অজস্র সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গোল অধরাই রয়ে গেল রোনাল্ডোর। (ছবিঃ রয়টার্স)
শেষ আপডেট: 6th July 2024 14:58
ম্যাচ শুরুর আগে বলাবলি হচ্ছিল, ফলাফল নিয়ে খুব বেশি হিসেবনিকেশ না করলেও হবে। দুটো দলই চূড়ান্ত নড়বড়ে খেলছে। বিশেষ করে ফ্রান্স। কিন্তু তারপরেও, পর পর দু'বারের বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট। ফিফা র্যাঙ্কিং-এ দুই নম্বরে। দুই দলের মুখোমুখিতে ২৮ ম্যাচের মধ্যে ১৯ বার জিতেছে ফ্রান্স। অতএব, যত যাই হোক, ম্যাচের শেষে কিলিয়ান এমবাপেরাই শেষ হাসি হাসবেন। সে যতই আঁতোয়া গ্রিজম্যানের খরা চলুক বা এমবাপে মাস্ক পরে নাজেহাল হোন না কেন...
কিন্তু প্রথমার্ধের খেলা কিছুক্ষণ গড়ানোর পরেই স্পষ্ট হতে শুরু করে, ছবিটা আদৌ সেরকম হচ্ছে না।
ম্যাচ শেষের পরিসংখ্যানগুলোই ধরা যাক। বল পজেশনে ৬০ শতাংশ পর্তুগাল। বক্সের ভেতর পর্তুগাল টাচ খেলেছে ২৯টি, ফ্রান্স ২৫-টি। মোট কর্নার পর্তুগাল পেয়েছে ১১ টি। ফ্রান্স সেখানে মাত্র ৪। দ্বিতীয়ার্ধে তো অবিশ্বাস্য দাপটে খেলার দখল নিল পর্তুগাল। একটা সময় মনে হচ্ছিল, যেন পর্তুগালের সঙ্গে খেলছে তিরিশ-চল্লিশ র্যাঙ্কের পিছনে থাকা কোনও দল। মাঠ জুড়ে দাপটে শাসন করছেন ৪১ বছরের তরুণ পেপে। কোলো মুয়ানি গোলের দিকে এগনোর চেষ্টা করতেই আটকে দিলেন রুবেন দিয়াজ। দু'চারটে ফাঁকা শট বাদে কিলিয়ান এমবাপেকে কার্যত নড়তে দিচ্ছিলেন না নুনো মেন্দেজ। তাঁর একটু ওপরে, সেন্ট্রাল মাঝমাঠের ধার ঘেঁষে থাকছেন হোয়াও পালহিনহা, সামনে বাঁ দিক ধরে বিদ্যুৎ গতিতে ওপরে উঠছেন উইংসে রাফায়েল লিয়াও। এনগোলো কন্তে অসহায়ের মত কয়েকটা শট নিলেন। পর্তুগালের কিপার দিয়েগো পোর্তোয় খেলেন। ওরকম গোল পর্তুগিজ প্রিমিয়েরা লিগাতেও হয় না বিশেষ।
এই পরিস্থিতির পরেও, একশো কুড়ি মিনিটে একটাও গোল হল না হামবুর্গে।
ফ্রান্সের রেকর্ড নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। একটি দল একটাও মাঠে গোল না করে সেমিফাইনালে উঠে গেল। ভাবা যায়? