তেরো বছরের ট্রফি খরা কাটিয়ে আজ বিশ্বজয়ের সামনে রোহিতরা। আজ শেষ পরীক্ষায় নামছেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়।
শেষ আপডেট: 29th June 2024 16:16
ক্রিকেট মাঠে সাধারণত অনেক রকমের 'ভিলেন' থাকে। এই ধরুন, দুই দল টস সেরে, প্যাড-গ্লাভস পরে, ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে নামবে বলে প্রস্তুত। হঠাৎ আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বরুণদেবের হাত থেকে পিচকে যা-ও বা চাপাচুপি দিয়ে রেহাই দেওয়া যায়, ফ্যাসাদে পড়ে যায় বেচারা আউটফিল্ড। এবারের টি২০ বিশ্বকাপেও দেদার ভুগিয়েছে বৃষ্টি। একের পর এক ম্যাচ বৃষ্টির জন্য বাতিল করে দিতে হয়েছে। ফাইনালের জন্যও অতএব আইসিসি রিজার্ভ দিন রেখেছে। আজ, শনিবার না হলে হবে আগামীকাল।
কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে বৃষ্টির চাইতেও যেন বড় বিড়ম্বনা হয়ে উঠেছে বিমানযাত্রা। জলবায়ু বাঁচাতে জার্মানিতে ইউরো কাপে ফুটবলারদের ট্রেনে-বাসে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলা হলে ছোট ছোট দ্বীপের মধ্যে বিমান ছাড়া গতি নেই। এদিকে অবস্থা এমনই যে, এয়ারপোর্টে ঢুকতে হলেও এখন দুরু-দুরু অবস্থা হচ্ছে ক্রিকেটারদের। এই দক্ষিণ আফ্রিকার কথাই ধরুন। ত্রিনিদাদের ব্রায়ান লারা অ্যাকাডেমিতে আফগানিস্তানকে সেমিফাইনালে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন আইডেন মার্করাম, রেজা হেন্ড্রিকসরা। পরেরদিন, বৃহস্পতিবার সকাল সকাল বার্বেডোজের ব্রিজটাউনের বিমান ধরবেন বলে ত্রিনিদাদের বিমানবন্দরে ঢুকেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শুধু ক্রিকেটাররা নন, রয়েছেন তাঁদের পরিবার, কমেন্ট্রি দল, আইসিসির কর্তা-সহ একঝাঁক হোমরাচোমরা লোকজন। অথচ খবর এল, বার্বেডোজের রাজধানী ব্রিজটাউনের গ্র্যান্টলি অ্যাডামস বিমানবন্দরের রানওয়েতে একটি প্রাইভেট জেট আটকে পড়ায় আপাতত উড়ান বন্ধ। বিমান যাবে বিকেল সাড়ে চারটেয়। প্রায় ছয় ঘণ্টা দেরিতে।
ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবার কোনও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে নামার আগে এরকম ভোগান্তি হলে একটু ভাবনায় পড়তে হয় বৈকি। অনেকে বলবেন, এ' আর এমন কী? উড়ানে দেরি তো হতেই পারে। কতই হয়। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, প্রোটিয়াদের ঝুঁকির পাল্লাটা বোধ হয় এতে আরও ঝুঁকে গেল। ফাইনাল হবে বার্বেডোজের রাজধানী ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভালে। পুঁচকে দ্বীপ, ততোধিক পুঁচকে শহর। অথচ চোখে লাগার মত সুন্দর, শান্ত। না বলে দিলে বিশ্বাস হবে না, এই শহরেই জন্ম বিশ্ববিখ্যাত পপ তারকা রিহানার। অথচ গোটা টুর্নামেন্টে একবারের জন্যও ব্রিজটাউনে পা রাখেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। গ্রুপের ম্যাচ খেলেছে নিউ ইয়র্কে। শেষ ম্যাচ খেলতে চলে আসতে হয়েছে সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রানাদিন্সে। সুপার এইটেও অ্যান্টিগা, সেন্ট লুসিয়ায় ঘুরতে হয়েছে তাদের। সেখানে ভারত এর আগে আফগানিস্তানকে খেলেছে ব্রিজটাউনে। যার ফলে কেনসিংটন ওভালের মাঠের অবস্থা নিয়ে অনেকটাই ভাল ধারণা রয়েছে রোহিতদের।
