শেষ আপডেট: 17th May 2023 15:15
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তিনি ক্ষমতায় আছেন দুই দশক (Recep Tayyip Erdogan)। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী। তারপর রাষ্ট্রপতি। যে পদেই থাকুন না কেন, লোকে বলে, তাঁর নামটাই যথেষ্ট! তাঁর ব্যক্তিত্বের ঝলকানি এমনই যে, তিনি যাই করুন না কেন, দেশের প্রায় ৩০% ভোটার তাঁকেই ভোট দেবে! তিনি কড়া হাতে শাসন করেন, চাইলে ন্যাটোকে অবধি হুঁশিয়ারি দেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দলকে 'সন্ত্রাসবাদী' বলে দাগিয়ে দেন! সংবাদমাধ্যম থেকে বিচারবিভাগ— তাঁর হাত অনেক লম্বা। এদিকে নিন্দুকে বলে, এই করতে গিয়েই দেশে গণতন্ত্রের বারোটা বেজে যাচ্ছে, মানবাধিকারও প্রায়ই প্রশ্নের মুখে পড়ছে!
খুবই চেনা ঠেকছে না? ঠেকারই কথা। তবে ইনি আমাদের দেশের কেউ নন। আমাদের দেশের সঙ্গে তাঁর দেশের সম্পর্কও ইতিহাসের অনেকগুলো যুগ আগের। তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রেজেব তাঈপ এরদোয়ান।
তুরস্কে (Turkey) এই মুহূর্তে চলছে ভোট (Presidential Election)। আমাদের লোকসভা নির্বাচনের মতই। আর চারদিকে জোর গুঞ্জন— এবারের ভোটই নাকি হতে চলেছে উনোসত্তর বছরের এরদোয়ানের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। প্রায় কুড়ি বছরের শাসনের শেষে দেশের সমস্ত বিরোধীরা একেবারে বদ্ধপরিকর, এবার এরদোয়ানকে হঠাতেই হবে!
কী হতে চলেছে এবারের তুর্কির নির্বাচন? পরিস্থিতিটাই বা কীরকম? দ্য ওয়ালের সঙ্গে চলুন ঘুরে আসা যাক কান্দাহার, খোরাসান, টাইগ্রিস পেরিয়ে, একেবারে বসফোরাসের তীরে, কনস্ট্যান্টিনোপলের দেশে।
তুরস্কঃ ইতিহাস ও ভূগোলের গুরুত্ব
তুরস্কের মত বিচিত্র ভৌগলিক অবস্থান সারা পৃথিবীর খুব কম দেশেরই আছে। বলা যেতে পারে, রাশিয়া বাদ দিলে তুরস্কই একমাত্র দেশ, যারা এশিয়াতেও আছে, ইউরোপেও আছে। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের মাঝে, একদিকে সিরিয়া, লেবানন, ইজরায়েলের উপকূল, অন্যদিকে ঈজিয়ান সাগরে ছড়ানো গ্রিসের অজস্র ফুটকির মত দ্বীপ। মাঝে এশিয়া আর ইউরোপের মাঝে প্রায় চেকপোস্টের মত ছড়িয়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির কেন্দ্র ইস্তানবুল। বা সেকালের কনস্ট্যান্টিনোপল।
এককালে এই কনস্ট্যান্টিনোপল ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অংশ। পরে পুবে-পশ্চিমে ভাগাভাগি হলে কনস্ট্যান্টিনোপল হয়ে ওঠে পুবের রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। তার নতুন নাম হয় 'বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য'! সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে তার গরিমা একেবারে চরমে ওঠে। প্রায় এক হাজার বছরের শাসনের পরে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ৫৩ দিনের অবরোধের পর কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে অটোমানরা। নাম হয় ইস্তানবুল।
ভারতের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক বহুদিনের। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের ছোটবেলা উজবেকিস্তানে কাটলেও তিনি আদতে ছিলেন তুর্কি-মোঙ্গল। তাঁর আত্মজীবনী 'তুজুক-ই-বাবরি' লিখেছিলেন চাঘতাই তুর্কি ভাষায়। আজ এই ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এককালে বহু সম্ভ্রান্ত আমির ওমরাহ কথা বলতেন এতে। দিল্লি-আগ্রার বহু খানদানি মুঘল সভাসদ ছিলেন তুর্কি। মুঘল এবং অটোমান— দুই সাম্রাজ্যই ছিল মধ্যযুগের পৃথিবীর দুই 'গানপাউডার' সাম্রাজ্য! আজকের দিনে যা প্রায় পরমাণু শক্তিসম্পন্ন দেশের সমান।
১০ হাজারে বাবা পাওয়া যাবে, ব্রিটিশ নাগরিক হবে সন্তান, লন্ডনে কেলেঙ্কারি ফাঁস বিবিসির
কে এই এর্দোয়ান?
