শেষ আপডেট: 31st March 2024 13:51
অমল সরকার
ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে শনিবার নতুন একটি তথ্য পেলাম। সুপ্রিম কোর্ট ওই বন্ডকে নিষিদ্ধ করার আগে ভারত সরকার স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে আরও ১০ হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাপার অনুমতি দিয়েছিল। বলাইবাহুল্য, এসবিআই সেই বন্ড আর ছাপেনি।
এসবিআই ওই বন্ড ছাপলে এতদিনে হয়তো আরও দশ হাজার কোটি টাকা রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে জমা হয়ে যেত। আগের হিসাবে ধরে চললে নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সিংহভাগ টাকা জমা হত পদ্ম শিবিরের অ্যাকাউন্টে।
এই দশ হাজার কোটি টাকা হাতছাড়া হওয়াতে নির্বাচনের জাঁকজমকে কোনওরকম খামতি হবে বলে মনে হয় না। ‘রাজনৈতিক দলগুলিকে ভূতে টাকা জোগায়’, এটা নিছক কথার কথা নয়। তারপরও ইলেক্টোরাল বন্ড বাতিল হওয়াকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। কারণ, সেটি ছিল আইন দ্বারা সুরক্ষিত একটি বেআইনি, অসাংবিধানিক ব্যবস্থা।
সেই ব্যবস্থার অবসান হওয়ায় অনেকেই সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে ধন্য ধন্য করছেন। বলাইবাহুল্য, আর পাঁচটি ক্ষেত্রের মতো এই ব্যাপারেও ক্যাপ্টেন অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির ভূয়সী প্রশংসাই বেশি শোনা যাচ্ছে। একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকে দেখলাম, ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে লেখা নিবন্ধে বহু শব্দ সুপ্রিম কোর্টের প্রশংসা করতে ব্যয় করা হয়েছে।
আদালতের ভূমিকা নিয়ে অবশ্য দু-ধরনের অভিমত আছে। অনেকে বলে থাকেন, ‘তবু রক্ষা, আদালত আছে। কোর্ট না থাকলে কী যে হত!’ তারা এমনও বলে থাকেন, ‘কেউ না পারুক, আদালত মোদীর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’
আর এক দলের বক্তব্য, ‘দেশে আইন-আদালত বলে কিছু আছে নাকি! থাকলে নরেন্দ্র মোদীর মতো একটা লোক প্রধানমন্ত্রী, বিজেপির মতো দল সরকার চালাতে পারে?’
দ্বিতীয় কথাটি নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, সিএজি, মানবাধিকার কমিশন-সহ দেশের সব স্বশাসিত এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেই কম-বেশি সত্য।
আমি সাংবাদিক হয়েও এই তালিকায় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ সংবাদমাধ্যমের কথাও বলব। গণতন্ত্রের ধাত্রীভূমি ভারতে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের যে চূড়ান্ত অবনতি হয়েছে তাতে প্রথমসারির কর্পোরেট মিডিয়ার অনাচারের কথা না বললে পাঠকদের প্রতি অন্যায় করা হবে। অবশ্য সবাই সব বুঝতে পারছেন, দেখতে পারছেন। এসব কথা নিয়ে কপাল চাপড়ানোর অর্থ হয় না।
কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রশংসা নাকি নিন্দা প্রাপ্য, এই প্রশ্নের ফয়সালা হওয়া জরুরি। এই বন্ড চালু হয়েছিল ২০১৮ সালে। পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৯-এর গোড়ায় ছিল দেশে লোকসভা ভোট। সে বছর এপ্রিলে শীর্ষ আদালতে বন্ড ব্যবস্থাকে বাতিল করার আর্জি জানিয়ে মামলা হয়। আদালত আজব সব কারণ দেখিয়ে শুনানিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।
এমনও আর্জি জানানো হয়েছিল, ইলেক্টোরাল বন্ডের উপর সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করা হোক। তাও করেনি আদালত। এরপর প্রতি বছর দফায় দফায় ওই মামলা নিয়ে দরবার করা হয়। কিন্তু শীর্ষ আদালত কখনই মামলাটিকে সিরিয়াসলি নেয়নি। অন্তত তিনজন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তুমুল অনীহা দেখিয়েছেন মামলাটি শুনতে। ২০২৪-এ এসে বর্তমান প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সেই বন্ডকে বেআইনি এবং অসাংবিধানিক বলেছে।
