শেষ আপডেট: 7th July 2024 17:50
অমল সরকার
কোনও কাগজ লিখেছিল ‘অপারেশন বালক’। ‘অপারেশন সৎকার’ ছিল কোনও কাগজের শিরোনাম।
১৯৯৩-এর মে-জুন। ৫৫ দিনের মাথায় বালক ব্রহ্মচারীর দেহ পুলিশ তাঁর ভক্তদের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ভোরবেলায় সৎকার করেছিল। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর ভক্তেরা গুরুদেবের দেহ সোদপুরের সুখচরের আশ্রমে নিয়ে গিয়ে রাখেন। তাঁরা দাবি করেন, বাবা মারা যাননি। তাঁর নির্বিকল্প সমাধি হয়েছে।
বাঙালি গডম্যান বালক ব্রহ্মচারী রাজনীতি, প্রশাসন, শিল্প-বাণিজ্যের শীর্ষস্থানীয়দের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৯৩-এর জুন মাসের গোড়ায় বালকের দেহ সৎকারের দায়িত্ব বর্তেছিল তৎকালীন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উপর, যাঁর সঙ্গে কিনা বালকের গভীর যোগাযোগ ছিল। একদিন রাজভবনে জ্যোতি বসুর কাছে এই গডম্যানকে নিয়ে হাজির হন সুভাষবাবু। কোমরের ব্যথায় কাতর জ্যোতিবাবুর শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে এসেছিলেন বহুজনের চোখে ‘সাক্ষাৎ দেবতা’ বালক ব্রহ্মচারী, যাঁর পারিবারিক নাম ছিল বীরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী।
সেই গুরুদেবের দেহ সৎকার পর্ব কভার করার স্মৃতি আমার আজও তাজা। প্রায় শ-পাঁচেক পুলিশকে ঘণ্টা চারেক ধরে যুদ্ধ করতে হয়েছিল গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকতে। পুলিশকে আটকাতে ভক্তেরা লঙ্কার গুঁড়ো ছুড়ছিল। ধেয়ে আসে ত্রিশূল। তাতে আহত হন পুলিশ সুপার রচপাল সিং। শেষে মারমুখী পুলিশের কাছে হার মানেন বালকের শিষ্যেরা। তারা সংখ্যায় কয়েক হাজার। পুলিশের লাঠি আর টিয়ার গ্যাসে আহত হন শত শত ভক্ত।
সেদিনের প্রতিবাদী, আহত ভক্তেরা কেউই প্রশাসনের মাথা কিংবা সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এমনকী সাধারণ মধ্যবিত্তও ছিলেন না। ভিড়ের মুখগুলি আমার আজও বেশ মনে আছে। বেশিরভাগেরাই হাঁড় গিলগিলে চেহারার হত-দরিদ্র মানুষ। কারও পরনে গামছা, কারও একটাই কাপড় সর্বাঙ্গে জড়ানো। চটি-জুতোর বালাই নেই। বালকের সিংহভাগ শিষ্যের এই সোশ্যাল প্রোফাইলের প্রধান কারণ ছিল তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ এবং চরণ স্পর্শের জন্য একটি পয়সাও খরচ হত না। ছিল না নতুন কাপড়চোপর কেনা, গুরুদক্ষিণা দেওয়ার বালাই।
এই পুরনো প্রসঙ্গ অবতারণার কারণ হাতরাস। উত্তর প্রদেশের ওই জায়গায় পদপৃষ্ঠ হয়ে যেভাবে শতাধিক মানুষের প্রাণ গেল, তিন দশক আগে বালক ব্রহ্মচারীর দেহ সৎকারের দিনও তেমন মর্মান্তিক কিছু ঘটে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। সুখচরের আশ্রম লাগোয়া সরু রাস্তাগুলি সেদিন হাজার হাজার ভক্ত দখল নিয়েছিলেন। পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত, আহতদের আর্তনাদ আজও কানে বাজে।
