ওয়াশিংটনে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন কমলা হ্যারিস।
শেষ আপডেট: 26th July 2024 18:34
কেমন হতে পারেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিস? ওয়াশিংটন সফরে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেলেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
ইজরায়েল-গাজা যুদ্ধের আবহে আমেরিকায় এসেছেন নেতানিয়াহু। মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেই পরিচিত নেতানিয়াহু। আমেরিকায় বিস্তর সুহৃদ আছে তাঁর। অথচ সেই সময় কংগ্রেসে হাজিরই থাকলেন না কমলা। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে চলে গেলেন ইন্ডিয়ানায়। কিন্তু ফিরে এসে সটান বৈঠকে বসলেন 'বিবি'র সঙ্গে। সেখানেই কার্যত চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিলেন, রাষ্ট্রপতি হলে তাঁর বিদেশনীতি কী হবে, এখন থেকেই তা ভেবে রেখেছেন হ্যারিস।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ধরাবাঁধা মার্কিন ধাঁচেই প্রথমে ইজরায়েলের খানিক গুণগান করেন কমলা। ইজরায়েলের প্রতি আমেরিকা কতটা মনেপ্রাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেসবের খতিয়ান তুলে ধরেন। হামাসকেও 'জঘন্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠন' ইত্যাদি বলেন। শুধু তাই নয়। ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে কতজন মার্কিন নাগরিক মারা গিয়েছেন এবং কতজন এখনও হামাসের হাতে পণবন্দি আছেন, সেসবও নাম করে-করে তুলে ধরেন কমলা। ইজরায়েলের যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিরক্ষার অধিকার আছে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেও সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি।
কিন্তু তারপরেই শুরু হল, যাকে বলে, মার্কিন রাজনীতিতে 'কমলা-ঝড়'।
কমলা হ্যারিস জানালেন, প্যালেস্তাইনিদের ওপর অত্যাচারও তিনি মুখ বুজে দেখে যাওয়ার পাত্রী নন। তিনি যুদ্ধবিরতির সমর্থক। কমলার ভাষায়, 'গত নয় মাস ধরে গাজায় যা হচ্ছে, সেটা বিধ্বংসী। আমরা এই দুরবস্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারি না। আমরা নিশ্চুপ থাকতেও পারি না। আমি চুপ করে থাকবও না।' সঙ্গে যোগ করেন, 'যেভাবে মৃত শিশু ও ক্ষুধার্থ মানুষ গাজায় তৃতীয় বা চতুর্থবারের জন্য গৃহহীন হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, এটা চুপ করে বসে থাকার মত ব্যাপার?'
রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ইজরায়েল নিয়ে মাঝেমধ্যে নেতানিয়াহুকে ধমক-টমক দিলেও মোটের ওপর ইজরায়েলের প্রতি 'লৌহসদৃশ সমর্থন'-এর কথাই বার বার তুলে ধরেছেন। উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসও সেই কথার প্রতিধ্বনি করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত চার দিনে কার্যত উল্কার বেগে পাল্টেছে কমলার জগৎ। দ্বিতীয়বারের জন্য হোয়াইট হাউসের লড়াইতে নামা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বাইডেন। ওয়াশিংটনের পেনসিলভ্যানিয়া অ্যাভিনিয়ের ইঁটগুলোও জানে, এই অবস্থায় সবচেয়ে চওড়া রাস্তা কমলা হ্যারিসের সামনে খোলা। ইতিহাসের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, শেষ অবধি কি আমেরিকা পাবে দেশের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট?
