শেষ আপডেট: 25th December 2023 13:50
বড়দিনের প্রাক্কালেই শোকের খবর। এই খবর প্রথম দিচ্ছে 'দ্য ওয়াল' ই। চলে গেলেন বাঘার বাঘিনী। তবে এই বাঘিনী ছিলেন ভীষণই শান্ত, সাধাসিধে। প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা রবি ঘোষের স্ত্রী বৈশাখী ঘোষ প্রয়াত হলেন গতকাল ২৪ ডিসেম্বর দুপুরে। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
রবি ঘোষের আসল পদবী ছিল ঘোষ দস্তিদার। বৈশাখীর বিয়ের আগের পদবী দাস। বিয়ের পর হন বৈশাখী ঘোষ দস্তিদার। রবি ঘোষের প্রথম স্ত্রী ছিলেন স্বর্ণযুগের বিখ্যাত অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তা। অনুভার এটি দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। ১৯৭২ সালে হঠাৎই প্রয়াত হন অনুভা। বিপত্নীক রবি ঘোষ বহু বছর একাই ছিলেন। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্তদের জোরাজুরিতে দ্বিতীয় বিবাহ করেন বৈশাখী দেবীকে। সম্বন্ধ করেই সেই বিয়ে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিবাহে খুবই সুখী ছিলেন রবি। বৈশাখীদেবীর জীবনে রবিই ছিলেন প্রথম পুরুষ। রবিকে প্রথম দেখায় কমেডিয়ান ভেবে নাকি ভীষণ হেসে ফেলেছিলেন বৈশাখী।
বৈশাখী ঘোষের মেয়েবেলার বান্ধবী হলেন স্বনামধন্য অভিনেত্রী সোমা দে। তখন সোমা, বৈশাখী দুজনেই বালিকা। সাত দশক পেরোনো সেই বন্ধুত্ব শেষ হল রবিবার। কিন্তু মৃত্যুতে কি আদৌ শেষ হয় এমন প্রাণের বন্ধুত্ব?
প্রিয় বান্ধবীর প্রয়াণে গলা বুজে আসছে। তবু বৈশাখীদেবীর গল্প বলতে বসলেন সোমা দে। প্রশ্ন করলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুভদীপ- বৈশাখীদেবীর কী হল হঠাৎ, যে এভাবে চলে গেলেন?
সোমা- আমরা সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত থাকি বলে রোজ হয়তো আমাদের দেখা হাত না, কিন্তু ফোনে যোগাযোগ থাকত। পরশু আমার শ্যুটিং ছিল না। তাই ভাবলাম বৈশাখীকে ফোন করি। কিন্তু দেখলাম ফোন সুইচ অফ। তারপর যে ছেলেটি ওঁর সন্তানের মতো রয়েছে এতদিন ওঁর সঙ্গে, সেই রঞ্জিতকে ফোন করলাম। রঞ্জিত হল রবিদা আর বৈশাখীর পালিত পুত্র। সে বলল, "আর বোলো না, বৌদি ভীষণ অসুস্থ রক্তশূন্য হয়ে গেছে, কিডনির অবস্থা খুব খারাপ। তাই হাসপাতালে ভর্তি করেছি।" তারপর গতকালই শুনছি বৈশাখী আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমি আর এতদিনের বন্ধুকে শেষশয্যায় এই বয়সে দেখতে পারিনি। আমার ছেলে গিয়েছিল দেখতে। আমার মেয়েও ভীষণ ভালবাসত বৈশাখীকে। আমার মেয়ে যাজ্ঞসেনী যখন ছোট ছিল তখন রবিদা আর বৈশাখী বাইরে ঘুরতে গেলেই আমার মেয়ের জন্য ব্যাগ নিয়ে আসত। তাই আমার মেয়ে বৈশাখীকে 'ব্যাগ মাসি' বলে ডাকত। মেয়ে চেন্নাই থেকে যখনই কলকাতায় আসত, প্রতিবার বৈশাখীর বাড়ি নিয়ে যেত আমাকে।
শুভদীপ- বৈশাখীদেবীর সঙ্গে আপনার তো একদম ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব?