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! গোটা গ্রুপ পর্যায়ে ফ্রান্স মোট গোল করেছে দু'টি। একটি সেমসাইড। একটি পেনাল্টি। শেষ ষোলোর ম্যাচেও ফরাসিদের জিতিয়েছে সেমসাইড। দিদিয়ের দেশোঁর মুণ্ডুপাত চলছে ফরাসি মিডিয়ায়। কিন্তু পর্তুগালের তো তা নয়। গ্রুপ পর্যায়ে ৫ গোল করেছে। কিন্তু তাতেও, ছবিটা এড়ায় না। শেষ ষোলোর ম্যাচেই বোঝা গিয়েছিল, সমস্যাটা কোথায়। সামনে জর্জিয়া ছিল বলে শেষ অবধি দিয়েগো কোস্তা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন টাইব্রেকারে। কোয়ার্টার ফাইনালে ওই রোগটাই প্রাণান্তকর হয়ে দেখা দিল।
একবার দলটার কথা ভাবা যাক। বলা হচ্ছে, এবারের ইউরোয় সবচেয়ে শক্তিশালী তিনটে দল এসেছে স্পেন, ইংল্যান্ড ও পর্তুগাল। সোনায় বাঁধানো বললে কম বলা হয়। রাইট ব্যাকে হোয়াও ক্যানচেলো। অভিজ্ঞ, সেরি আ-তে ইন্টার মিলানের বর্ষসেরা দলে ছিলেন, পরে জুভেন্তাসকে লিগ জিতিয়ে ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আসেন। সেখানেও তিনবারের প্রিমিয়ার লিগ জয়ী। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে তুলেছেন। ফুল ব্যাকে তাঁর পাশে অবিশ্বাস্য পেপে, সঙ্গে রুবেন দিয়াজ, সিটিতে তাঁর সতীর্থ। লেফট ব্যাকে নুনো মেন্দেজ প্যারিস সাঁ জার্মাতে ফরাসি ফুটবলের আগাগোড়া চেনেন। মাঝমাঠে পিএসজিরই ভিতিনহা আছেন। ইনি পোর্তোর বিখ্যাত যুব আকাদেমির ফসল। পাশে ফুলহ্যামের হোয়াও পালহিনহা। অ্যাটাকিং মিডে ডান উইং ধরে বার্নার্দো সিলভা, মাঝে ব্রুনো ফেরনান্দেজ। ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আর্লিং হালান্দের পিছনে শক্ত খুঁটি বার্নার্দো, পেপ গুয়ার্দিওলার প্রিয় ছাত্র। সঙ্গে মার্কাস র্যাশফোর্ড, হ্যারি ম্যাগুইরদের অধিনায়ক, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড তারকা ব্রুনো। পাশে বাঁ উইং ধরে রাফায়েল লিয়াও। এসি মিলানকে এগারো বছর পরে সেরি আ জিতিয়েছেন লিয়াও। ব্যালন ডি'অরের তালিকাতেও নাম ঢুকেছে তাঁর।
এইরকম একটা দল শেষ ষোলো এবং কোয়ার্টার ফাইনালে মাঠে একটাও গোল পেল না, বললে বিশ্বাস হয়? কিন্তু রাত জেগে যারা ইউরো দেখছেন, জানেন, পর্তুগালের সমস্ত ব্রহ্মাস্ত্রই একটা তুণে গিয়ে খালি হয়। তিনি সামনে। সবার সামনে। দলের, মিডিয়ার, সমর্থকদের, টিভি ক্যামেরার... সবকিছুর সামনে। ইউরোপীয় ফুটবলের তাক লাগানো অস্ত্র দিয়ে দল গড়া হলেও, পর্তুগালের সমস্ত আলোর ফোকাস গিয়ে পড়ে, সামনের ওই একজনের ওপর। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ভাস্কো দা-গামার পরে নাকি তিনিই পর্তুগালের জনপ্রিয়তম আইকন!
