শেষ আপডেট: 3rd April 2024 12:53
সুভাষচন্দ্র দাশ, ক্যানিং
এপ্রিল মানেই মধুমাস। হিমালয় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে পড়েছে পাহাড়ি মৌমাছিরা। ফুটেছে খলসে ফুলও। তাই মধু সংগ্রহের ব্যস্ততা। অন্যদিকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে দল বেঁধে মধু আনতে জঙ্গলের পথে মৌলেরাও।
মার্চের শেষ থেকে নিয়ম মেনে হিমালয় থেকে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি ঘিরছে সুন্দরবন। এই মৌমাছিরা চেহারায় বেশ বড়। প্রায় এক-দেড় ইঞ্চি লম্বা। রক-বি নামে পরিচিতি এদের। বসন্তে এদের নেমে আসা মূলত খলসে ফুলের টানে। সুন্দরবনের বাদাবন যে এইসময় আলো হয়ে থাকে ‘খলসে’ ফুলে। সেই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য হিমালয় থেকে কোটি কোটি মৌমাছির ধেয়ে আসা সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে। এ এক আজব প্রাকৃতিক চক্র।
পরিবেশবিদরা জানান, সমস্ত পৃথিবীতে যত বাদাবন রয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনের জঙ্গলে জন্মায় খলসে গাছ। এই ফুলের গন্ধ খুবই সুন্দর। সমস্ত সুন্দরবনে ১৯টি ব্লক রয়েছে। এরমধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ১৩টি এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ৬ টি। আবার বনবিভাগ ভাগ করেছে ২২টি ব্লকের (বন্যপ্রাণী দ্বীপ) ১১৫ টি কম্পার্টমেন্টে(ঘন জঙ্গল এলাকা)। খলসে ফুলের মধু মেলে এখানেই। অন্যান্য ফুলের মধু সামান্য হলেও তেতো হয়, কিন্তু খলসে ফুলের মধু অত্যন্ত সুস্বাদু।
মধুর মরশুম শুরু হতেই প্রায় চারশো জন মৌলে সুন্দরবনের জঙ্গলে রওনা দিলেন মধু সংগ্রহের জন্য। বিপদসঙ্কুল সে যাত্রা। প্রতিবছরই ৭-৮ জনের এক একটি দল পৃথকভাবে মধু সংগ্রহ করতে জঙ্গলে ঢোকে। যাওয়ার আগে সাড়ম্বরে বনদেবী ও দক্ষিণ রায়ের পুজো দিয়ে ‘দুখের যাত্রার’ আয়োজন করেন তাঁরা। দক্ষিণ রায়ের ডেরা থেকে যাতে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সুস্থ, অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেন, তার জন্য গৃহস্থঘরের মহিলারা উপোস করেন। সুচিবস্ত্রে দেবীর কাছে কান্নাকাটির পর মানত করেন। পরে পুরোহিত মৌলেদের হাতে লাল সুতোয় বেঁধে দেন মাদুলি-তাবিজ-কবচ। জঙ্গলে যাচ্ছেন পরিবারের সদস্য, সেই সময় চোখের জল ফেলা চলবে না।
এই ক'দিন প্রিয়জন জঙ্গল থেকে কবে বাড়িতে ফিরবেন সেই অপেক্ষায় নদীর পাড়ে পথ চেয়ে বসে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। বাড়িতে থাকে শোকের পরিবেশ, পালিত হয় অশৌচ! বাড়িতে একমাত্র গৃহদেবতার পুজো ছাড়া সমস্ত রকম আমোদ-প্রমোদ বন্ধ থাকে। শাঁখা-সিঁদুর পরেন না বধূরা। কাপড় কাচাও বন্ধ। বাড়িতে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব এলে বসার জন্য আসন দেওয়া হয় না। কথা বলা বন্ধ। এমনকি কেউ পানীয় জল খেতে চাইলেও দেওয়া হয় না। তবে এই সব নিয়মই চলে দিনের বেলায়। সূর্যাস্তের পর আবার সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক। প্রিয়জন জঙ্গল থেকে ফিরলেই ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয় আনন্দ উৎসব পুজোপাঠ।
অনেক মৌলে আবার বাঘের মুখ বাঁধা মন্ত্র জানা গুণিন নিয়ে যান সঙ্গে করে। গভীর জঙ্গলে মধুর চাক কাটার সময় নদীতে স্নান করে ভিজে কাপড়ে কোন এক গাছের গোড়ায় গরাণ পাতার থালা তৈরি করে গুড়ের বাতাসা দিয়ে পুজো করেন। এরপর গুণিন জঙ্গল বেঁধে দেওয়ার পর শুরু হয় উড়ন্ত মৌমাছির গতিবিধি লক্ষ্য করে মৌচাক খোঁজার পালা। সঙ্গীরা নিরাপদে রয়েছেন কিনা সেই খেয়াল রাখার কাজও চলে। কারও সাড়া-শব্দ না পাওয়া গেলে ধরেই নেওয়া হয় যে তাকে বাঘে নিয়ে গিয়েছে কিংবা কোনও বিপদে পড়েছে। বেগতিক বুঝলে মুহূর্তে কাজ বন্ধ করে দেন সবাই। অনেক সময় সঙ্গীর উপর হামলা করলে লাঠিসোঁটা নিয়ে বাঘের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন বাকিরা। কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও অনেক সময়েই হারাতে হয় সঙ্গীকে।