ওয়াশিংটনের অন্দরে খবর, ইতিমধ্যেই জোরকদমে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন কমলা। ঠিক কতটা জোরদার, তারই ঝলক দেখা গেল সাংবাদিক বৈঠকে। ইজরায়েলের প্রতি তর্কাতীত সমর্থন থাকলেও, প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা যে অনেক বেশি সাবধানী পদক্ষেপ করবেন, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। বোঝা গেল, পশ্চিম এশিয়ার জটিল কূটনীতির অঙ্ক ইতিমধ্যেই রপ্ত করে ফেলেছেন হ্যারিস। বললেন, 'আপাতত এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধ থামানো। এমনভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, যাতে ইজরায়েল সুরক্ষিত থাকে, সমস্ত যুদ্ধবন্দি ছাড়া পায়, প্যালেস্তাইনিদের কষ্ট লাঘব হয় এবং প্যালেস্তাইনের মানুষ তাঁদের স্বাধীনতা, সম্মান ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরে পান।'
মার্কিন সাংবাদিকদের বক্তব্য, বাইডেনের চাইতে এখানেই নিজেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে রেখেছেন হ্যারিস। গত আট দশকের ইতিহাসে বারবার পশ্চিম এশিয়া উত্তাল হয়েছে। যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইজরায়েলের পাশে সব সময়, সব অবস্থাতেই দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা একবগগাভাবে ইজরায়েলকে সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছেন। বাইডেন কিছুদিন আগে নিজেকে 'জায়নবাদী' বা 'জিওনিস্ট' বলেও দাবি করেছেন। ঘোরতর ইজরায়েল-মুখী নীতি নিয়ে ঘরে-বাইরে রিপাবলিকানদের মোকাবিলা করেছেন। এতে হয়ত বাইডেনের মার্কিন রাজনীতিতে কিছু লাভ হয়েছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অগ্নিগর্ভ রাজনীতিতে এগুলো কেরোসিনের মত কাজ করে। এই তেঁতো বাস্তবটা কিছুটা হলেও বোঝেন কমলা। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাই চোরাস্রোতে নৌকো চালিয়েছেন তিনি। তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আমলা ও উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডিন লিবারমান যেমন বললেন, 'মাননীয়া উপরাষ্ট্রপতি ইহুদিদের গণতান্ত্রিক মাতৃভূমি হিসেবে ইজরায়েলের সুরক্ষার অত্যন্ত বড় সমর্থক। কিন্তু তিনি এটাও সমর্থন করেন, প্যালেস্তাইনি মানুষের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। এই দুইয়ে তিনি কোনও বিরোধ দেখেন না।'
এইখানেই মোক্ষম চাল দিয়ে নিজের স্বকীয়তা বুঝিয়েছেন কমলা। নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে সাংবাদিক বৈঠকের শেষে কমলা বলে যান, 'আমেরিকানদের এটা মনে রাখা উচিত, গাজা কিন্তু কোনও 'বাইনারি' (দ্বিমুখী) ইস্যু নয়। বাস্তব অনেক বেশি জটিল। আমি আমার প্রিয় আমেরিকানদের অনুরোধ করব, কিছু না হোক, অন্তত পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি ও ইতিহাসের জটিল অধ্যায়গুলো বোঝার চেষ্টা করুন। আমাদের উচিত, একইসঙ্গে অ্যান্টিসেমিটিজম, ইসলামোফোবিয়া ও সমস্ত রকম ঘৃণার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা।'
ঘটনাচক্রে, কমলার ব্যক্তিগত জীবনেও এই উদার মানসিকতার ছোঁয়া রয়েছে। তাঁর স্বামী, আমেরিকার 'সেকেন্ড জেন্টলম্যান' ডগলাস এমহফ আদতে ইহুদি। তাঁর প্রথম স্ত্রী কার্স্টিন ম্যাকিনের সঙ্গে তাঁর এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। তাঁদের মেয়ে এলা আবার নিজেকে গোঁড়া ইহুদি বলে স্বীকার করে না। প্যালেস্তাইনিদের সমর্থনেও অংশ নিতে দেখা গিয়েছে তাকে। সৎমায়ের সঙ্গে অবশ্য দুর্দান্ত সম্পর্ক এলার। ২০২০ সালে যখন উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন দিলেন কমলা, এলা লিখেছিল, 'আমার ও আমার ভাইয়ের কাছে তুমি সবসময় 'মোমালা'। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সৎমা। তুমিই আমাদের ভরসা। শুধু আমাদের বাবার জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য!'
সবচেয়ে বড় কথা, বাইডেন প্রশাসনে কমলাই প্রথম, যিনি হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধে সবার আগে যুদ্ধবিরতির কথা তুলেছিলেন। কলম্বিয়া, হার্ভার্ড-সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ইজরায়েল-বিরোধী প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছিল, আমেরিকার তাবড় আমলারা ছাত্রদের বিরুদ্ধে হেন কথা নেই, যা বলতে বাকি রেখেছিলেন! ব্যতিক্রম ছিলেন কমলা। বলেছিলেন, 'মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কিছুই করে। ওরাও সেটাই করছে। ওরা অনেক কিছুই বলছে, যা আমি একেবারে মানি না। ফলে ওদের সব কথা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই নেই। কিন্তু আমাদের তো বুঝেশুনে চলতে হবে। ওদের আবেগ আমি বুঝতে পারছি।'