শেষ আপডেট: 10th April 2024 12:06
অমল সরকার
‘ইয়ে মোদী কী গ্যারান্টি হ্যায়’, সভার পর সভায় বলছেন নরেন্দ্র মোদী। নির্বাচনী ময়দানকে ‘বাজার’ ধরে নিলে বলতে হয় বিকিকিনির হাটে মোদীই সবচেয়ে সক্রিয় ও সরব সেলসম্যান। নিজের পণ্য অর্থাৎ কথা গিলোতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। ‘ইয়ে মোদী কী…..’ শুনে মনে হয়, আরাধ্য রামকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
লোকটি অসম সাহসী নাকি বোকা, নাকি আমরা নাগরিকেরাই গণ্ডমুর্খ, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু অবাক হতেই হয় যে বিদেশে কালো টাকা ফিরিয়ে এনে মাথাপিছু দেশবাসীকে ১৫ লাখ করে দেওয়া, কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা, বছরে দু কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, ইত্যাদি নানাবিধ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত মানুষটিই কিনা ভোটের বাজারে স্বঘোষিত গ্যারান্টার।
১০-১১ বছর আগে ফিরে যাই। ২০১৩। নরেন্দ্র মোদী তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। পরের বছর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে সভার পর সভায় বলে চলেছেন, ‘কী বিচিত্র এই দেশ। একটা লুলা, ল্যাংড়া, খোড়া সরকার চলছে। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী মৌনী। মুখে রা কাড়েন না। কারণ সরকারটা চলছে রিমোট কন্ট্রোলে।’
ওদিকে, সংসদে সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো বিজেপির প্রথমসারির নেতারা উচ্চগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘দেশের আর কত ক্ষতি করবেন আপনি? মানুষের আস্থার মর্যাদা দেন না। আমরাও আপনাকে মর্যাদা দেব না।’
একদিন অধিবেশনে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে সুষমা কবিতার লাইন ধার করে বললেন, ‘আপনি নিজেই নিশ্চই আপনার কিছু কৃতকর্ম ভূলে যেতে চাইবেন। আমরাও আপনার অনেক কাজ মনে রাখতে চাই না।’
সেদিনের সেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকের চোখেই ছিল বিরল। কারণ, চটজলদি প্রতিক্রিয়া না দেওয়াটাই ছিল তাঁর স্বভাব। প্রতি আক্রমণ, ব্যক্তিগত আক্রমণ তাঁর অভিধানে নেই। এমনকী নির্বাচনী ভাষণেও নয়।
নইলে নরেন্দ্র মোদীকে ‘মৌত কি সদাগর’ কথাটা সনিয়া গান্ধীর বদলে মনমোহন সিংহ বললেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বলতেই পারতেন, ৫৬ ইঞ্চি ছাতি দিয়ে কী হবে যদি না মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে দাঙ্গা আটকাতে পারেন?
