তৃতীয়বারের জন্য আইপিএল চ্যাম্পিয়ন কলকাতা নাইট রাইডার্স! জয়ের পরে উচ্ছ্বাস ভেঙ্কটেশ আইয়ারের। (ছবিঃ আইপিএল)
শেষ আপডেট: 26th May 2024 23:08
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল' কি হঠাৎ পথ ভুল করে চেন্নাইয়ের দিকে চলে গেল?
কী নাম দেওয়া যায় এই ঝড়ের? কেকেআর? বেগুনি-সোনালি? কলকাতা নাইট রাইডার্সের একটা থিম সং আছে বটে। করব লড়ব জিতব। কিন্তু এটায় লড়া কোথায়? এ তো উড়িয়ে দেওয়া! অন্তত রবিবারের আইপিএল ফাইনাল দেখলে তেমনটাই মনে হবে। এখানে লড়ালড়ির কিছু নেই। বরং রোমান ইতিহাসে জুলিয়াস সিজারের সেই কথাটাকে ধার নেওয়া যায়! এলাম, উড়িয়ে দিলাম, জিতলাম!
নিখুঁত অঙ্ক। নিখুঁত হোমওয়ার্ক। ম্যাচের আগেই লেখা হয়েছিল, কলকাতাকে এবারের আইপিএলে তুলনা করা যেতে পারে ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে। মাত্র তিনটে ম্যাচ হেরেছে, এই দিয়ে তো বিচার হয় না। কলকাতার আসল শক্তি, ভারসাম্য। প্রতিটা পজিশনে নিখুঁত সাজানো। কিন্তু এই ম্যাচে শুধু সেনাবাহিনীকে সাজালে হবে না। চেন্নাইতে খেলা। স্কোর এখানে বেশি উঠবে না। উল্টোদিকে হায়দরাবাদের বিধ্বংসী ওপেনিং জুটি। দরকার নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি। স্রেফ এতেই দশে বারো নিয়ে পাশ করে গেলেন মেন্টর গৌতম গম্ভীর!
কলকাতা তখন কোমর বেঁধে তৈরি। পৌনে আটটা বাজে। রাসবিহারী, হাজরা, শ্যামবাজার শুনশান। একে রোববার, ছুটির দিন। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা না থাকলে না হয় বলা যেত, সবাই আজ আইপিএল ফাইনালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের খেলা দেখবে বলে সাত-তাড়াতাড়ি ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছে। সেই নয়ের দশকে রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ' হলে যেমন হ'ত আরকি। কিন্তু স্কোরের দিকে তাকালেই তো চক্ষু চড়কগাছ হতে হবে! এই সময় চিপকে 'ট্র্যাভিষেক' বলে আর একটা সাইক্লোন হ'বার কথা ছিল না?
কোথায় ট্র্যাভিষেক? আসলে হায়দরাবাদের অবস্থাটা একেবারেই সেই লখিন্দরের বাসরঘরের মত। নিশ্ছিদ্র লোহার আবরণের সবটাই দুই ওপেনার ট্র্যাভিস হেড ও অভিষেক শর্মা। দু'জনে এমন একটা নির্ভরতা তৈরি করে দিয়েছেন যে, মিডল অর্ডারের ফাঁকফোঁকরগুলো কারোর নজরেই আসেনি। অথচ মরসুমের শেষ পর্যায়ে এসে লোহার গায়ের ছিদ্রগুলো এবার ফাঁস হয়ে গিয়েছে। নিখুঁতভাবে সেই ফাঁস হওয়া তথ্য কাজে লাগিয়েছেন কেকেআর ম্যানেজমেন্ট। ভাল সৈন্য হওয়ার এটাই প্রাথমিক শর্ত। শত্রুর প্রতিটা দুর্বল জায়গার হিসেব রাখা। ইনিংসের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই অতএব মিচেল স্টার্কের লেংথে বেসামাল অভিষেক। সামান্য ঘুরে সোজা অফ স্টাম্পে। পরের ওভারে বৈভব অরোরার কাছে একইভাবে ঘায়েল ট্র্যাভিস হেড! কানায় লেগে চলে গেল কিপার রহমানুল্লাহ গুরবাজের হাতে।
তারপরের সবটাই দেখে মনে হবে, বোধ করি আচমকা রেমাল এসে আছড়েছে মেরিনা বিচে। লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে দশ ওভারের আগেই ১৬৭ তুলে দিয়েছিলেন ট্র্যাভিষেক জুটি। এদিকে ঘড়ি কাঁটা সাড়ে আটটা ছোঁয়নি, ঝড় তখনও সাগরদ্বীপ থেকে দূরে। অথচ ৯.২ ওভারে হায়দরাবাদ ৬০-৪। ঠিক কুড়ি মিনিটের মাথায়, ১২.৪ ওভারে ৭৭-৭! খেলাটা মাঠে হচ্ছে নাকি ভিডিও গেমে, কে বলবে? ঠিক যে ভয়ের জায়গাটা ছিল, সেটাই হল। হেড-অভিষেক পড়ে যেতেই প্রায় হুড়মুড়িয়ে ধসে গেল সানরাইজার্সের ব্যাটিং! ২০ রানের গণ্ডি পেরোলেন মাত্র একজন। নয় নম্বরে নামা প্যাট কামিন্স!
