বাঁ দিক থেকে: টিভি সোমনাথন, শক্তিকান্ত দাস, তুহিনকান্ত পাণ্ডে, এস জয়শঙ্কর।
শেষ আপডেট: 21st July 2024 19:59
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সরকারিভাবে, শিক্ষাগত যোগ্যতা কেবলমাত্র স্নাতক। সাম্মানিক (অনার্স) থাকাও বাধ্যতামূলক নয়। সাধারণ স্নাতক হলেই চলে। ব্যাস। তাহলেই আপনি দেশের (অনেকে বলেন, পৃথিবীর) কঠিনতম পরীক্ষাটিতে বসার উপযুক্ত। কিন্তু তারপর পেরোতে হবে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার! প্রিলিমিনারিটুকু টপকানোই অনেক। তারপর আছে মেনসের লম্বা যুদ্ধ। তারপর ইন্টারভিউ। তিনটি মোক্ষম বাধা টপকালে তবেই 'ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস'-সহ ভারতের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের তেইশটি শাখার একটিতে পা রাখতে পারবেন।
এই বিখ্যাত এবং কুখ্যাত পরীক্ষার জন্ম ব্রিটিশ আমলে। সমালোচকরা অনেকেই বলেন, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে বলবৎ রাখতে তৈরি এই সার্ভিস আদতে একটি কল্যাণকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়। দরকার আমূল সংস্কার। কিন্তু যে কারণেই হোক, সত্তর বছরে অন্তত ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে সংস্কার আনার কাজ আর কেউ করে উঠতে পারেননি। প্রতি বছর প্রায় দশ থেকে পনেরো লক্ষ্য ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দেন। দিল্লির একাধিক স্বনামধন্য ইনস্টিটিউটে চলে প্রস্তুতি। ব্যয় হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। সবচেয়ে বড় কথা, এখনও এই চাকরির নূন্যতম যোগ্যতা কেবলমাত্র স্নাতক এবং চাকরি পেলে, স্রেফ একটি স্নাতক ডিগ্রি থেকেই কেউ পৌঁছে যেতে পারেন দেশের কেন্দ্রীয় অর্থসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, বিদেশসচিব, বাণিজ্যসচিব বা কৃষিসচিবের মত মহাগুরুত্বপূর্ণ পদে। যে পদে বসার জন্য অন্তত বিশেষজ্ঞ না হলে চলে না।
কিন্তু, স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে, এবার তাতে একটা বদল আনার কথা ভাবছে মোদী সরকার।
সরকারিভাবে অবশ্য কোনও ঘোষণা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই একটা বদল চোখে আসছে সরকারি আমলাদের। দেখা যাচ্ছে, হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে সচিব পদে সেই সব আমলাদের আনা হচ্ছে, যারা আদতে সেই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। যেমন ধরা যাক, অর্থমন্ত্রকে। মোট ছয়জন শীর্ষ সচিব আছেন। যাদের চারজনই আদতে ডাকসাইটে অর্থনীতির ছাত্র। রীতিমত ডক্টরেট। যেমন ধরা যাক অর্থসচিব টিভি সোমনাথন, তিনি অর্থনীতিতে পিএইচডি। অর্থবিষয়ক দফতরের সচিব অজয় শেঠ ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রিধারী। বিনিয়োগ ও জনসম্পদ বন্টন (দীপম) দফতরের সচিব তুহিনকান্ত পাণ্ডের অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি আছে। আর্থিক পরিষেবা দফতরের সচিব বিবেক জোশীর কার্যত আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ডক্টরেট।
আগেও এটা ছিল। কিন্তু এতটা নয়। মোদী সরকারের প্রথমদিকে রাজস্ব দফতরের সচিব ছিলেন শক্তিকান্ত দাস। পরে অর্থবিষয়ক দফতরে সচিব হ'ন। বহু গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পদক্ষেপ হয়েছে তাঁর অধীনে। পুরস্কারস্বরূপ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের দায়িত্বে এখন রয়েছেন তিনি। অথচ ওড়িশার এই আইএএস অফিসার আদতে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে পড়েছেন। বর্তমান বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রিও তেমনই ইতিহাসের স্নাতক।
সবচেয়ে বড় কথা, এই মুহূর্তে মোদী সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের মধ্যেও দু'জন যাকে বলে নিজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ঘটনাচক্রে, দুজনেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। একজন, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ। তামিলনাড়ুর ত্রিচিতে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর জেএনইউ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও এমফিল করেন নির্মলা। পরে পিএইচডি শুরু করেছিলেন। শেষ অবধি হয়ে ওঠেনি। অপরজন, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুটা হয়েছিল রসায়নে। পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে জেএনইউ থেকে স্নাতকোত্তর করার পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পিএইচডি করেন তিনি। ১৯৭৭ সালে যোগ দেন ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে।
বস্তুত, নির্মলার আগে অর্থমন্ত্রী পদে অর্থনীতিবিদ মন্ত্রী বসার চল তেমন ছিল না। যদিও অর্থনীতির কৃতি ছাত্র কেউ কেউ বসেছেন। নির্মলার আগের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি যেমন আদতে কমার্স নিয়ে পড়লেও পরে পুরোপুরিভাবে আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পি চিদম্বরমও তাই। রাশিবিজ্ঞান ও হার্ভার্ড থেকে এমবিএ থাকলেও পেশাগতভাবে ছিলেন আইনজীবী। প্রণব মুখোপাধ্যায়ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পরে আইনে স্নাতক ছিলেন। তার আগে অর্থমন্ত্রী ছিলেন যশবন্ত সিংহ। সেনাবাহিনীর বিখ্যাত ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির ছাত্র। অপর এক যশবন্ত সিনহা ছিলেন আইএএস অফিসার, তার আগে ইতিহাসের ছাত্র। সেই অর্থে, নির্মলার আগে শেষবার অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী ছিলেন নয়ের দশকে, ডক্টর মনমোহন সিংহ।
যদিও আমলাদের অনেকেই বলছেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে সচিব পদের সম্পর্ক নেই। সেখানে কাজের অভিজ্ঞতাটাই আসল। কিন্তু তারপরেও, নিঃসন্দেহে, বিশেষজ্ঞ কেউ থাকলে তাতে কাজে নিশ্চিতভাবেই কিছু গতি আসে। মোদী সরকারও সেদিকেই নজর দিতে চাইছে।