সে পথে তো হাঁটেননি, বরং, সেই দাঙ্গার কারণে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে মার্কিন সরকার ভিসা দিতে অস্বীকার করায় হোয়াইট হাউসে কড়া চিঠি পাঠিয়েছিল মনমোহনের বিদেশমন্ত্রক।
মোদী তাঁর বিরোধী শিবিরের মানুষ। তিনি তো বলবেনই। ঘরের লোক, ছেলের বয়সি রাহুল গান্ধী মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে অখুশি হয়ে মুখের উপর ফাইল ছুড়ে ফেলে দিলেও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ক্ষোভ, রাগ প্রকাশ করেননি। সরকারি সিদ্ধান্তে সনিয়া গান্ধীর পরামর্শ এবং হস্তক্ষেপ, দুই-ই সামলেছেন সমান মেজাজে। ফলে তিনি যে দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ এবং গান্ধী পরিবারের একটু বেশিই অনুগত থাকার চেষ্টা করেছেন, এই অভিযোগ সহজেই মান্যতা পেয়ে গিয়েছে।
মোদী, সুষমাদের আক্রমণ, সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি ইত্যাদি নিয়ে অনেক পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় মনমোহন বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আজ সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধীরা আমাকে যেভাবে মূল্যায়ন করছে, ভবিষ্যতে সে জন্য তাঁদেরই ভুল স্বীকার করতে হবে।’
একটা ভুল তো মনমোহন তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই প্রমাণ করেছেন; ভাল কাজ এবং সাহসী পদক্ষেপের জন্য বুকের ছাতি চওড়া হওয়া, গলা চড়িয়ে কথা বলা পূর্বশর্ত নয়। তাঁর আগে ও পরে যে ১৩ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য যদি এক, দুই, তিন হিসাবে যাদের বেছে নিতে হবে, তাঁদের মধ্যে প্রথম নামটি ইন্দিরা গান্ধী, দ্বিতীয় নামটি নরসিংহ রাও এবং তৃতীয়জন মনমোহন সিং।
প্রথম দু’জন প্রয়াত। তৃতীয়জন মনমোহন গত ৩ এপ্রিল সংসদীয় রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেন। তিন দশকের কিছু বেশি সময় রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। এমন একটা সময় মনমোহন সংসদীয় রাজনীতি থেকে অবসরে গেলেন, যখন ভোটের ময়দানে কু-কথার বন্যা বইছে, সীমা হারিয়েছে ব্যক্তিগত আক্রমণ। অন্যদিকে, একটা লোক নিজেকে অচ্ছে দিনের ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর এখন নিজেকে বিকশিত ভারতের গ্যারান্টার বলে প্রচার করছেন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে সমকালীন রাজনীতিতে যাঁকে টেক্কা দেওয়ার কেউ নেই।
ইন্দিরা হাজারো বাধা পেরিয়ে ব্যাঙ্ক, বিমা, খনিজ সম্পদের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি মজবুত করার পথে দেশকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে দু-টুকরো ভারত বিরোধিতার কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন দেশের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী।
আবার সময়ের দাবি মেনে উল্টো পথ ধরেছিলেন নরসিংহ রাও। যাঁর সারথি ছিলেন মনমোহন। নেহেরু-ইন্দিরার আর্থিক ভাবনার উল্টোপথে দেশকে এগিয়ে দেওয়া সেই আর্থিক নীতির পোশাকি নাম ছিল ‘মনমোহনী অর্থনীতি’ যে শব্দবন্ধের সঙ্গে বিদ্রুপ ও প্রশংসা দুই-ই জড়িয়ে ছিল।
আর নিজে দু’দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সেই মনমোহনই খাদ্য, শিক্ষা এবং দরিদ্রের কর্মসংস্থানের ভার পুরোপুরি রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে নেন। দেশের ১৩ তম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ১৩ বছর আগে দেশের আর্থিক পরিস্থিতির এক সংকটজনক মুহূর্তে অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি, ভালোমানুষি করে কাজ হবে না, রাজনীতিক নরসিংহর মাথায় সেই অপ্রিয় সত্যটি গেঁথে দিয়েছিলেন অর্থনীতির পণ্ডিত মনমোহনই।
১৯৯১-এর ২৪ জুলাই নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী মনমোহনের বাজেট ভাষণে নতুন কথা ছিল তিনটি—বিলগ্নিকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন। এক কথায় উদারীকরণ।