কতটা ফারাক গড়ে দেবে এটা? সরকারিভাবে কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না। ঘনিষ্ঠমহলে যদিও প্রোটিয়াদের অনেকেই বলেছেন, এরকম সফরসূচি থাকলে যে কোনও দলকে মুশকিলে পড়তে হতে পারে। এবারের বিশ্বকাপে পিচ নিয়ে যথেষ্ট হ্যাঙ্গামে পড়তে হয়েছে সবক'টি দলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিচ প্রায় নিজের মর্জিতে চলেছে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপের মাঠগুলোর অবস্থা তুলনায় অনেক ভাল। তবুও, মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছেই। ওটাতেই পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। বস্তুত, এই পার্থক্য যে কতটা ভয়ানক, তার একটা প্রমাণ, আফগানিস্তান। সুপার এইটে কিংসটাউনে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ, দুই পাল্লাভারি দলকে চুরমার করে দিয়েছিলেন রাশিদ খান, রহমানুল্লাহ গুরবাজরা। ২৫ জুন রাতে বাংলাদেশকে হারানোর পরের দিনই ত্রিনিদাদের বিমান ধরতে গিয়েছিলেন আফগানরা। কিন্তু চার ঘণ্টা দেরি হয়ে যায় উড়ান। কার্যত কোনও অনুশীলন ছাড়াই ত্রিনিদাদে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নামতে হয় তাঁদের। অস্ট্রেলিয়াকে হারানো দল কিনা টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বনিম্ন স্কোর করে অল-আউট হয়ে যায়।
আজ আইসিসি টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে একদিকে ইতিহাসের হাতছানি। অন্যদিকে সেই একইভাবে খানিক ইতিহাসের চোখরাঙানি। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ফুল আয়তনে পেল্লায় একজাতের 'কিং প্রোটিয়া'। বিজ্ঞানসম্মত নাম 'প্রোটিয়া সায়নারয়েড'। ওই থেকেই দলের চলতি নাম হয়েছে প্রোটিয়া। যারা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল দল। পাঁচবার পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে উঠেছে। দুইবার টি২০ বিশ্বকাপেও সেমিফাইনাল দেখেছে। অথচ প্রতিবারেই সেমিফাইনাল থেকে 'সেমি' আর সরানো হয়নি তাদের। বড় মঞ্চে বারবার পস্তানো দেখে ক্রিকেটদুনিয়ায় তাদের আর এক নাম হয়েছে 'চোকার্স'। আজ আইডেন মার্করামদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এই তকমা নিয়েই। হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, গ্রেম স্মিথ, হার্শেল গিবস, শন পোলক, জ্যাক কালিস, মার্ক বাউচার, এবি ডেভিলিয়ার্স-রা যা পারেননি, সেটা কি এবার হবে? না হওয়ারও তো কিছু নেই। এবারের আইপিএলে ডেভিড মিলার, কুইন্টন ডি-কক, হাইনরিখ ক্লাসেনরা যা খেলেছেন, তাতে আশা তো করাই যায়।
এই আইপিএল দিয়ে বিচার করলে আবার ভারতের জন্য সম্পূর্ণ অন্য গল্প উঠে আসে কিন্তু!