রেজেব তাঈপ এরদোয়ানের জন্ম ১৯৫৪ সালে, উত্তর তুরস্কের এক দরিদ্র রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তখন তুরস্কে চলছে এক নবজাগরণের পালা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়ে অটোমান সাম্রাজ্য কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তুরস্কে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু করেন ফিল্ড মার্শাল মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক। তুরস্কের রক্ষণশীল অটোমান শাসনকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে আতাতুর্ক শুরু করেন আগাপাশতলা সংস্কার। তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এক উন্নত রাষ্ট্র তৈরির কাজ শুরু হয়। খলিফাতন্ত্রকে শেষ করা হয়, শরিয়ার বদলে সুইজারল্যান্ডের আইনের অনুসারে উন্নত দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন আনা হয়, পশ্চিমী শিক্ষা ও স্কুলব্যবস্থার আমূল বদল ঘটানো হয়, এমনকি কর্মস্থলে হিজাব পরাও নিষিদ্ধ করা হয়।
স্বভাবতই, রক্ষণশীল সমাজের পক্ষে ব্যাপারটা বদহজম হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবাদ এসেছিল, পালটা অনেকেই জোর করে রক্ষণশীলতার রাস্তা নিয়েছিলেন। তাই হয়, হয়ে থাকে। এরদোয়ানও এই গোত্রে পড়েন। ছোটবেলা থেকেই ইসলামি শিক্ষা, দর্শন ও আদবকায়দার প্রতি তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন, স্কুলে পড়তেই পবিত্র কোরান-সহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠে মুনশিয়ানা অর্জন করেন।
ভাল ফুটবল খেলতেন এরদোয়ান। নব্বইয়ের দশকে আতাতুর্কের সংস্কার ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা তখনও তুরস্কের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এরদোয়ান প্রথম সংসদে নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালে। কিন্তু তাঁকে বিভিন্ন অভিযোগে পদ হারাতে হয়। ততদিনে পালটা ইসলাম অনুসৃত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে বেশ জনপ্রিয়তা কুড়োচ্ছেন এর্দোয়ান। ১৯৯৪ সালে তিনি ইস্তানবুলের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। ততদিনে তাঁর বাস্তববোধ, শাসনে দক্ষতা এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বেশ প্রশংসা কুড়োতে শুরু করেছে।
কিন্তু ১৯৯৭ সালে আবার তিনি সমস্যায় জড়ান। প্রকাশ্যে এমন একটি কবিতা আবৃত্তি করেন, যাতে লেখা ছিল, 'মসজিদই আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের বেয়নেট, বিশ্বাসীরাই আমাদের সৈনিক'। তুর্কি আদালত জানিয়ে দেয়, এটি সরাসরিভাবে হিংসা ও জাতিবিদ্বেষকে জাহির করছে। তাঁর দশ মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত।
প্রায় চার মাস জেলে কাটিয়ে তিনি আবার রাজনীতিতে ফেরেন। তৈরি করেন তাঁর নিজের দল, 'আদালত য়ে কালকিনিমা পার্টি' বা 'সুবিচার ও উন্নয়নবাদী দল', ইংরেজিতে 'একে পার্টি'। কামাল আতাতুর্কের সম্পূর্ণ বিপরীতে এরদোয়ানের নতুন দলের বিশ্বাস ছিল ইসলাম ধর্মে ও ইসলামীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায়। ২০০২ নির্বাচনে তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার খাতিরে ২০০৩ সালে তিনি প্রথমবারের জন্য তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন।
তাঁর বিরোধীদের জোট
রেজেব তাঈপ এরদোয়ানের একে পার্টি কার্যত নিরঙ্কুশ দাপট রেখে শাসন করে গিয়েছে তুরস্ক। তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এরদোয়ান, শুরুর দিকে তাঁর নানা উদ্যোগ প্রশংসিতও হতে থাকে। কিন্তু এরদোয়ানের নিরঙ্কুশ একনায়কতান্ত্রিক শাসনেই ধীরে ধীরে শঙ্কিত হতে থাকেন বিরোধীরা। এবারে তাই দেশের ছয়টি বিরোধী দলের এক মহাজোট নেমেছে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে। যাদের নেতা হয়েছেন চুয়াত্তর বছরের কামাল কিলিচদারুলু।