অর্থনীতির অভিমূখ বদলের সেই পথ ধরেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় নতুন ভারত। অবসান হয় সরকারি লাইসেন্সরাজ, ইন্সপেক্টররাজ আর কথায় কথায় হুকুমদারীর। অনেকে যে কারণে বলে থাকেন, ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট ভারত ব্রিটিশের কবলমুক্ত হয়েছিল আর ১৯৯১-এর ২৪ জুলাই দেশ মুক্ত হয়েছিল আইনকানুনের বেড়াজাল থেকে।
নরসিংহ রাওয়ের সরকার পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। তাতে উদার অর্থনীতির দায়ই বেশি ছিল সন্দেহ নেই। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছিলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী সরকারি বা জন-প্রতিষ্ঠানগুলিতে দুর্নীতি আমদানি করেছিলেন। আর নরসিংহ রাও দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন।’ যদিও শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পথঘাট-টেলিযোগাযোগ-রেল-বিমানে ভারতবর্ষ নতুন রূপ পেতে শুরু করে ওই পাঁচ বছরেই।
১৯৯১-থেকে ১৯৯৬, দেশের অর্থমন্ত্রী হিসাবে যেমন নানা সংস্কারের কান্ডারি ছিলেন, তেমনই ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসাবেও দেশবাসীকে নব ভারত উপহার দিয়েছেন মননোহন সিং। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, তথ্যের অধিকার আইন চালু করেছেন। দ্বিতীয় দফায় চালু করেন শিক্ষার অধিকার এবং খাদ্য সুরক্ষা আইন। যার সুবাদে রেশনে সস্তায় কিংবা বিনামূল্যে চাল-গম মেলে, সব শিশুর ক্লাস এইট পর্যন্ত নিখরচায় শিক্ষা নিশ্চিত হয়। তথ্যের অধিকার আইন বলে সরকারের বহু তথাকথিত গোপন তথ্য আমরা আজ জানতে পারছি। বাতিল হল ব্রিটিশ আমলের জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণের কালা আইন।
বর্তমানের সঙ্গে পূর্বসূরির ফারাক হল, প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও মনমোহনের দেওয়া গ্যারান্টিগুলি আজও দেশবাসী ভোগ করছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের মতো কর্মসংস্থানের এমন সাংবিধানিক অধিকার প্রদান গোটা পৃথিবীতে বিরল। করোনাকালে দেশবাসী বুঝেছে, একশো দিনের প্রকল্পটি না থাকলে মহামারীর চেয়েও বেশি মানুষ মানুষ মারা যেতেন অনাহারে, অর্ধাহারে।
নরেন্দ্র মোদী হয়তো সেই কারণেই একশো দিনের প্রকল্পকেই সবচেয়ে হেলাফেলা, অবজ্ঞা করেছেন। ‘পুতুল প্রধানমন্ত্রী’ শব্দবন্ধে বারে বারে বিদ্ধ করেছেন উত্তরসূরিকে। মনমোহন রা কাড়েননি। এক সাক্ষাৎকারে খানিক রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘অনেকে বলেন, আমি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার। তাঁরা জানেন না, আমার অর্থমন্ত্রী হওয়াও ছিল অ্যাক্সিডেন্টাল। শপথের দিন নরসিংহ রাওজি আমাকে দেখে বললেন, তুমি এখনও পোশাক বদলাওনি। তাড়াতাড়ি করো। তোমাকেও শপথ নিতে হবে।’
একথা ঠিক, ব্যক্তিগতভাবে একটি টাকাও অনিয়মের অভিযোগ না থাকা মনমোহনের সময়েই সরকারি দুর্নীতি মাত্রা ছাড়ায়। আবার কয়লা, টেলিকমের মতো সব দুর্নীতিই পরবর্তীকালে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। যদিও ২০১৪-তে ইউপিএ সরকারের কার্যকাল এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহনের ভূমিকাকেই হাতিয়ার করেন নরেন্দ্র মোদী। দুর্নীতিমুক্ত ভারত গ়ড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাসীন হন ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা মোদী। কিন্তু পূর্বসূরির ‘জেন্টলম্যান প্রাইম মিনিস্টার’ তকমাটা কেড়ে নিতে পারেনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
তবে মনমোহনের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কারণ অবশ্যই তাঁর দল কংগ্রেস। মোদী যখন ‘গ্যারান্টি’ শব্দটি দিয়ে বাজার মাৎ করছেন, তখন কংগ্রেস দাবি করল না শব্দটি কপিরাইট মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের। মোদী, মনমোহন কেউই আজীবন থাকবেন না। কিন্তু মোদীর দশ বছর প্রমাণ করল, মনমোহনের গ্যারান্টি কালোত্তীর্ণ।