বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে উচ্ছ্বসিত দ্রাবিড়।
শেষ আপডেট: 30th June 2024 16:39
ক্রিকেটাররা মাঠে খেলছেন আর গ্যালারিতে তাঁদের প্রিয়জনরা বসে, আজকাল এই দৃশ্য দেখে আর কেউ অবাক হবেন না। তারপরেও, ঋতিকা সজদেকে দেখে অবাক লাগে। বোধ হয় এমন একটা ম্যাচও মনে করা যাবে না, যেখানে রোহিত শর্মা মাঠে খেলছেন, অথচ গ্যালারিতে ঋতিকা নেই। রোহিত নিজেই মজা করে বলেন, তাঁর স্ত্রী যেভাবে সারাক্ষণ 'ফিঙ্গারস ক্রসড' করে থাকেন, তাতে কোনদিন না তাঁর আঙুলগুলোই ট্যারা হয়ে যায়! শুধু মাঠ নয়। মাঠের বাইরেও ভারত অধিনায়ক যেখানেই যান, সঙ্গে সবসময় থাকেন স্ত্রী ঋতিকা। অথচ তারপরেও প্রচারের আলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকেন তিনি। রোহিতের সঙ্গে গেলেও, সাধারণত এক পাশে চুপ করে বসে থাকতেই স্বচ্ছন্দ ঋতিকা। দেখে মনেই হয় না, আদতে এই ঋতিকাই পেশাদারভাবে রোহিতের ম্যানেজার; ভারত অধিনায়কের অডি, টিসট বা আদিদাসের মত তাবড় ব্র্যান্ডের এন্ডোর্সমেন্টের নেপথ্যেও নাকি আসলে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী।
রোহিত শর্মার দিকে গত কয়েকটা বছর ধরে তীরের মত ধেয়ে যাওয়া সমালোচনার আক্রমণও সামনে থেকে দেখেছেন ঋতিকা। আইসিসি ট্রফি শেষবার এসেছে ২০১৩ সালে। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ তার আগে ২০১১-তে। রোহিত সেবার দলেই ছিলেন না। টি২০ বিশ্বকাপ যখন ভারত শেষবার জিতেছে, রোহিত তখন সদ্য মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জিতে ডেবিউ করছেন। তারপর মুম্বই, নবি মুম্বইয়ের বন্দর থেকে বহু জাহাজ ছেড়ে গিয়েছে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি সরে গিয়েছেন। ভারতের দায়িত্ব এসেছে বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মার ঘাড়ে। দুই তর্কাতীত নক্ষত্র। একই দলে যেন লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। মেসি বিশ্বকাপ জিতেছেন। রোনাল্ডো ইউরো। অথচ একটাও আইসিসি ট্রফি ঢোকেনি ভারতে।
বিশ্বজয়ের পরে দৃশ্যগুলো কেমন দাগ কেটে যায় এখনও। হার্দিক পাণ্ডিয়ার হাতে শেষ ওভারের শেষ বল। ব্যাট করছেন আনরিখ নখিয়া। ম্যাচ ততক্ষণে বেরিয়ে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার হাত থেকে। কেনসিংটন ওভালে উল্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশ্বজয়ের থেকে মাত্র এক বল দূরে ভারত। বরফশীতল চোখে শেষ বল করতে দৌড়লেন হার্দিক। অসহায়ভাবে ডিপ মিডউইকেটের দিকে ঠেলে দিলেন নখিয়া। ইতিহাস! সাধারণত দেখা যায়, ডাগআউট থেকে ছুটে আসেন বাকিরা। মাঠে থাকা ক্রিকেটাররা স্টাম্প তুলে নিয়ে দৌড় লাগান সেদিকে। শুরু হয় উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস। অথচ কেনসিংটন ওভালে সেসব কিছুই হল না। দেখা গেল, বিরাট কোহলি সজল চোখে তাকিয়ে আকাশটা ঠাহর করার চেষ্টা করছেন। রোহিত শর্মা মাঠে হাত চাপড়ালেন। আর অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন শেষ ওভারের হিরো হার্দিক। আবেগ বাঁধ মানেনি গ্যালারিতে, এমনকি টিভি ক্যামেরার সঞ্চালকদের মাঝেও।
শুধু কি একটা ট্রফি জয়? মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিরাট-রোহিতদের সামনে ঝোলানো হচ্ছিল দিস্তা দিস্তা প্রশ্ন! তোতাকাহিনীর পাখিটাকে যেভাবে কাগজ গেলানো হয়েছিল, প্রায় ওইভাবেই প্রশ্ন গেলানো হয়েছিল তাঁদের। দিয়ে ঘিরে রেখেছিল কে নেই তাতে? সমর্থক আছেন। বোর্ড কর্তারা আছেন। সাংবাদিকরা আছেন। আর কদ্দিন? আর কদ্দিন হাপিত্যেশ করে থাকতে হবে একটা ট্রফির জন্য? আর কবে একটা ট্রফি আসবে ভারতে? আরে, শুধু ভাল খেলে গেলে চলবে? সেমিফাইনাল-ফাইনালে হেরে বসলে আর ভাল খেলার মানেটা কী রইল?