সব ক্ষেত্রে মৃত্যু একশো না ছাড়ালেও হাতরাসের মতো ঘটনা ভারতে সম্বৎসর কম-বেশি সব রাজ্যেই ঘটে। তার প্রধান কারণ, পুলিশ-প্রশাসনের এই ধরনের জমায়েতের প্রতি উপেক্ষা। আমাদের পুলিশ ইদানীং এত বেশি ভিভিআইপি সামলাতে ব্যস্ত যে সাধারণ মানুষের জমায়েত নিয়ে তাঁদের ভাবার অবকাশ থাকে না। আশি হাজারের জায়গায় জমায়েত এক লাখ আশি হাজার ছাড়ালেও টনক নড়ে না তাদের।
প্রশ্ন হল এই স্বঘোষিত বাবাদের চরণ স্পর্শে লাখ লাখ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন কেন। হাতরাসে ভোলেবাবার চরণ ধূলি পেতে যত মানুষের সমাগম হয়েছিল অনেক প্রাচীন, জনপ্রিয় দেবস্থানে বিশেষ বিশেষ দিনেও অত মানুষ ভিড় জমান না।
এই বাবাদের অনেকেরই আবার নানা কু-কর্মে জড়িয়ে জেল বন্দি। তবু তাদের আশ্রম দিব্যি চলছে। ভক্তি-শ্রদ্ধায় ভাটা পড়েনি। ৭৭ বছর বয়সি আসারাম বাপু কিশোরী ভক্তকে অশুভ আত্মা থেকে মুক্তি দেওয়ার অছিলায় ধর্ষণ করে এখন যাবজ্জীবন সাজা খাটছে। ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রধান গুরমিত রাম রহিম ধর্ষণের মামলায় সাজা প্রাপ্ত। তারপরও প্যারলে মুক্তি তাঁর কাছে প্রায় জল-ভাত। জেলবন্দি গডম্যান রামপাল, আশুতোষ মহারাজ, ইচ্ছাধারী ভীমানন্দ, নিত্যানন্দ, সবই একই গোত্রের অংশ। কারও বিরুদ্ধে ধর্ষণ তো কারও বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
লক্ষণীয়, এই গডম্যানদের পয়লাওয়ালা শিষ্য-শিষ্যার অভাব না থাকলেও মূল অনুগামীরা সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষ। হাতরাসে ভোলেবাবার চরণ স্পর্শ করতে হাজির হয়েছিলেন গোটা পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের দলিত, পিছড়ে বর্গের মানুষ। মৃত ও নিহতদের নাম-পরিচয়েই স্পষ্ট, মূলত আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ অংশের মানুষ সেখানে ভিড় জমিয়েছিলেন।
এই মানুষদের বিপুল অর্থ খরচ করে জনপ্রিয় তীর্থস্থানে দেবতা দর্শন করতে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ থাকে না। বারাণসী, অযোধ্যা, উজ্জয়নের মতো জনপ্রিয় তীর্থস্থানগুলির রূপবদলের নামে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আগামী দিনে গরিব, সাধারণ মানুষের এই সব দেবস্থানে যাওয়ার সামর্থ আরও হবে না। অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের খবর করতে গিয়ে দেখে এলাম বেশিরভাগ ধর্মশালা বড় বড় হোটেল মালিকেরা কিনে নিয়েছে। অতি সাধারণ হোটেলে রাত কাটাতেও দেড়-দু হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। স্বভাবতই হাতের নাগালে পাওয়া গুরু দর্শনে ঝুঁকছে মানুষ, যাঁরা নিজেদের দেবদূত হিসাবে তুলে ধরে।
এত গেল সমস্যার একটি দিক। তার চেয়েও বড় সমস্যা, জাত-বিদ্বেষের কারণে এলাকার উপাসনার উপাসনাগৃহগুলিতে দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষের প্রবেশাধিকার অবাধ নয়। উচ্চবর্ণের লোকেরা নানা বিধি নিষেধ আরোপ করে রেখেছে। জাতপাতের তিক্ততা, বিদ্বেষ, বিভাজন সময়ের সঙ্গে রূপ বদলায়। রাজ্যে রাজ্যে তার প্রতিফলন আলাদা। আমি কলকাতা লাগোয়া একটি জনপ্রিয় সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপে দেখেছি লাগোয়া মেথর পল্লির লোকেরা নতুন জামা-কাপড় এলে