমলা হ্যারিস দাঁড়ালে হয়ত কিছুটা ভাল হতে পারে ডেমোক্র্যাটদের ফলাফল। না হলে ঘোর বিপদ!
রিপাবলিকান দলের ধ্বজা অতএব মহাসমারোহে উড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর ওপর হামলার ঘটনার পরে আরোই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এই অবস্থায় বাস্তবটা পড়ে নিতে আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না জেলেনস্কির। বরং আগে থাকতেই জাল গোটানোর কাজটা শুরু করে দিতে চাইছেন তিনি।
ইউক্রেন জানে, ওয়াশিংটনে যা অবস্থা, তাতে এরপর তাদের জন্য সামরিক বা আর্থিক সাহায্য আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সম্প্রতি ৬১ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ পাশ করাতে মার্কিন সংসদ হাউস অফ কংগ্রেসে নাকের জলে চোখের জলে একাকার অবস্থা হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের। যা সাহায্য এসেছে, তাতে টেনেটুনে ১৮ মাস চলতে পারে। তাতে ইউক্রেন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে পারবে বড়জোর। তারপর? এদিকে রাশিয়ার তো পিছু হঠার চিন্তাটুকুও নেই। ক্রমশই বাড়ছে আক্রমণ। মার্কিন সাহায্য আসার পরে তাদের অগ্রগতি কিঞ্চিৎ কমানো গিয়েছে, এইটুকুই। ইউক্রেনের সেনাকর্তারাই বলছেন, আক্রমণের অনুপাতে রাশিয়া প্রায় দ্বিগুণ এগিয়ে রয়েছে।
এরকম অবস্থা দেখে প্রমাদ গুনছে ইউরোপ। একাধিক বড় শক্তি এবার ইউক্রেনকে সাহায্যের পরিমাণ কমাতে শুরু করেছে। মুখে সকলেই বলছেন, তাঁরা মনপ্রাণ এক করে ইউক্রেনের পাশে আছেন। কিন্তু সেই পাশে থাকাটা কতদূর টাকাপয়সা বা গুলিবারুদে পাল্টাবে, সেসব ভেবে দেখবেন তাঁরা। জার্মানি যেমন ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, পরের বছর থেকে তারা সাহায্য অর্ধেক করে দেবে।
অতএব জেলেনস্কিকে এবার সন্ধির কথা ভাবতে হচ্ছে। এতদিন অবধি রাশিয়া ও ইউক্রেন কেউই কারোর সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা ভাবেনি। যতবার আলোচনার বা সন্ধির প্রস্তাব এসেছে, রাশিয়া এমন সব শর্ত চাপিয়েছে, যা ইউক্রেনের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। মস্কো বলেছে, কিভ যদি আলোচনায় বসতে চায়, তাহলে তাদের দেশের চারটি প্রদেশ, ডনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিৎজঝিয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে হবে। পাশাপাশি, নেটো জোটে যোগ দেওয়ার কোনও চেষ্টা করবে না। ইউক্রেন এসবকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিভ পাল্টা বলেছে, রাশিয়ার বাহিনী যতক্ষণ না পুরোপুরি ইউক্রেন ছেড়ে যাবে, ততক্ষণ কোনও কথাই বলা যাবে না।
কিন্তু এবার জেলেনস্কি আভাস দিলেন, তিনি আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে অতলান্তিকের এপার-ওপার দুইই যাবে তাঁর। আগে থাকতে সন্ধির কথা ভাসানোই বুদ্ধিমানের কাজ। নয়ত রাশিয়ার সেনাবাহিনীর যা ক্ষমতা, তার সঙ্গে টিকে থাকতে গেলে পশ্চিমী দেশগুলোর সাহায্য লাগবেই তাঁর। তাছাড়া সম্ভব নয়। গত মাসে সুইজারল্যান্ডে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিচুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইউক্রেন সাফ জানিয়েছিল, রাশিয়া ইউক্রেন ছেড়ে না গেলে কথা হবে না। কিন্তু এখন জেলেনস্কির কর্তারা বলছেন, পরের শান্তি সম্মেলনে তাঁরা রাশিয়ার প্রতিনিধিদলকে আশা করছেন। সমস্যার দ্রুত সমাধানই এখন তাঁদের লক্ষ্য।