প্রশ্ন হল, এই বেআইনি ব্যবস্থা চলতে দেওয়ার দায় কি আদালতেরও নয়? বহু নাগরিক মনে করেন, আদালত তৎক্ষণাৎ তৎপর হলে বন্ড থেকে বিপুল অর্থ রাজনৈতিক দলগুলির কোষাগারে জমা হত না। সব মিলিয়ে বিজেপি একাই প্রায় আট হাজার কোটি টাকা পেয়েছে, যা বন্ড বাবদ জমা হওয়া মোট অর্থের অর্ধেকের সামান্য কম।
সুপ্রিম কোর্টের বিচার কতটা জনস্বার্থবাহী, শীর্ষ আদালত কি সত্যিই নরেন্দ্র মোদীর রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে, আমার এই সব প্রশ্নের সপক্ষে আরও একটি জ্বলন্ত বিষয় হল সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। বিজেপি সরকার পাঁচ বছর আগে আইনটি তৈরিতে চিতা বাঘের গতিতে দৌড়েছিল। সেটি চালু করতে গিয়ে তারা কচ্ছপ বনে যায়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টও তাই। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে সিএএ-তে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেওয়ার পরই সেটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। অথচ চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় সেটি প্রথমবার আদালতে কয়েক ঘণ্টার জন্য শুনানি হয়েছে। পরবর্তী শুনানি ৯ এপ্রিল। চলতি মামলাটি সিএএ রুল সংক্রান্ত। কিন্তু আইনটির বিরোধিতা করে যে মামলা হয়েছে সেগুলির নিষ্পত্তি দূরের কথা, শুনানি পর্যন্ত হয়নি।
শুধু সিএএ নয়, প্রস্তাবিত জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি’র বিরোধিতা করে ২০১৫ সালে অসমের একটি মামলার একদিনের জন্যও শুনানি হয়নি। সিএএ-র বিরুদ্ধে কেরলের সিপিএম সরকার ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটির বিরুদ্ধেও মামলা করেছে। কারণ সেবারই প্রথম ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ কথাটি নাগরিকত্ব আইনে যুক্ত হয়।
আগ্রহীজনের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি সেবারই প্রথম আইনে বলা হয়, ২০০৪-এর ৩ ডিসেম্বরের পর ভারতে জন্ম নেওয়া যে কেউ নাগরিক হতে পারেন, যদি তাঁর মা-বাবার কেউ একজন ভারতীয় হন বা একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্যজন অবৈধ অভিবাসী না হন। অর্থাৎ মা-বাবার নাগরিকত্বের শর্তও জোড়া হয় সেবার। আজকের সিএএ নিয়ে বিপদের বীজ ছিল ২০০৩-এর আইনেই।
বিচার বিভাগের শিক্ষানবিশি আইনজীবীও জানেন, এই জাতীয় মামলার শুনানির জন্য সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন জরুরি। সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ তারপরও সে পথে না হেঁটে দায়ের হওয়া কুড়িটি মামলা সম্পর্কে ভারত সরকারের জবাব তলব করেছে। ফলে মামলার নিষ্পত্তি যেদিনই হোক, তার আগে সিএএ নিয়ে ভোটের ময়দানে রাজনীতির সওদা যা করার করা হয়ে যাবে। স্বভাবতই বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আসা যাক, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাদানকারী সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিলের প্রসঙ্গে। সেই মামলায় গত বছরের মাঝামাঝি সুপ্রিম কোর্ট সরকারের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছে। সেই রায়ই যদি এতদিন ফেলে না রেখে ২০১৯-এ মামলা হওয়ার পর পরই দিত তাহলে কাশ্মীরের মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা তুলনায় কম হত। কাশ্মীরের সাবেক তিন মুখ্যমন্ত্রীকে গৃহবন্দি করা, প্রতিবাদকারীদের মোকাবিলায় বল প্রয়োগে সীমা লঙ্ঘন সর্বোপরি দিনের পর দিন ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখে জানার অধিকার হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। আদালত হাত গুটিয়ে থেকেছে।