সোমা- হ্যাঁ, আমরা সমবয়সী। আমাদের তিন বান্ধবীর একটা গ্রুপ আছে। লোকে আমাদের বলত থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। আমি, বৈশাখী আর ইন্দ্রাণী, আমরা তিনজন সবসময় একসঙ্গে থেকেছি। বিয়ের পর নিজেদের সংসার হওয়ার পর, এমনকী এই বয়সে এসেও আমাদের বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি কখনও। আমরা ছোটবেলায় উত্তর কলকাতার এক পাড়াতেই থাকতাম। এক স্কুলে, এক কলেজে তিন বান্ধবী পড়েছি। স্কটিশ কলেজে আমি আর ইন্দ্রাণী তবু অনেক দুষ্টুমি করতাম, কিন্তু বৈশাখী ছিল চিরকালই খুব ঠান্ডা শান্ত স্বভাবের। আমরা তিন বান্ধবী ফোনে গানে গানে কথা বলতাম। উত্তর দিতাম গানে গানে। সেটা এখনও চলত। আমি গায়িকা হতে চেয়েছিলাম, নায়িকা হয়ে গেলাম। আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি গায়িকা হই। সেইভাবে গানের তালিম নিয়ে সব পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছি। কিন্তু জীবন টেনে নিয়ে গেল অভিনয়ে। গায়িকা হওয়া আর হল না। কিন্তু আমাদের তিন বান্ধবীর আড্ডায় গান ছিল মাস্ট।
শুভদীপ- রবি ঘোষের সঙ্গে বৈশাখী দেবীর বিয়ের গল্প বলুন একটু?
সোমা- রবি ঘোষের সঙ্গে বৈশাখীর বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করেই। কোনও চেনাশোনার ব্যাপারই ছিল না। বৈশাখীরা এক বোন, এক ভাই। ওঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন আগেই, তবে মা ছিলেন। নাটক, ফিল্মে অভিনয়ের সূত্রে রবিদার সঙ্গে ততদিনে আমার আলাপ গাঢ় হয়েছে। রবিদা, সৌমিত্রদা ভীষণ বন্ধু। এক জায়গায় থাকেন তখন। দুজনের নাট্যদলেই আমি অভিনয় করেছি। কিন্তু রবিদার সঙ্গে যে আমার বান্ধবীর বিয়ে হচ্ছে সেটা প্রথমে জানতাম না। বৈশাখীর বিয়েতে গিয়ে দেখি, ওমা আমাদের রবিদা বর! সৌমিত্রদা ছিলেন রবিদার বিয়ের প্রধান উদ্যোক্তা। বৈশাখী রবিদাকে খুব যত্নে রেখেছিল। রবিদার সঙ্গে বৈশাখীর রসায়ন ভীষণ ভাল ছিল। সব অনুষ্ঠানে রবিদা ওকে নিয়ে যেতেন। ছুটি পেলেই বৈশাখীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়তেন রবিদা। বিয়ের পর ওঁরা হানিমুনে পুরী গিয়েছিল। তবে বৈশাখীর কপালে সুখ সইল না। পনের ষোল বছর সংসার করেছে। তারপরই তো রবিদা চলে গেলেন হঠাৎই। বৈশাখী তখন ভীষণ শোক পেয়েছিল। আসলে বৈশাখীর ওপর দিয়ে ঝড় অনেক গেছে। বিয়ের অনেক আগেই একবার কালীপুজোতে চরকির আগুনে বৈশাখী পুড়ে গিয়েছিল। পায়ের কাছে অনেকটা অংশ পোড়া ছিল। সেটা শাড়িতে ঢাকা থাকত। তবে রবিদার সঙ্গে বিয়ের সময় সেসব গোপন করেনি ওরা। খুব সুখের সংসার ছিল ওঁদের। সেলিব্রিটি স্বামী হলেও বৈশাখী নিজেকে প্রচারের আড়ালেই রাখত।
শুভদীপ- রবি ঘোষের প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্তাকে নিয়ে বৈশাখীদেবী কিছু বলতেন?
সোমা- না একদমই নয়। অনুভাদির ওপর বৈশাখীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু রবিদা বা বৈশাখীকে সেভাবে কখনও অনুভা গুপ্তার কথা আলোচনা করতে দেখিনি।
শুভদীপ- রবি ঘোষ-বৈশাখীদেবীর তো নিজের কোনও সন্তান ছিল না?
সোমা- না। কিন্তু সন্তান কি শুধু রক্তের সম্পর্কেই হয়! নিজের সন্তানও তো বাবা মাকে দেখে না আজকাল। রবিদা একটি বাচ্চা ছেলেকে কাজে রেখেছিলেন। ওঁর নাম রঞ্জিত। তাকেই পড়াশোনা শেখান। রবিদার মৃত্যুর পর রঞ্জিত বৈশাখীকে আগলে রাখত। রঞ্জিত চাকরি করে বিয়ে করে রবিদার বাড়িতেই থাকে। বৈশাখীকে মায়ের মতোই ভীষণ যত্নে রেখেছিল রঞ্জিত আর ওর বউ। একাকীত্বে ভুগতে হয়নি বৈশাখীকে। ছেলেটিকে ওরা নিজের সন্তানই ওঁরা ভেবেছে বরাবর। তবে বৈশাখীর পায়ে ব্যথা, ইত্যাদি হওয়াতে বাড়ি থেকে বহুদিন বেরতে পারত না। সেই অবসাদটা ছিল। আমাদের তিন বান্ধবীর এক জন কমে গেল আজ। গল্প করার সঙ্গী চলে গেল। ভীষণ চুপচাপ মেয়েটা চুপচাপই চলে গেল।