যত কম বয়সে এই রোগকে ধরে ফেলা যাবে, ততই বিপদের সম্ভাবনা কম থাকবে।
শেষ আপডেট: 15th June 2024 18:03
ডাঃ পার্থজিৎ দাস
অধিকর্তা
এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনোলজি অ্যান্ড রিউম্যাটোলজি
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বয়স বাড়লে হাড়গোড় একটু ঠুনকো হয়ে যায়, এ তো জানা কথা। বিশেষ করে বয়স পঞ্চাশ পেরোনোর পরে পড়ে-টড়ে গেলে বা আঘাত লাগলে হাড়ে চিড় ধরা বা হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। কিন্তু ভাবুন তো, যদি এমন হয় যে, একটু ঝুঁকে কিছু কুড়োতে গেলেন বা চাপ দিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে গেলেন, বা একটু জোরেই কেশে ফেললেন আর মট করে হাড় ভেঙে গেল?
অসম্ভব নয় কিন্তু। তখন আর এটাকে মামুলি হাড়-ভাঙা বলে ধরা যাবে না। হাড় একটি সজীব কলা, যা সর্বক্ষণ বিনষ্ট হতে থাকে, আবার নতুন তৈরিও হতে থাকে। বয়স যত কম থাকে, শরীর তত দ্রুত নতুন হাড় তৈরি করে। যার ফলে হাড়ের ঘনত্ব বা 'বোন মাস' বৃদ্ধি পায়। কুড়ির কোঠা পেরোলে ক্রমশ এই দ্রুত নতুন হাড় তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া একটু কমে আসে। তিরিশের ঘরে পৌঁছলে সাধারণত মানুষের হাড়ের ঘনত্ব সর্বাধিক হয়। তারপর যত বয়স বাড়ে, যতটা দ্রুততার সঙ্গে হাড়ে ক্ষয় হয়, ততটা দ্রুত হারে নতুন হাড় তৈরি হয় না। এই ঘটনা নাগাড়ে ঘটতে থাকলে ধরে নেওয়া হয়, রোগী 'অস্টিওপোরোসিসে' আক্রান্ত হয়েছেন।
সাধারণত অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্তদের মধ্যে মহিলারাই বেশি থাকেন। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষরাও একইভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। চলতি জুন মাস বিশ্বে পুরুষ স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই উপলক্ষ্যে অস্টিওপোরোসিস নিয়ে দ্য ওয়ালকে বিশদে বললেন এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনোলজি অ্যান্ড রিউমাটোলজির ডিরেক্টর ডাঃ পার্থজিৎ দাস।
ডাঃ দাস বলেন, "অস্টিওপোরোসিসের গোড়ার কথা হল হাড়ের ঘনত্ব কমে আসা বা কম 'বোন মিনারেল ডেনসিটি' (বিএমডি)। যত বয়স বাড়ে, এই ঘনত্ব তত কমতে থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর পরিসংখ্যান বলছে, মেনোপজ পরবর্তী প্রায় ৩০ শতাংশ মহিলা অস্টিপোরোসিসে আক্রান্ত হ'ন। যেহেতু মহিলাদের মধ্যেই এর প্রাধান্য বেশি, তাই অনেকদিন অবধি মনে করা হত এটি বোধ করি শুধু মেয়েদেরই হয়। কিন্তু সারা পৃথিবীর অন্তত ১২ শতাংশ পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। ভারতের কথাই যদি ধরি, প্রায় ৬১ মিলিয়ন অস্টিওপোরোসিস রোগী রয়েছেন এদেশে, যার আবার ২০ শতাংশ পুরুষ।"
অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক রোগলক্ষণ হল হাড় ভাঙা। বস্তুত, হাড় ভাঙার ঘটনা না ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্টিওপোরোসিস বলে ধরাই যায় না। ৫০ বছর বয়স হয়ে গেলে অস্টিওপোরোসিসে হাড় ভাঙার ঝুঁকি মেয়েদের মধ্যে ৫০ শতাংশ, তুলনায় পুরুষদের মধ্যে তা ২০ শতাংশ। তবে পুরুষদের মধ্যেই এই ধরণের হাড় ভাঙা থেকে মারাত্মক অবস্থার ঝুঁকি বেশি থাকে। মৃত্যুর আশঙ্কাও পুরুষদের মধ্যে বেশি থাকে বলে জানালেন ডাঃ দাস। বললেন, "পশ্চিমী দুনিয়ার চাইতে ভারতে অস্টিপোরোসিস আক্রান্তের বয়স প্রায় ১০ থেকে ২০ বছর কম থাকে। যেভাবে বয়সজনিত কারণে ভারতীয় জনসংখ্যার মধ্যে হাড়ের ঘনত্ব কমছে, তাতে অস্টিওপোরোসিস রোগীর সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। বাড়বে খরচের ধাক্কা, প্রাণহানির আশঙ্কা। আমাদের এখনই সাবধান হওয়া উচিত। মনে রাখবেন, পুরুষদের কিন্তু অস্টিওপোরোসিসের আশঙ্কা কম করা হয়, ফলে হলেও অনেকদিন অবধি কেউ বুঝতেই পারেন না।"
কিন্তু কীভাবে ধরা যায় অস্টিওপোরোসিস? ডাঃ দাস বললেন, "অস্টিওপোরোসিসের জন্য প্রথমেই দরকার 'ডেক্সা স্ক্যান' বা 'বোন ডেনসিটি টেস্ট', যাতে করে হাড়ের ঘনত্ব মাপা যায়। এই স্ক্যানে এক্স রশ্মি চালিয়ে দেখা হয়, রোগীর হাড়ে ক্যালশিয়াম বা অন্যান্য খনিজ পদার্থের মাত্রা কীরকম আছে। সেই বুঝে হাড়ের ক্ষমতা আমরা বুঝতে পারি।"
অস্টিপোরোসিসের ঝুঁকি নানাভাবে বাড়তে পারে। যা নিয়ে আগাম সতর্ক করলেন ডাঃ দাস। বললেন, "স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের বেশি ব্যবহার, খাবার অভ্যাসে গোলমাল, অ্যানোরেক্সিয়া (ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয় থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেওয়া) বা বুলিমিয়া (অত্যাধিক বা মাত্রাছাড়া খাদ্যগ্রহণ), ধূমপান, মদ্যপান, প্রদাহজনিত অসুস্থতা, হরমোনের অনিয়মিত থাকার সমস্যা ইত্যাদি নানা কারণে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। যদি আপনার এই রোগের ঝুঁকি বাড়ার লক্ষণ থাকে, এখন থেকেই হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে উদ্যোগী হওয়া উচিত। নিয়মিত শরীরচর্চা করা, পরিমিত সুষম আহার, জীবনযাত্রা ভাল রাখা এইসব কিছুই অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমাতে পারে। বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার দিকে জোর দেওয়া উচিত। দুগ্ধজাত খাবারে ক্যালসিয়াম বেশি থাকে। ফলে দুধ, চিজ, টক দইয়ের পাশাপাশি সবুজ শাকসব্জি, ব্রোকোলি, ফলের রস খাওয়া উচিত।"
এখন অস্টিওপোরোসিস মোকাবিলায় অনেক উন্নত ওষুধপত্র বেরিয়ে গিয়েছে। চাইলে নিয়মিত ট্যাবলেট খেয়ে বা সাপ্তাহিক বা ত্রৈমাসিক ইনজেকশনের মাধ্যমেও চিকিৎসা চালানো যায়। ডাঃ দাস বললেন, 'অল্পবয়সে এই রোগের লক্ষণ ধরা পড়া হল সবচাইতে ভাল। এতে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং কোনও বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই ওষুধের সাহায্যে হাড়ের অবস্থার উন্নতি করা যায়। যে কোনও প্রয়োজনে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।"