বিশেষ করে এ রাজ্যের বাসিন্দা যারা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষকে দেখেছেন যিনি হাজার হাজার চাকরি প্রার্থীকে পথে বসিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন ভোটের ময়দানে গা ভাসিয়ে। তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে আমি বছর দেড়েক আগেই শিক্ষা দুর্নীতির মামলার পরিণতি নিয়ে বলেছিলাম, ‘খবরে বিচারপতি, কবরে বিচার।’ পরিস্থিতিটা এখন তার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা উমর খলিদ ও অন্যান্যরা সেই ২০২০ থেকে দেশদ্রোহিতার মামলায় জেল বন্দি। উমরের জামিনের আবেদনের শুনানি ১৩ বার স্থগিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে দু-বছরের মাথায় তিনি আবেদন প্রত্যাহার করে নেন।
ভিমা কোরেগাঁও ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন বন্দিদের বিচারের শুনানি প্রায় বিরল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ‘জাস্টিস ডিলেড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড’-এর এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। হালের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত সংবাদমাধ্যম নিউজক্লিকের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্ত প্রমুখকে প্রায় ছয় মাস বিনাবিচারে আটকে রেখে শনিবার চার্জশিট জমা করেছে দিল্লি পুলিশ।
মনে রাখা প্রয়োজন, হাল আমলে শীর্ষ আদালতের একাধিক বিচারপতির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক অনেক দূর গড়িয়েছে। অযোধ্যা ও রাফাল মামলায় ক্ষমতাসীনদের খুশি হওয়ার মতো রায় ঘোষণার অব্যবহিত পরেই তখনকার প্রধান বিচারপতি রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন। কেউ হয়েছেন রাজ্যপাল, লোকপাল, বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান। এ প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ভূতপূর্ব হাই-প্রোফাইল আইনমন্ত্রী প্রয়াত, অরুণ জেটলির মন্তব্যটি স্মরণযোগ্য। জেটলি বলেছিলেন, ‘অনেক সময়েই অবসর-পরবর্তী নিয়োগের সুবিধার স্বার্থে রায় দেন অনেক বিচারপতি।’ তাই বিচারপতিদের অবসর পরবর্তী নিয়োগের আগে অন্তত দু’বছর কুলিং পিরিয়ডের কথাও বলেছিলেন জেটলি। সে কথায় অবশ্য তাঁর নিজের দলই পাত্তা দেয়নি!
সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সুপারিশ উপেক্ষা করে পছন্দের বিচারপতিদের নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার বিচার ব্যবস্থায় ক্রমাগত অন্তর্ঘাত করে গেলেও শীর্ষ আদালতের ‘ক্যাপ্টেন’কে পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। ক্ষমতাসীনদের সুবিধায় বেঞ্চ ফিক্সিংয়ের মারাত্মক অভিযোগ তুলে ২০১৮-র জানুয়ারিতে এমনকী চার বিচারপতি প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত করেছিলেন। ফলে শেষ ভরসার আদালত যে কতটা ঠিকঠাক চলতে পারেছ, সে নিয়ে প্রশ্ন দিনকে দিন গভীর হচ্ছে।
ফলে আদালতকে দেবতা, শেষ ভরসা ইত্যাদি ভাবাটা নিছকই একপেশে স্বার্থপরতায় ভরা ভাবনা। রাম মন্দির মামলার রায় শোনার পর থেকে আজও সেই প্রশ্নটির জবাব পাইনি, অযোধ্যার ওই বিতর্কিত ভূখণ্ডে বাবরি মসজিদ অক্ষত থাকলে মন্দির-মসজিদ জমি বিবাদ মামলায় কী রায় দিত। তারা কি রামের জন্মস্থান থেকে বাবরি মসজিদ সরিয়ে নিতে বা ভেঙে ফেলতে বলত?
সেই মামলায় পাঁচ বিচারপতির একজন ছিলেন আজকের প্রধান বিচারপতি। দেখা যাচ্ছে, তাঁর সময়ে বারাণসীর জ্ঞানবাপী, মথুরার শাহি ইদগা মসজিদ নিয়ে বিবাদ মামলা যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে আদালত হয়তো প্রাচীন এই সৌধগুলির সঙ্গে বেআইনি ফ্ল্যাট, আবাসনের ফারাক করবে না।