শেষ আপডেট: 22nd October 2023 12:38
সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং
বাংলা তখন অবিভক্ত। দেশে ব্রিটিশ রাজ চলছে। ঢাকার বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামের বাসিন্দা কালীপ্রসন্ন, কাশীকান্ত, রামকান্ত, রামরাজা ভট্টাচার্যরা যৌথভাবেই দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। দেশভাগের পর ভট্টাচার্যরা ক্যানিংয়ে চলে আসেন। কিন্তু পুজো তাঁরা থামাননি। বিক্রমপুরের পাইনখাড়া গ্রামের পুজোই এপারে এসে বিখ্যাত হল দিঘিরপাড় গ্রামের ভট্টাচার্যদের পুজো নামে।
প্রায় ৪৩৮ বছর পেরিয়েছে এই পুজো। এই বনেদি বাড়ির প্রতিমা অন্যান্যদের থেকে খানিকটা আলাদা। গৌরীর মুখের রঙ এখানে কালো। বিষয়টি নিয়ে বলতে গিয়ে পরিবারের সদস্য পীযুষকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, প্রায় ২২১ বছর আগে বাংলাদেশে পুজো অনুষ্ঠান চলছিল। মহাসপ্তমীর দিনে পাশের মনসা দেবীর মন্দিরের প্রদীপ জ্বলছিল। জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা থেকে কোনও প্রকারে জ্বলন্ত সলতে নিয়ে একটি কাক দুর্গামন্ডপের উপর বসে। সেই সলতের আগুনে শন দিয়ে তৈরি দুর্গা মণ্ডপের চালা ঘর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই বিধ্বংসী আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নেয় গোটা পুজো মণ্ডপকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেবী প্রতিমা। এমন আকষ্মিক দুর্ঘটনায় ভেঙে পড়ে সমগ্র ভট্টাচার্য পরিবার। গ্রামের মানুষের ধারণা হয় দেবী রুষ্ট হয়েছেন।
প্রতিবেশীরা বলাবলি করতে থাকেন, “মা তোদের হাতে আর পুজো চাইছেন না।”এমন কথা শোনার পর ভট্ট্যাচার্য পরিবারের এক সদস্য মায়ের পোড়া মূর্তির সামনে কান্নাকাটি করে ধ্যানে বসেন। কথিত আছে, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেবী ওই সদস্যকে পুড়ে যাওয়া কালো ও বাদামী রঙের মূর্তি গড়ে পুজো করার নির্দেশ দেন। সেই থেকেই এ বাড়ির প্রতিমার মুখ রঙ কালো এবং শরীর বাদামী রঙের হয়ে আসছে। যা আজও ব্যতিক্রমী।
পুজোর শুরুর দিকে মোষ বলির প্রথা ছিল । কিন্তু মহিষ বলি দেওয়ার জন্য কেউ মায়ের প্রসাদ খেতেন না। পরবর্তী কালে পাঁঠা বলি দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে পাঁঠা বলি বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য মায়ের আদেশ অনুযায়ী সপ্তমী, অষ্টমী ও সন্ধি পুজোয় চালকুমড়ো বলি হয়। নবমীতে চালকুমড়োর সঙ্গে শশা এবং শত্রু বলির প্রচলন শুরু হয়। শত্রু বলি মানে আতপ চালের তৈরি মানুষের মূর্তি তৈরি করে সেটিকে মানকচু পাতার উপরে রেখে বলি দেওয়া হয়। একেই শত্রু বলি বলা হয়।
চার শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এই বংশের প্রতিমা গড়ে আসছেন বাংলাদেশ থেকে আসা পালেরা। বাসন্তী গ্রামের বাসিন্দা গৌতম পাল বর্তমানে কালো দুর্গা প্রতিমা গড়ছেন। ৪৩৮ বছরে ঠাকুরের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়নি। দেবীর চার সন্তানেরও আসন অন্যান্য মণ্ডপের থেকে আলাদা। সাধারণত দেবী দুর্গার ডান দিকে লক্ষ্মী গণেশ থাকে, কিন্তু ভট্টাচার্য বাড়ির প্রতিমার বাম দিকে গণেশ ও সরস্বতী। কেন এমন অভিনবত্ব, এ প্রসঙ্গে জানা যায়, দেবী দুর্গা তাঁর সন্তান গণেশকে কোলে নিয়ে থাকেন বামদিকে। যার জন্য গণেশকে বাম পাশেই রাখা হয় এবং সরস্বতী সকলের ছোট তাই তিনিও থাকেন বামদিকে।
দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন পর প্রতিমা জলের তলায় তিনদিন পুঁতে রাখা হয়, যাতে প্রতিমা গভীর জল থেকে উপর ভেসে না ওঠে। লক্ষ্মী পুজোর পরের দিন তোলা হয় সেই কাঠামো। আবার পরের বছর প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয় জন্মাষ্টমী থেকে।
এখন এই পুজোর পৌরহিত্য করেন পরিবারের সদস্য প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। ভট্টাচার্য পরিবারের আর্থিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সকলে মিলে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজোর কটাদিন একান্নবর্তী ভট্টাচার্য পরিবারের মিলিত হয়ে মেতে ওঠেন আনন্দে।