রোহিত-সূর্যকুমার যাদব-অক্ষর প্যাটেল-যশপ্রীত বুমরাহরা যখন নিউ ইয়র্কের বিমানে উঠছেন, দেশে তখনও পুরোদমে চলছে আইপিএল মহোৎসব। সেমিফাইনাল, ফাইনাল বাকি। অথচ ফাইনালে ভারতীয় দলের একজনও নেই। রিঙ্কু সিংহ ছিলেন, কিন্তু বিশ্বকাপে রিজার্ভে জায়গা পেয়েছেন। রোহিত-হার্দিক-বুমরাহের মুম্বই ইন্ডিয়ান্স গোহারা হেরেছে। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন হার্দিক। ওয়াংখেড়ে, আহমেদাবাদ, যেখানেই খেলতে গিয়েছেন, সমর্থকদের টিটকিরির মুখে পড়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও নাকি তোলপাড় চলছিল হার্দিকের। জল্পনা ছড়িয়েছিল, বিবাহবিচ্ছেদ আসন্ন! হার্দিক অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। পুরো দল যখন নিউ ইয়র্কের বিমান ধরছে, হার্দিক কাকপক্ষীকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখান থেকে নিউ ইয়র্কে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
রাশি-রাশি প্রশ্নপত্র উড়ে গিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছিল হার্দিককে। শেষ বলের পরে ওই দরদর করে বেরিয়ে আসা অশ্রুতে বোধ হয় বেরিয়ে আসছিল তাঁর উত্তরগুলো। কাকে তিনি পাঠাবেন সেসব? ঠিকানা তো লেখা নেই। কেউ ঠিকানা দিয়ে যায়নি তাঁকে। টি২০ বিশ্বকাপের ট্রফি উঠতেই ম্যাজিকের মত যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছে প্রশ্নগুলো। আইপিএলে খেলতে পারেননি, সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু জবাব দিয়েছেন বিশ্বকাপে। রোহিত শর্মা (২৫৭), সূর্যকুমার যাদব (১৯৯), ঋষভ পন্থ (১৭১), বিরাট কোহলির (১৫১) পরেই ভারতের সর্বোচ্চ রানের তালিকায় রয়েছেন হার্দিক (১৪৪)। স্ট্রাইক রেট রোহিত বাদে বাকি সব্বার চাইতে বেশি। বল হাতেও দাপট দেখিয়েছেন অলরাউন্ডার হার্দিক। উইকেটের নিরিখে আরশদীপ সিংহ (১৭) ও যশপ্রীত বুমরা (১৫)-এর পরেই তৃতীয় স্থানে রয়েছেন হার্দিক (১১)।
বা যেমন, রাহুল দ্রাবিড়! ট্রফিটা হাতে পাওয়ার পরে যেভাবে হাত ঝাঁকিয়ে উচ্ছ্বাস দেখালেন, মনে হল ২০২৪ নয়, ট্রফি পেয়েছে ২০০৭ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ভারত অধিনায়ক। জীবনে তিনবার বিশ্বকাপ খেলেছেন রাহুল। ১৯৯৯ সালে সুপার সিক্স থেকে বিদায় নিতে হয় ভারতকে। ২০০৩-এর সেই বিশ্বকাপ ফাইনাল তো আজও বোধ হয় অনেকে স্পষ্ট মনে রেখেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২০০৭ বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকেই হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল অধিনায়ক দ্রাবিড়কে। ভাবা যায়? জীবনে কোনওদিন নেমেই প্রথম বলে আউট হ'ননি। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাঁর ঝুলিতে। অথচ বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল মুখ কালি করে। ১৯৯২ সালের পর ওই একবারই গ্রুপ থেকে বিদায় নিয়েছে ভারত। কোচিং কেরিয়ারেও সেই একই কথা। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে অনবদ্য ভারত! কিন্তু আইসিসি ট্রফি আর ঢোকে না।
আর অধিনায়ক রোহিত?
রাজার মত ঘোষণা করে দিলেন, আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেট থেকে এই শেষ তাঁর। বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গিয়েছে। ব্যাস! আর কুড়ি ওভারের খেলায় ভারতের জার্সি গায়ে নামছেন না তিনি। কীভাবে শেষ করলেন? সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। হিসেব করে বুমরাহ-অক্ষরকে ব্যবহার করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজয়রথকে থামালেন। নিজে শেষ করলেন টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার হিসেবে। তাঁর এবং ট্র্যাভিস হেডের রান, স্ট্রাইক রেট দুইই প্রায় পিঠোপিঠি। নিউ ইয়র্ক, ক্যারিবিয়ান দ্বীপের এই মাঠেও ১৫৬ স্ট্রাইক রেট নিয়ে শেষ করলেন রোহিত।
ক্লান্তি। অবসন্নতা। তৃপ্তি। সবকিছুকে ছাপিয়ে যেন একটাই কথা উঠে আসে তাঁদের অভিধানে। শান্তি। সবক'টি প্রশ্নের উত্তর শেষ করে, সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে হল থেকে বেরনোর শান্তি!