টি২০ ক্রিকেটের ইতিহাসে তর্কাতীত সেরা মঞ্চ আইপিএল। ২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপে যোগিন্দর শর্মার সেই শেষ ওভারে জেতার পরের বছর, ২০০৮ সালে শুরু হয় টি২০ ক্রিকেটের এই মহাযজ্ঞ। গ্ল্যামার, চমক, জৌলুসে মিশে যায় ক্রিকেট ও বিনোদন। অথচ তারপর দেড় দশকের বেশি সময় কেটে গেছে। প্রতি বছর টি২০ ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে ভারত। এদিকে টি২০ ক্রিকেটে বিশ্বকাপের একটিও ট্রফি ঢোকেনি ভারতে। ২০১৩ সালের পর থেকে আবার কোনও আইসিসির খেতাবই পায়নি ভারত। তুলনাটা খানিক করা চলে ফুটবলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে। ফুটবল-দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ঘরোয়া লিগ 'প্রিমিয়ার লিগ' হয় প্রতি বছর, বিশ্বের সেরা পাঁচটি ক্লাব রয়েছে সে-দেশে, একাধিক ইউরোপ-সেরা ট্রফি ঢুকেছে সেখানে, অথচ ১৯৬৬ সালের পর থেকে বিশ্বকাপ আর যায়নি ইংল্যান্ডে। নয়ের দশক থেকে প্রতি ইউরোতেও ইংরেজরা 'কামিং হোম' গান ধরেন, অথচ ইউরোতেও কোনও ট্রফি পায়নি তারা।
আজ অতএব ভারতের কাছে লড়াইটা শাপমোচনের। ঘুচবে কি অন্ধকার? আসবে কি আলো? যতই সারা টুর্নামেন্ট অপরাজিত থাকুক, যায় আসে না রাহুল দ্রাবিড়ের। তিনি জানেন, শেষ কথা বলবে ফাইনাল। এক বছর আগে, অক্টোবর-নভেম্বরে দেশের মাটিতেও সারা টুর্নামেন্ট জুড়ে সবক'টি ম্যাচ জিতেছিল ভারত। সবরমতীর ধারে সব হিসেব গোলমাল হয়ে যায়। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-কাঁটা ক্ষতবিক্ষত করেছিল রোহিত-বিরাট-সূর্যদের। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ অধরাই থেকে গিয়েছে রোহিতদের।
রাহুল আরও জানেন, এই বিশ্বকাপই তাঁর শেষ মঞ্চ। এরপর আর ভারতের কোচের পদে থাকছেন না তিনি। কে আসবেন তাঁর জায়গায়, এখনও চূড়ান্ত নয়। গৌতম গম্ভীর হতে পারেন, তাঁর বন্ধু ভিভিএস লক্ষণও হতে পারেন। তিনি জানেন, তাঁর মেয়াদ শেষের কারণ এই ট্রফি খরা। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে, টেস্টে দ্রাবিড়ের তুখোড় মস্তিষ্কে বিস্তর উন্নতি করেছে ভারত। অথচ আইসিসি ট্রফি অধরাই থেকেছে টিম ইন্ডিয়ার। শেষ সুযোগ এই বিশ্বকাপ। দ্রাবিড়ের মনে কি উঁকি দিচ্ছে আরও একটা ইতিহাস? সতেরো বছর আগের এক অভিশপ্ত বিশ্বকাপ? এই ওয়েস্ট ইন্ডিজই তো ছিল। ২০০৭ বিশ্বকাপ। ভারতীয় ক্রিকেটে তখন গ্রেগ চ্যাপেল জমানা চলছে। অধিনায়কত্ব থেকে অপসারিত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। দায়িত্ব নিয়েছেন দ্রাবিড়। অথচ গ্রুপ পর্বেই দেখা গেল উথালপাথাল করা ফল। প্রথম ম্যাচেই হবিবুল বাশারের আনকোরা বাংলাদেশের কাছে হার। একমাত্র ওপেনার সৌরভ ও যুবরাজ সিংহ ছাড়া কেউ ১৫ রানের গণ্ডি টপকাতে পারেননি। একা সৌরভ করেছিলেন ৬৬। পরের ম্যাচে বারমুডার বিরুদ্ধে বিশ্বরেকর্ড। বীরেন্দ্র শেওয়াগ ও সৌরভের ধুন্ধুমার ব্যাটে ৪১৩ করেছিল ভারত। অথচ তৃতীয় ম্যাচেই আবার শ্রীলঙ্কার কাছে হার! গ্রুপ থেকেই ছিটকে গিয়েছিল ভারত। একইভাবে গ্রুপ থেকে ছিটকে গিয়েছিল পাকিস্তান। ছিটকে যাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জামাইকার হোটেলে রহস্যজনকভাবে মারা যান কোচ বব উলমার।
অধিনায়ক দ্রাবিড় যা পারেননি, কোচ দ্রাবিড় কি তা পেরে দেখাবেন? ভারতীয় ক্রিকেটে দ্রাবিড় সভ্যতার অবসান হবে কি বিশ্বজয়ের মধ্যে দিয়ে? আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জানা যাবে উত্তর।