শেষ আপডেট: 15th October 2023 17:34
কাট ওয়ান। আজ থেকে বছর চারেক আগের কথা, তখনও লকডাউন, করোনা শব্দগুলোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচিত হওয়া বাকি। ২০১৯-এর মাঝামাঝি আচমকাই ভাইরাল হলেন রাণাঘাট স্টেশনের এক পাশে বসে ভিক্ষা করা এক মহিলা, জানা গেল তাঁর নাম রাণু মণ্ডল। আপন মনে লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত গান 'এক পেয়ার কা নাগমা' গাইছিলেন তিনি। তাঁর সেই গান শুনে বোঝার উপায় নেই গায়িকা কে। এ যেন অবিকল লতা মঙ্গেশকরেরই কণ্ঠ!
কাট টু। এ দেশে বহুকাল ধরেই মানসিক অসুস্থ মানুষকে রাস্তায় সাধারণ মানুষ ঢিল ছোড়ে, টিটকিরি দেয়। তবে এই সেদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় তারকা হয়ে ওঠা রাণুরও যে সেই একই রকম অবস্থা হবে, তা কে জানত!
ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যায়, উঠতি ইউটিউবাররা দলে দলে চলেছেন রাণাঘাটে রাণুর একচিলতে বাড়িতে। দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। স্পষ্ট রাণুর অসুস্থতা ও অসংলগ্নতাও। পোশাকআশাকেও ছাপ অযত্নের। তবু তাঁকে দিয়ে নানা কথাবার্তা বলিয়ে অথবা গান গাইয়ে ইউটিউবারের জোগাড় করেন 'কনটেন্ট'। কেউ নাচছেন, কেউ গাইছেন, কেউ ইচ্ছে করে অপমানজনক প্রশ্ন করছেন, কেউ খাওয়াচ্ছেন, কেউ বা ব্যঙ্গও করছেন! প্রকাশ্যেই! যেন এমনটা করাই যায়, করারই কথা!
কমেন্টবক্স উপচে পড়ে হাসি আর বিদ্রূপে। ভিউ বেড়ে চলে ঝড়ের গতিতে। দুরন্ত হাসির ভিডিও হিসেবে বাড়ে শেয়ারও। অবশ্য নেটিজেনদের একটা অংশের কেউ কেউ মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এগুলো অপরাধ, অনাচার, অন্যায়। তবে তাঁদের কথায় কান না দিয়ে 'হাহা'তে মেতে ওঠা জনগণের সংখ্যাই দৃশ্যত বেশি বলে দেখা যায়।
এসবের মাঝে নিজের খেয়ালে মগ্ন রাণু কখনও গেয়ে ওঠেন 'টুম্পা সোনা', 'কাঁচা বাদাম', আবার কখনও রেগে ওঠেন অযাচিত উপদ্রবে। প্রবল গালিও দেন। বলেন অসাংবিধানিক কথাবার্তা। তাতেই যেন আরও 'মজা'!
এমনটা যদিও হওয়ার কথা ছিল না। ২০১৯-এর ভাইরাল ভিডিওর পর যেন স্বপ্নের উত্থান হয়েছিল রাণুর। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন রাণু মণ্ডল। তাঁর ভাইরাল 'এক পেয়ার কা নাগমা' গানের ভিডিও পৌঁছয় সুদূর মুম্বই পর্যন্ত। সাগরপাড়ে রিয়্যালিটি শো-তে মুখ দেখালেন রাণু, গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক হিমেশ রেশমিয়া প্রতিশ্রুতি দেন তাঁর পরবর্তী ছবিতে প্লেব্যাক করবেন রাণু। প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন হিমেশ। রাণুর 'তেরি মেরি' গানে প্লেব্যাকের ভিডিও একই ভাবে ভাইরাল হয় নেটপাড়ায়।
তবে রানাঘাটের লতাকণ্ঠীর জীবনে সুখ যেন ক্ষণিকের অতিথি। যত তাড়াতাড়ি তিনি এসেছিলেন আলোর বৃত্তে, তার চেয়েও কম সময় লাগল রাণুর ভাগ্য বদলাতে। রাণুর বলা নানা কথাবার্তা, আচার আচরণ, অহংকারী মন্তব্য- এসব ক্রমশই যেন তাঁকে হাসির খোরাক করে তুলেছিল তাঁদের কাছেই, যাঁরা একদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর কণ্ঠের জাদুতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিতর্কিত গায়ক-অভিনেতা হিরো আলমের সঙ্গেও নাকি জুটি বেঁধে গান গেয়েছেন রাণু। তবে সময়ের নিয়মেই সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গিয়েছে রাণু মণ্ডলের প্রতিভা বা গান নিয়ে। এমনকী আজকাল রাণুর খোঁজ রাখেন না সেই অহীন্দ্র চক্রবর্তীও, যাঁর সুবাদে রাণু ভাইরাল হয়েছিলেন ২০১৯ সালে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, একাই থাকেন প্রৌঢ়া রাণু। পড়শিরাও তেমন খোঁজ খবর রাখেন না। ভিড় করেন কেবল ভ্লগাররাই। তাঁদের কনটেন্টের বিনিময়ে অর্থ দিলে খাওয়া জোটে, নাহলে অভাবই সঙ্গী। তবে অযাচিত উপদ্রবে যখন বিরক্ত হয়ে ঝাঁটা হাতে তেড়ে যান রাণু, তখন কি তাঁর একবারও মনে হয়, এর চেয়ে প্ল্যাটফর্মের দিনগুলোই ভাল ছিল? সে উত্তর হারিয়ে গিয়েছে রাণুর প্রলাপ আর সোশ্যাল মিডিয়ার নির্মমতার অন্ধকারে।