বাংলাদেশে আর্জেন্তিনাকে নিয়ে ভালবাসা তুলনাহীন।
শেষ আপডেট: 20th July 2024 14:30
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কলকাতার সমাজমাধ্যমে প্রায় তরজা শুরু হয়েছে। একপক্ষ বলছেন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রেই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে চলা হিংসায় নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের পাশেই দাঁড়াবেন। কিন্তু অপরপক্ষ মানতে নারাজ। তাঁদের একাংশ নানা বিচিত্র যুক্তি দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা বাড়ছে, ইসলামী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, এমন অবস্থায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো উচিত নয়। কেউ বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিষেদ্গার চলে, তাতে এইসব হিংসাত্মক ঘটনা হলে এপার বাংলার কিছুই যায়-আসা উচিত নয়। অনেকে আবার 'ভারত সরকারের সরকারি প্রতিক্রিয়ার বাইরে কথা বলা উচিত না' ইত্যাদি যুক্তিও দিচ্ছেন। অথচ কলকাতা বা সরকারিভাবে নয়াদিল্লিও সাবধানী প্রতিক্রিয়া দিলেও, সারা বিশ্বে ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের সংঘর্ষের খবর। যার ফলে তাবড় ব্যক্তিত্বরা মুখ খুলছেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যেমন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাঁর মুখপাত্র জানিয়েছেন, মহাসচিবের দফতর বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের দিকে কড়া নজর রাখছেন। নিউ ইয়র্কে তাঁর মুখপাত্র স্তেফানে দুজারিচ জানিয়েছেন, 'সব পক্ষকে নিরস্ত হতে হবে। সেটাই সবচেয়ে জরুরি। মহাসচিব বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করছেন, যাতে তাঁরা আরও গঠনমূলক লক্ষ্য নিয়ে আলোচনার রাস্তায় সরে আসেন।'
আরও চাঁছাছোলা ভাষায় মন্তব্য করেছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনে মার্কিন স্বরাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত করা যে কোনও গণতন্ত্রের গোড়ার কথা। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের ওপর যে কোনও রকমের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে আমরা তার নিন্দা করব। যারা আহত হয়েছেন, যাদের প্রাণ গিয়েছে, আমাদের চিন্তা তাঁদের সঙ্গেই আছে।'
যথারীতি, এতে বেজায় চটেছে ঢাকা। বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রক পাল্টা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, 'ভুয়ো খবরের ভিত্তিতে এসব দাবি করা হলে তা উলটে আরও হিংসাতেই মদত জোগাবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তো আমাদের গণতন্ত্রেরও স্তম্ভ।' এতেই না থেমে ঢাকা আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাকে টেনে এনেছে। জানিয়েছে, 'আমরা এতে গভীরভাবে চিন্তিত। এই ধরণের ঘটনা গণতন্ত্রের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী দু'জনেই ট্রাম্পের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছেন।' ঘটনাচক্রে, বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার নানা খিটিমিটি চলছে। বাংলাদেশে চলা নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল আমেরিকা।
এদিকে বাংলাদেশের হিংসার প্রতিবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জমায়েত করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বহু পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসী বাঙালিও তাতে যোগ দিয়েছেন। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার চত্বরে সমাবেশ করেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। জ্যাকসন হাইটে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি আলোচনাসভার ডাক দেওয়া হয়। কানাডার টরন্টোয় একদিনে তিনটি সমাবেশ হয়। টরন্টোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত বাংলাদেশি ছাত্ররা এতে অগ্রণী ভূমিকা নেয়।
তবে অভিনব একটি প্রতিবাদ এসেছে আর্জেন্তিনা থেকে। তাও, একেবারে খোদ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্তিনা তারকার।
সমাজমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে পোস্ট করেছেন চেলসি ও আর্জেন্তিনা দলে লিওনেল মেসির সতীর্থ এনজো ফেরনান্দেজ। লিখেছেন, 'বাংলাদেশের যে সব মানুষ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য আমি প্রার্থনা করছি।' সঙ্গে বাংলাদেশ ও আর্জেন্তিনার পতাকা পাশাপাশি।
বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা ভালবাসার কথা আজ লাতিন আমেরিকায় সুবিদিত। কলকাতা, ঢাকা ঘুরে গিয়েছেন একাধিক ব্রাজিল ও আর্জেন্তিনা তারকা। কলকাতার যুবভারতীর আগে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সদলবলে খেলে দিয়েছেন স্বয়ং লিওনেল মেসি। কাতার বিশ্বকাপে বাংলাদেশী ও ভারতীয় ফুটবলভক্তরা আলবিসেলেস্তেদের প্রতিটি ম্যাচে ভিড় করেছেন। যার ফলে একটা সময় দেখা যায়, আর্জেন্তিনা থেকে আসা বেশ কিছু সমর্থক ভারত-বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ঘুরছেন।
কিন্তু তারপরেও ঘটনার রেশ গড়ায় আরও অনেকটা। সরাসরি পৌঁছে যায় রাজনীতি-কূটনীতিতে।
স্বাধীনতার পরে-পরেই ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় আর্জেন্তিনা। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুয়ান পেরন পরের বছরের মধ্যে, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় আর্জেন্তিনীয় দূতাবাস খোলার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তারপরেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। হর্হে রাফায়েল ভিদেলার আমলে চরম সামরিক শাসন শুরু হয় আর্জেন্তিনায়। শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। ডামাডোলে বাংলাদেশে আর্জেন্তিনা দূতাবাসটিকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তারপর সেই দূতাবাস আর খোলা হয়নি। দুইদেশের সম্পর্কেও খানিক শৈত্য এসে গিয়েছিল। কিন্তু জট কাটাল সেই ফুটবল।
কাতার বিশ্বকাপের পরেই বাংলাদেশের ভক্তদের আর্জেন্তিনা-প্রীতির কথা পৌঁছে যায় বুয়েনোস আয়রেসে। নড়েচড়ে বসেন আর্জেন্তিনা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। তারপরেই তোড়জোড় শুরু হয় নতুন করে ঢাকা-বুয়েনোস আয়রেস বন্ধুত্বের। খোদ আর্জেন্তিনার রাষ্ট্রপতি আলবের্তো ফেরনান্দেজ সম্মতি দেন। অতএব ৪৫ বছর পরে, ২০২৩ সালে ঢাকায় ফের খোলা হয় আর্জেন্তিনা দূতাবাস। উদ্বোধন করতে সপার্ষদ উড়ে আসেন খোদ আর্জেন্তিনার বিদেশমন্ত্রী সান্তিয়াগো কাফিয়েরো। সঙ্গে ছিলেন একদল শিল্পপতি, প্রশাসনিক কর্তা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধি, সাংবাদিকদের দল। সাড়ম্বরে তাঁদের স্বাগত জানায় ঢাকা। দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বস্তুত, কাফিয়েরোই ছিলেন প্রথম দক্ষিণ আমেরিকার কোনও দেশের বিদেশমন্ত্রী যিনি পা রাখলেন বাংলাদেশে। দূতাবাসের উদ্বোধনের পরে কাফিয়েরো বলেন, 'আমরা একটা নৈতিক ও ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করলাম আজ। যে ভালবাসা আমার দেশের প্রতি আপনারা দেখিয়েছেন, তার সামান্য কিছু শোধ করতেই আমাদের এখানে আসা।'
শোধ করার বহরটিও ছিল সেরকমই। কাফিয়েরোর সঙ্গে ছিলেন বহু আর্জেন্তিনীয় সংস্থার প্রতিনিধিরা। কিন্তু শুধু বাণিজ্যেই থেমে থাকেননি। আর্জেন্তিনার বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত আর্জেন্তিনীয় ফুটবল ক্লাব রিভারপ্লেটের ফুটবল কর্তা সেবাস্তিয়ান পেরেজ এস্কোবার। বলা হয়, এবার থেকে বাংলাদেশের একাধিক নামী ফুটবল ক্লাবকে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ দিতে রিভারপ্লেট ক্লাবের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত বাংলাদেশে আসবেন। শুধু তাই নয়, এক মরশুমের জন্য বাংলাদেশী ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়াকে আর্জেন্তিনার একটি ক্লাবে খেলতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
তার মাসখানেক পরে, ঈদের দিন আর্জেন্তিনার জাতীয় ফুটবল দলের তরফে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট করা হয় সমাজমাধ্যমে। লিওনেল মেসি, রদ্রিগো দে পল ও অ্যাঙ্খেল দি মারিয়ার ছবি দিয়ে সেই পোস্টে লেখা হয়, 'বাংলাদেশের সকল বন্ধুকে আমাদের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে ঈদের শুভেচ্ছা।'
শুধু খুশি নয়, আজ সংকটের দিনেও এনজোর পোস্টে বোঝা গেল, তাদের প্রিয় বাংলাদেশকে ভোলেনি আর্জেন্তিনা।