বিরাট ও রোহিত, আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেটের জয়-বীরু। (ফাইল চিত্র)
শেষ আপডেট: 29th June 2024 18:54
২০২২ কাতার বিশ্বকাপে কথাটা উঠেছিল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ও লুকা মড্রিচ। একজনের বয়স ছিল ৩৭। একজনের ৩৬। এবারেই কি তাহলে দুই মহাতারকার শেষ ঝলক দেখা যেতে চলেছে? একেবারেই ফর্মে ছিলেন না রোনাল্ডো। কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় পর্তুগালকে। কাঁদতে কাঁদতে রোনাল্ডোর মাঠ ছাড়ার সেই দৃশ্য এখনও ঘোরে সমাজমাধ্যমে। অন্যজন, লুকা মড্রিচ, কোয়ার্টারে হারিয়েছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে। শেষ অবধি সেমিফাইনালে আর্জেন্তিনার কাছে হারতে হয় ক্রোয়েশিয়াকে। বলা হয়েছিল, দেশের জার্সিতে শেষ বারের মত দেখে নেওয়া গেল বিশ্বফুটবলের দুই শিল্পীকে।
আজ, ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে, বার্বেডোজের ব্রিজটাউনে কি অনুরূপ কোনও বিদায়গাথা লেখা হবে ক্রিকেটদুনিয়ার দুই শিল্পীর জন্য?
বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা। একজন ধ্রুপদী মহাকাব্যের কোনও মহাকবি। প্রতিটি ইঞ্চি মেপে চলেন নিয়মের কড়া অনুশাসনে। ব্যাট হাতে তাঁর খেলায় ধরা দেন যেন রেমব্রান্ট বা ভার্মিয়ার। অপরজনের শরীরী ভাষা সারাক্ষণ রিল্যাক্সড। কথাবার্তায় একেবারে খাঁটি বোম্বাই ছাপ। কখনও আইপ্যাড ভুলে যান, কখনও পাসপোর্ট! ব্যাট হাতে মনে হবে, যেন ছবির দুনিয়ায় পাকাপাকি কোনও বদল আনতে চাইছেন শিল্পী। পিকাসো বা সালভাদর দালি। মাসখানেক আগে আইপিএল শেষ হয়েছে। কমলা টুপি মাথায় নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন বিরাট। অনবদ্য ধারাবাহিকতা। অনবদ্য ফর্ম। তুলনায় খানিক ম্রিয়মান ছিলেন 'শর্মাজি কা বেটা'। বিশ্বকাপে সেই খামতি পুষিয়ে দিয়েছেন। ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান তাঁর, সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট তাঁর, সবচেয়ে বেশি ছক্কা তাঁর, সবচেয়ে বেশি চারও আছড়ে পড়েছে তাঁর ব্যাট থেকেই।
রোহিতের বয়স ৩৭। কোহলির ৩৫। পরের পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ ২০২৭-এ। আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ে ও নামিবিয়া। ততদিনে রোহিত পৌঁছবেন ৪০, কোহলি ৩৮-এ। টি২০ বিশ্বকাপ অবশ্য দুই বছর অন্তর হয়। ২০২৬-এই ফের এই বিশ্বকাপ হবে ভারত ও শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই বোর্ডে 'নতুন প্রজন্ম' নিয়ে কথা উঠেছে। রোহিত-কোহলিদের পাকাপাকিভাবে হয়ত লাল বলে সরতে হতে পারে। বিভিন্ন কানাঘুষো যদি সত্যি হয়, গৌতম গম্ভীরও নাকি কোচ হবার ইন্টারভিউতে গিয়ে বলে দিয়েছেন, ২০২৫-এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শেষ পরীক্ষা হবে 'সিনিয়র'-দের। আগামী বছর যা হতে চলেছে পাকিস্তানে। ইতিমধ্যেই পিসিবি কর্তারা ঠিক করেছেন, ভারতের সব ম্যাচ ফেলা হবে লাহোরে। যাতে বেশি ঘোরাঘুরি করতে না হয়। ভারতীয় বোর্ডও এখনও অবধি বিশেষ আপত্তি করেনি। শেষ অবধি যদি দল যায়, তাহলে সতেরো বছর পর ভারতীয় ক্রিকেটাররা পা রাখতে চলেছেন পাকিস্তানে। গম্ভীর কোচ হলে সেখানে আশানুরূপ খেলতে না পারলে অন্য পথ ভাবতে হবে সিনিয়রদের। অন্তত যতীন পরাঞ্জবে, অশোক মালহোত্রদের কমিটির সামনে নাকি তেমনটাই বক্তব্য ছিল কলকাতা নাইট রাইডার্সের মেন্টরের।
এইরকম খাঁড়ার সামনে আজকের ফাইনাল সম্ভবত দুই ভারতীয় মহাতারকার জন্যও অগ্নিপরীক্ষা। সম্ভবত, কারণ এখনও অনেক যদি-কিন্তু রয়েছে। এখনও রোহিত-বিরাটকে বাদ দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দল ভাবা অকল্পনীয়। তাছাড়া বেশি বয়স অবধি খেলার নজির তো কম নেই! ফুটবলের কথাই ধরা যাক। কাতার বিশ্বকাপের পর ফের ইউরোর মঞ্চে দেখা গিয়েছে রোনাল্ডো-মড্রিচকে। ৩৯ বছরে মাঠে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিআর সেভেন। ৪১ বছরে তাঁর সঙ্গ দিচ্ছেন পর্তুগালের অপর বয়সহীন নায়ক পেপে। সেখানে ৪০ বছরে রোহিত বা ৩৮-এর বিরাট দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন না, এমন বলা যাবে কী করে? বিশেষ করে বিরাট যে কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলেন, তাতে তো এখনও অনেকখানি রাস্তা বাকি পড়ে রয়েছে তাঁর জন্য। এতে কি অজিত আগরকরদের নির্বাচক কমিটিরও কোনও সন্দেহ আছে?