বস্তুত, এই মহাজোটকে বলা হচ্ছে 'ছয়জনের টেবিল'। তাদের শীর্ষে আছে কিলিচদারুলুর 'প্রজাতান্ত্রিক লোকদল' বা 'সিএইচপি'। সঙ্গে রয়েছে আরও পাঁচজন। এই জোট আক্ষরিক অর্থেই ভারতের রাজনীতির কথা মনে করিয়ে দেবে। এই জোটে রয়েছে ডানপন্থী, বামপন্থী, ইসলামি-সহ বিবিধ মতাদর্শের পাঁচটি দল। কিলিচদারুলু এদের মুখ। এরদোয়ানের 'ক্যারিশমা'-র উল্টোদিকে ইনি খুবই স্বল্পবাক এবং সাধারণ ভাবমূর্তির। কিন্তু যখন কথা বলেন, স্পষ্ট করে সহজভাবে গুছিয়ে বলতে পারেন।
আমূলের বাচ্চা মেয়েটির বয়স ৫৭, তার কথায় মাখনের সঙ্গে মিশে যায় রাজনীতি, সিনেমা থেকে খেলা
আগে তিনবার তিনি লড়েছেন এরদোয়ানের বিরুদ্ধে। তিনবারই হেরেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবন এবং বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতাতেই কামাল কিলিচদারুলু হয়ে উঠেছেন এরদোয়ানের বিপরীতে বিরোধীদের মুখ।
এরদোয়ানের সমস্যাঃ তুর্কি অর্থনীতি
দীর্ঘ কুড়ি বছরের শাসনের শেষে রেজেব তাঈপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এই ক্ষোভের অনেকটাই আদতে আর্থিক। তুর্কি অর্থনীতি এখন রয়েছে একেবারে চরম সংকটে। মুদ্রাস্ফীতি চরমে, দেশের জাতীয় ঋণ আয়ত্তের বাইরে, তা শুধবার মত ক্ষমতাও ক্রমশ কমে আসছে। এতে সবচেয়ে সংকট বাড়িয়েছে তুর্কি মুদ্রা লিরার ক্রমাগত পতন। এরদোয়ানের সুদ-নীতিতে চলতে গিয়ে তুর্কির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদ ১৯% থেকে নামিয়ে ১৪%-এ নেমে এসেছে। যার ফলে লিরার বিনিময়মূল্য এক ধাক্কায় ৪৪% পড়ে গিয়েছে। এতেই কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে আমজনতার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামই এমন বেড়েছে যে, লোকে রীতিমতো তাদের সঞ্চয় ভাঙিয়ে বাজার-দোকানের কাজ চালাচ্ছে।
এই পুরো ব্যাপারে আগুনে প্রায় পেট্রোল ঢেলে দিয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসের ভূমিকম্প। গত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ভূমিকম্প দেখেনি আনাতোলিয়া। গোটা তুরস্ক জুড়ে একাধিক শহর কার্যত মাটিতে মিশে গিয়েছে, ধ্বংসস্তুপে প্রাণ হারিয়েছেন ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। লিরার দাম পড়ে প্রায় ধুঁকতে থাকা তুরস্ক সরকার কীভাবে এর মোকাবিলা করবেন, ভেবেই আতান্তরে ছিলেন অনেকে। এরদোয়ানের সরকারের বিরুদ্ধে রাগ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে।
ভোটাভুটির পরিস্থিতি
তুরস্কের ভোটাভুটির নিয়ম এমনিতে খুব সহজ। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় নির্বাচন হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কেউ কোনও দল প্রার্থী দিতে চাইলে, শেষ সংসদীয় নির্বাচনে তাদের ৫%-এর বেশি আসন জিততে হবে। তুরস্কের নাগরিক, বয়স ৪০-এর বেশি এবং নূন্যতম স্নাতক ডিগ্রি থাকলেই যে কেউ প্রার্থী হতে পারবেন। যদি প্রথম রাউন্ডের ভোটেই কেউ ৫০%-এর বেশি ভোট পেয়ে যান, তাঁকে সেই রাউন্ডে জয়ী বলে ঘোষণা করা হবে। কিন্তু ৫০% না পেরোলে দুই সপ্তাহ পরে আরেক রাউন্ড ভোটাভুটির মুখোমুখি হতে হবে।
প্রথম রাউন্ডের শেষে দেখা যাচ্ছে, এরদোয়ান পেয়েছেন ৪৯.৫% ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারুলু পেয়েছেন ৪৪.৮৯% ভোট। অতএব, হিসেব মত এরদোয়ানকে দুই সপ্তাহ পরে, ২৮ মে, রবিবারে আরেক দফা ভোটাভুটির সামনে পড়তে হবে। ভোট দেবেন ৬ কোটিরও বেশি ভোটার। যার মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষ তরুণ ভোটার, যারা ভোট দেবেন প্রথমবার।
এখনও অবধি কী হবে সেই নিয়ে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন, জিতবেন এরদোয়ানই। হয়ত জয়ের ব্যবধান কমবে। বা বাড়বে। কিন্তু জিতবেন তিনিই। সতর্ক নজর রাখছে পশ্চিমী বিশ্ব, এমনকি ভারতও। ভারতের সঙ্গেও এরদোয়ানের সম্পর্ক বিশেষ সুবিধের নয়। ফলে এই ভোটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে ভারতের জায়গাও। এমনকি জয় পেলে আবার নিজের ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে এরদোয়ান কোন পথে হাঁটেন, সেই নিয়েও জল্পনায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কর্নাটকের সঙ্গে বাংলার যোগ বহুদিনের, সেন রাজাদের আমল থেকে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ বা টিপু সুলতান মসজিদ