পর্তুগালের হারের পিছনে সবাই এখন অতি সহজে হোয়াও ফেলিক্সের দিকে আঙুল তুলতে পারবেন। কিন্তু ফেলিক্স নামলেন কখন? ১০৫ মিনিটে। তাও আবার রাফায়েল লিয়াওয়ের জায়গায়। পুরো ইউরো কাটিয়ে দিলেন বেঞ্চে বসে। অথচ তিনি বেঞ্চে বসে ওয়ার্ম-আপ করতে যতটা নড়াচড়া করছেন, রোনাল্ডো সামনে ঠিক ততটাই এদিক-সেদিক করছেন। তাঁকে স্যালিবা বা কৌন্দে মার্ক করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। রোনাল্ডো দাঁড়িয়ে থাকছেন তাঁদের পিছনে। বল বাড়ালে পৌঁছতে পারছেন না, বল পেলে শট নিতে নিতে সেকেন্ডের কাঁটা চার-পাঁচ ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। সেট পিসে সেই ধার নেই। হেড দিতে পারলেন না ঠিকমত। একটা বাইসাইকল কিক নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বল অবধি পা পৌঁছল না। ৩৯ বছরে যেগুলো খুবই স্বাভাবিক। এই অবস্থায় হোয়াও ফেলিক্সের মত ফ্লুইড অ্যাটাকিং থার্ডের ফুটবলারকে না খেলানো তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! দিয়োগো জোটা বসে রইলেন বেঞ্চে। তাঁর না হয় মরসুমের শেষে চোট ছিল। কিন্তু মহম্মদ সালার অবর্তমানে ডারউইন নুনেজের সঙ্গে জোটা যা খেলেছেন, তাঁকে বসানো দেখে জুরগেন ক্লপ কী ভাবছেন কে জানে! গঞ্জালো র্যামোস, পেদ্রো নেটোও বসে কাটালেন।
দিদিয়ের দেশোঁর বিরুদ্ধে অনেক কিছু বলা যায়। সত্যিই ফ্রান্সের খেলা চোখে দেখা যাচ্ছে না এবার! সেমসাইডের ভরসায় সেমিফাইনালে উঠে গেল। কিন্তু দেশোঁ অন্তত যাকে বসানোর, বসিয়ে দিচ্ছেন। আঁতোয়া গ্রিজমান যেমন! ঠিক কী যে সমস্যা হয়েছে তাঁর, ঈশ্বরও বোধ হয় জানেন না। দেশোঁ ঝামেলায় না গিয়ে ৬৭ মিনিটে তুলে নিলেন। বদলি উসমান দেম্বেলে কিন্তু লিয়াওকে অবধি চাপে ফেলে দিলেন। কিলিয়ান এমবাপেকেও মাঠে রাখার ঝুঁকি নিলেন না। ১০৫ মিনিটে তুলে নিলেন। কিন্তু পর্তুগালের স্পেনীয় কোচ রবের্তো মার্তিনেজ ভুলেও একজনকে বসানোর ঝুঁকি নিলেন না। রুবেন নেভেস নামলেন ৯২ মিনিটে। লাভ হল না। অন্তত সত্তর মিনিটেও যদি রোনাল্ডোর জায়গায় জোটা বা ফেলিক্সকে নামাতেন মার্তিনেজ, সামনেটা এরকম শুখা হয়ে থাকত না। এমনকি সিআর সেভেনের সঙ্গে বাকি খেলোয়াড়দের বোঝাপড়াতেও দেখা গেল, চিড় ধরেছে। ফ্রি কিক নিতে গেলেন, মনে হল তাঁর সাধের কিকটাও মেরে দিলেন ব্রুনো।
গতকাল ম্যাচ টাইব্রেকারে যেত না। যাওয়ার কথাই নয়। দুটো দল সম্পূর্ণ ভুলে গেল, গোল কীভাবে করতে হয়। ফ্রান্সকে তাও দোষ দেওয়া চলে না। বেচারারা টুর্নামেন্ট জুড়েই গোল পায়নি। কিন্তু পর্তুগালের কাল অন্তত দুটো গোল করা উচিত ছিল। সম্ভবত সিআর সেভেনের অন্ধ ভক্তও এই কথাটা মানবেন। হল না, স্রেফ একটা সাহসী সিদ্ধান্তের অভাবের জন্য। যেখানে নক-আউট ম্যাচ, প্রতিপক্ষ ফ্রান্স এবং যে কোনও সময়েই টাইব্রেকার একটা কপালের ব্যাপার, সেখানে মাঠে নেমে গোল না করার অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জন্ম পর্তুগালের মাদেইরা দ্বীপে। আজও যখন সিআর সেভেন বিমানে করে সেখানে যান, নামার আগে পাইলট ঘোষণা করেন, 'আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে চলেছি।' ফুটবলকে নতুন করে আর কিছুই দেওয়ার ছিল না তাঁর। শুধু পর্তুগালের হয়ে দ্বিতীয় ইউরো জেতাটা দরকার ছিল। কিন্তু ফেরনান্দো স্যান্টোস যেটা করে বিশ্বকাপে খলনায়ক হয়েছিলেন, সেই ঝুঁকিটাতেই গেলেন না মার্তিনেজ। গেলে হয়ত ফলটা অন্যরকম হতে পারত! একজনের আত্মসর্বস্বতাতেই ডুবে গেল পর্তুগাল।