১৮ ওভারের তৃতীয় বলে কামিন্সের ব্যাট থেকে বল যখন উড়ে গিয়ে মিচেল স্টার্কের তালুবন্দি হল, স্কোরবোর্ডটাকে দেখে কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিল। এই সেই দল? এরাই এক মরসুমে আইপিএলের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড দুইবার ভেঙেছে? পাওয়ারপ্লে-তে সবচেয়ে বেশি রান তোলার রেকর্ড এদের ঝুলিতে? সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার শিরোপা নিয়ে ঘুরছেন ওপেনার অভিষেক? এ তো আইপিএল ফাইনালের ইতিহাসে সবচেয়ে কম টার্গেট!
কলকাতার ভারসাম্য ঠিক কতখানি, আবার বড় ম্যাচে প্রমাণ করলেন রহমানুল্লাহ গুরবাজ। সুনীল নারাইন আজ হতাশ করলেন। প্রথম বলেই প্যাট কামিন্সকে ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে যে ছককাটা হাঁকালেন নারাইন, মনে হচ্ছিল রেমালের ল্যান্ডফল শুরু হল চেন্নাইতে। কিন্তু পরের বলেই ক্যাচ তুলে দিলেন। মনে হল, এই বুঝি গেল। ফিল সল্ট ফিরে গিয়েছেন। গুরবাজ রয়েছেন তাঁর জায়গায়। বলা হচ্ছিল, সল্টের বদলি নামতেই যখন হবে, গুরবাজকে, গ্রুপের দুই ম্যাচে দেখে নেওয়া হোক। অথচ আমদাবাদ, গুয়াহাটি, দুই জায়গাতেই বৃষ্টির তোড়ে মাঠেই নামা হয়নি গুরবাজের। কিন্তু ফাইনালে আবার তিনি নিজের ধার বোঝালেন। শুরুতে বেধড়ক মার শুরু করলেও পরে তাঁর জায়গা নিলেন ফাইনালের তারকা ভেঙ্কটেশ আইয়ার। ২৬ বলে ৫২, স্ট্রাইক রেট পারফেক্ট ২০০। যেভাবে একের পর এক মারছিলেন, মনে হচ্ছিল, কলকাতা কি ইনিংসটা অন্য কোনও মাঠে খেলছে? নাকি দ্বিতীয় ইনিংসটা অন্য পিচে সরে গিয়েছে?
ঠিক কতটা হোমওয়ার্ক করে নেমেছিল কেকেআর, স্রেফ পঞ্চম ওভার থেকেই বোঝা যায়। টি নটরাজন এই ম্যাচের অন্যতম ধারালো অস্ত্র হতে পারতেন। সামনে তুফানি মেজাজে থাকা ভেঙ্কটেশ আইয়ার। প্রথম বলে পয়েন্টে চার। দ্বিতীয় বলে ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে চার। তৃতীয় বলে যখন ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগ দিয়ে বলটা গ্যালারিতে পড়ল, ডাগআউটে বসা মুথাইয়া মুরলীধরণের মুখে একটা অসহায় হাসি ফুটে উঠেছে। তার পরের বল সপাটে চালাতে গেলেন, এজে লেগে শর্ট থার্ডে চার হয়ে গেল।
১০ ওভারের আগেই লখনউকে পরাস্ত করেছিল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। কলকাতা নিল ১০ ওভার ৩ বল। গ্যালারিতে থাকা হায়দরাবাদের সিইও, কলানিথি মারানের কন্যা কাব্য মারানকে দেখাল ক্যামেরা। নিজেও বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এরকমটা হবে! কার্যত যে দলের হাত দিয়ে এবারের আইপিএলে রান বিপ্লব হয়ে গেল, তাদের এইভাবে ভেঙে পড়তে হবে, কল্পনা করতে পারেননি। কার সঙ্গে তুলনা করা যায় একে? কোনও বিপ্লবের সঙ্গে? যে বিপ্লব তারা ডেকে আনল, কিন্তু শেষ অবধি অসহায়ভাবে ঘায়েল হতে হল শেষ লড়াইতে। ওদিকে কলকাতার বক্সে তো চাঁদের হাট। অসুস্থতা সারিয়ে উঠে, মাস্ক পরে, গ্যালারিতে সস্ত্রীক হাজির শাহরুখ খান। আমদাবাদে প্লে-অফের ম্যাচের পর গরমে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। হাসপাতালে অবধি নিয়ে যেতে হয়েছিল কিং খানকে। আজ কলকাতায় বানভাসি বৃষ্টি ও চেন্নাইতে ব্যাটে-বলে সাইক্লোনের আবহে শেষ হাসিটা আজ তিনিই হাসলেন।