নেতৃত্ব আরও একটা ফ্যাক্টর। ফুটবলে আর্মব্যান্ড কার হাতে বাঁধা থাকল, তাতে বিশেষ ফারাক পড়ে না। ক্রিকেটে পড়ে। অধিনায়ককে মাঠের মধ্যেই বিস্তর অঙ্ক কষতে হয়। আইপিএলে যেমন অধিনায়কত্ব নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। রাতারাতি রোহিত, বিরাট, মহেন্দ্র সিং ধোনিকে সরানো হয়েছে অধিনায়কত্ব থেকে। যার মধ্যে রোহিতের নেতৃত্ব সরানো নিয়েই সবচেয়ে বেশি কালি খরচ করেছে মিডিয়া। রাতারাতি গুজরাত থেকে হার্দিক পাণ্ডিয়াকে উড়িয়ে এনেছিল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স নেতৃত্ব। খুব একটা ভালোভাবে নেননি রোহিত। একসময় তো শোনা যাচ্ছিল, 'ক্ষুব্ধ' রোহিত নাকি পরের মরসুমে কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন মুম্বই হার্দিকের অধিনায়কত্বে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শেষে নিউ ইয়র্কের বিমানে ওঠার পর বিতর্কে খানিক জল পড়ে। বাকিটা করে দিয়েছেন রোহিত। এবারের বিশ্বকাপে অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে তাঁকে। সুচারুভাবে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নিজে রান করছেন। ডিন এলগার অবধি বলে দিচ্ছেন, আজ জিততে হলে শুরুতে রোহিতকে ফেরানো আর বিরাটের উইকেট নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই দক্ষিণ আফ্রিকার।
আন্তর্জাতিক টি২০-তে ৪২২২ রান আছে রোহিতের। স্ট্রাইক রেট ১৪০। সঙ্গে আছে ৫ শতরান। বিরাটের রান ৪১১২। স্ট্রাইক রেট ১৩৭। দলের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় রোহিত। শোনা যায়, যে কোনও জুনিয়র ক্রিকেটার যে কোনও প্রয়োজনে সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছে যেতে পারেন। সমর্থকদের মধ্যেও 'রোহিত ভাই'-কে নিয়ে ক্রেজ তুঙ্গে। বিমানবন্দরে, মাঠের বাইরে, হোটেলে, রেস্তোরাঁয়, অনুষ্ঠানে সর্বত্র ভক্তদের অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সামলান রোহিত। একেবারেই মেজাজ হারাতে দেখা যায় না। এই সবটাই ছাপ ফেলে তাঁর অধিনায়কত্বে। এই বিশ্বকাপ ফাইনালের পরে আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে হয়ত সরে যাবেন না কেউই। কিন্তু শেষ অবধি যদি কথা ওঠে, তাহলে হয়ত কঠিন সিদ্ধান্ত অপেক্ষা করবে তাঁদের জন্য।
শুধু দল ও দেশের জন্য তো বটেই, আজ ভারতীয় ক্রিকেটের দুই আধুনিক নায়কের জন্যও টি২০ বিশ্বকাপের ট্রফি পেতে মুখিয়ে থাকবে আসমুদ্রহিমাচল। ২০১১-তে যখন শেষবার পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ জেতে ভারত, বিরাট তখন উঠতি তারকা। দলে ছিলেন না রোহিত। তারপর এক যুগ কেটে গিয়েছে। ক্রিকেটকে বহু মণিমাণিক্যে ভরিয়ে দিয়েছেন দুই তারকা। কিছুদিন আগে ইউরোর মঞ্চে লুকা মড্রিচকে এক সাংবাদিক বলেছিলেন, 'তুমি আর যাই করো, কোনওদিন অবসর নিও না।' ইচ্ছে হয়, বিরাট-রোহিতকেও একই অনুরোধ করতে। আজ টি২০ বিশ্বকাপ জিতলে এই প্রজন্মের কচিকাঁচারা কলার তুলে বলতে পারবে, কপিল দেবের লর্ডসের ব্যালকনিতে ওঠা দেখিনি, সচিনকে কাঁধে নিয়ে ওয়াংখেড়েতে চক্কর কাটাও হয়ত খুব অল্পবয়সে দেখেছি। কিন্তু আমরা বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মাকে বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে দেখেছি!