তাদের দর্শনার্থীদের লাইনে ঢুকতে না দিয়ে আলাদাভাবে প্রতিমা দর্শন করিয়ে ভিন্ন পথে বের করে দেওয়া হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে ভিভিআইপি ট্রিটমেন্ট মনে হলেও আসল কারণ ছিল উদ্যোক্তাদের মনে মেথরদের প্রতি উপেক্ষা, অশ্রদ্ধা, ঘৃণার মনোভাব। গত বছর চেন্নাইতে এক দলিতের মরদেহ উচ্চবর্ণের লোকেরা তাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে দেয়নি। ঘুরপথে নিয়ে যেতে হয়েছে। সাইকেলে, কাঁধে নিকট আত্মীয়ের দেহ বহন করার ঘটনা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসে। বলা হয় টাকার অভাবে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে পারেননি। সব ক্ষেত্রে কারণ আর্থিক নয়, জাতপাত। তথাকথিত নিচু জাতের মানুষের দেহ চালিক গাড়িতে তুলতে চান না, অথবা আশপাশের বাকিরা মানা করে।
আর এমন হতদরিদ্র, অর্ধ শিক্ষিত বঞ্চিত মানুষের কাছে সাক্ষাৎ দেবতা হিসাবে অবতীর্ণ হন স্বঘোষিত বাবারা। তাদের মহিমা কীর্তণের জন্য গ্রামে গ্রামে কাজ করে প্রশিক্ষিত বাহিনী। এইভাবেই লাখ লাখ গরিব মানুষের মনের মানুষ হয়ে ওঠা বাবাদের রাজনীতি ও ভোটের বাজারে চর চর করে দর ওঠে।
তাই হাতরাসের ঘটনায় ১২১ জন মারা গেলেও ভোলেবাবার বিরুদ্ধে মামলা করেনি পুলিশ। যোগী আদিত্যনাথের যে পুলিশ দাগি অপরাধীদের ধরে ধরে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করছে বলে অভিযোগ, তারাই নাকি ভোলেবাবার সন্ধান পাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, জমায়েতের সঙ্গে বাবার কোনও সম্পর্ক নেই।
শুধু কি যোগী, বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী থেকে দেশের কোনও নেতা-নেত্রীর সাহস হয়নি ভোলেবাবার বিরুদ্ধে মুখ খোলার। হাতরাসের ঘটনা নিয়ে সংসদে রাহুল গান্ধী নিহতদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে সরব হন। হাতরাসে গিয়ে কাঠগড়ায় তোলেন প্রশাসনকে। যোগী আদিত্যনাথের উদ্দেশে বিরোধী নেতা বলেন, ‘করজোরে বলছি যতটা বেশি সম্ভব আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করুন।’ কিন্তু ভোলেবাবার নাম উচ্চারণ করেননি রাহুল। আসলে ওবিসি, জনজাতি, দলিত এবং মহিলাদের উপর স্বঘোষিত বাবাদের অসীম প্রভাবকে রাজনীতিকরা হাতছাড়া করতে চান না। মনে আছে, বোফর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগে ব্যতিব্যস্ত রাজীব গান্ধী ভোটের আগে মাচান বাবা নামে এমনই এক গডম্যানের পা নিজের মাথায় ঠেকিয়ে এসেছিলেন।
বালক ব্রহ্মচারী বেঁচে থাকাকালে কলকাতার তারাতলা এলাকায় পুলিশের গুলিতে তাঁর সন্তান দলের এক সমর্থক পুলিশের গুলিতে মারা যান। সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক সরোজ মুখোপাধ্যায় তড়িঘড়ি পুলিশের নিন্দা করে বলেছিলেন, সন্তানেরা আমাদের লোক (মানে সিপিএমের সমর্থক)। বালকের দেহ নিয়ে বিবাদ চলাকালে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন চলছিল। সরকার ভোটের অঙ্ক মেনে দেহ সৎকারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন মিটে যাওয়ার পর।