জরুরি অবস্থা ইস্যু
শেষ আপডেট: 28th June 2024 12:53
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বরাবরের মতো ২৪ জুন অর্থাৎ জরুরি অবস্থার বর্ষপূর্তির একদিন আগে থেকেই সরব হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তীব্র আক্রমণ শানিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীকে। বলেছিলেন ওই অন্ধকার অধ্যায় দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিল।
২৫ তারিখ ফের এই ইস্যুতে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী। আর ওই দিনই দিল্লির অদূরে গাজিয়াবাদের একটি অনুষ্ঠানে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে সরব হন উপ রাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়। পরদিন লোকসভায় দ্বিতীয়বার স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পর সেই জরুরি অবস্থা নিয়েই প্রস্তাব পাঠ করে বিতর্কে জড়িয়েছেন স্বয়ং ওম বিড়লা। প্রস্তাবটি শাসক জোটের পরিবর্তে স্বয়ং স্পিকার পাঠ করায় সংবিধান এবং পরিষদীয় রাজনীতির বিশেষজ্ঞদেরও অনেকেই বিস্মিত।
সেদিনের ভাষণে পুরোদস্তুর দলীয় নেতার ভাষায় জরুরি অবস্থা এবং ইন্দিরা গান্ধীর মুণ্ডপাত করেন স্পিকার। সবশেষে ইমার্জেন্সির সময়ে নিহতদের স্মরণে দু-মিনিট নীরবতা পালন করেন।
পরদিন তালিকায় যুক্ত হয় রাষ্ট্রপতির নাম। বৃহস্পতিবার চলতি সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ভাষণেও ছিল জরুরি অবস্থার নিন্দা। লোকসভার স্পিকার জরুরি অবস্থা নিয়ে নিজের উদ্যোগে সংসদে প্রস্তাব পাশ করায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি মন্তব্য করেন, ‘জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে মুখ খোলায় স্পিকারকে নিয়ে আমি গর্ব অনুভব করি।’ মনে করা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদ জ্ঞাপন প্রস্তাবের উপর বিতর্কের জবাবে প্রধানমন্ত্রী দ্রৌপদীরও প্রশংসা করবেন জরুরি অবস্থার কথা উল্লেখ করায়।
জরুরি অবস্থা নিয়ে শাসক পক্ষ এবং সাংবিধানিক পদে আসীন ব্যক্তিদের ধারাবাহিক আক্রমণ থেকে স্পষ্ট কংগ্রেস-সহ বিরোধী পক্ষের ‘সংবিধান বিপন্ন’ প্রচারের মোকাবিলায় বিজেপি-সহ গেরুয়া শিবির ৪৯ বছর আগের জরুরি অবস্থাকে হাতিয়ার করছে। কংগ্রেস-সহ বিরোধী সাংসদেরা এবার অনেকেই সংবিধানের কপি হাতে নিয়ে সংসদে শপথ নিয়েছেন। স্পিকারকে সংবিধানের গণ্ডির মধ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন রাহুল গান্ধী-সহ একাধিক বিরোধী সাংসদ।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, আগামী বছর জরুরি অবস্থার ৫০ বছরে পদার্পণকে সামনে রেখে গেরুয়া শিবির আক্রমণ তীব্র করবে তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক মহলে অনেকেই বিস্মিত শাসক দলে রণকৌশলে দুই সাংবিধানিক প্রধানও নিজেদের জড়াচ্ছেন দেখে।
প্রথামত কেন্দ্রীয় সরকারই রাষ্ট্রপতির ভাষণ লিখে দেয়। তবে এর অর্থ এটা নয় যে রাষ্ট্রপতি চাইলে তাতে পরিবর্তন, পরিমার্জন করাতে পারেন না। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি কেআর নারায়ণন, প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিকবার সেই পথে হেঁটেছেন। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেসকে নিশানা করার যে কৌশল শাসক দল নিয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবন তাতে আপত্তি করেনি।
রাজনীতির বাইরের বহু মানুষও রাষ্ট্রপতির ভাষণ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এই ব্যাপারে তিনি সব উত্তরসূরি, এমনকী বিজেপির রামনাথ কোবিন্দকেও ছাপিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে তা বিরোধীদের পাশাপাশি সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদেরও বিস্মিত করেছে। রামনাথ বা তাঁরও আগে বিজেপি জমানায় রাষ্ট্রপতি হওয়া এপিজে আবদুল কালাম কখনও বিরোধী দলকে পুরনো ঘটনার উল্লেখ করে অস্বস্তিতে ফেলেননি। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, তিনি কোনও দলের প্রতি দায়বদ্ধ নয়।
রাষ্ট্রপতির ভাষণে এবার মোদী সরকার বেশ কিছু বিষয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিরোধীরা যতই বর্তমান সরকারকে সংখ্যালঘু, দুর্বল বলে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, দ্রৌপদীর ভাষণে সরকার দাবি করেছে তারা মোটেই তা নয়। বিগত দশ বছরের মেজাজেই চলবে বর্তমান সরকার।
কিন্তু আশ্চর্যের হল এবার বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও রাষ্ট্রপতির ভাষণে এনডিএ’র কোনও উল্লেখ ছিল না। দ্রৌপদীর মুখ দিয়ে মোদী সরকার দাবি করেছে, তাগের বিগত দশ বছরের কার্যকালের কৃতিত্বের কারণে তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন হয়েছে। প্রসঙ্গত, আগের সরকারে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। রাষ্ট্রপতির ভাষণে এনডিএ’ ভূমিকার তেমন উল্লেখ না থাকা শরিক নেতাদের নজর এড়ায়নি।
নরেন্দ্র মোদী ২০১৪-তে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি সব দলের মর্যাদা এবং সংসদে বিরোধীদের বিশেষ অধিকারের কথা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও নরেন্দ্র মোদী সে পথে হাঁটেননি। আবার ২০১৯-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সংসদে তাঁর প্রথম ভাষণে মজবুত সরকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন বিজেপি একাই ৩০৩ আসনে জয়লাভ করায়। কিন্তু জোট সরকারকে খাটো করেননি।
আবার অটল বিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৯ সালে তৃতীয়বার ফের সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেবার বিজেপির প্রাপ্ত আসন ছিল ৮৮। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কেআর নারায়ণন বলেছিলেন, আমাদের দেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। সরকার বা বিরোধী, যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় সহমতের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া দরকার।
নারায়ণনের সেই পরামর্শ বাজপেয়ী রক্ষা করেছিলেন এপিজে আবদুল কালামকে রাষ্ট্রপতি করার সময়। কালামের নাম প্রস্তাব করেছিলেন এনডিএ’র শরিক তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিরোধী শিবিরের নেতা সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো মুলায়ম সিং যাদব। বাজপেয়ী তাঁদের প্রস্তাব মতো কালামের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রাজি করান।