বালিগঞ্জ স্টেশনে ফটাস জলের দোকানদার।
শেষ আপডেট: 19th June 2024 19:59
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বছরদশেক আগেও শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেনে উঠলে অবধারিত দেখা মিলত তার। শহরতলির ট্রেন। যাবে সেই সুন্দরবন অবধি। সকালের ভিড় ট্রেনে হরেক কিসিমের মুখরোচক খাবার উঠছে। হঠাৎই কানের পাশে একটা আচমকা পটকা ফাটার মত শব্দ হবে! সচকিত হতেই দেখবেন, পাশের সহযাত্রীর দিকে একটা ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল এগিয়ে ধরলেন হকার। দাম, মাত্র দু' টাকা।
'ফটাস জল'। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক অদ্বিতীয় সম্পদ! বাংলার যে কোনও প্রান্তে যান, বাকি সব কিছু পাবেন, কিন্তু 'ফটাস জল'-এর দেখা পেতে আপনাকে উঠতেই হবে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেনে। বালিগঞ্জ, সোনারপুর, বারুইপুর, মগরাহাট, ক্যানিং, ডায়মণ্ড হারবার, কাকদ্বীপ, লক্ষ্মীকান্তপুর ইত্যাদি যে কোনও শাখার লোকাল ট্রেনে মশলা মুড়ি, চা বা দিলখুশ মিলুক বা না মিলুক, ফটাস জল পাওয়া যাবেই। বিষয়টি অবশ্য আর কিছুই নয়; পরিচিত কোনও ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল সশব্দে খুলে ঠাণ্ডা গলা ভেজানোর সোডা ওয়াটার।
সম্প্রতি বছরদুয়েক হল, লোকাল ট্রেনে ফটাস জল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে পূর্ব রেল। যার ফলে পশরা সাজিয়ে এখন ফটাস জল পাওয়া যায় বিভিন্ন স্টেশনে। যার খোঁজে দ্য ওয়াল চলে গিয়েছিল বালিগঞ্জ স্টেশনে। এক নিত্যযাত্রী জানালেন, 'আমার বয়স আটষট্টি। জ্ঞান হবার পর থেকেই এ' লাইনে ফটাস জল দেখে আসছি। তখন দাম ছিল দশ পয়সা। এখন বেড়ে হয়েছে পাঁচ টাকা।'
কথাটা সত্যি। অপর এক প্রবীণ যাত্রী জানালেন, এ' লাইনে যখন স্টিম ইঞ্জিনের ট্রেন চলত, তখন থেকেই ফটাস জলের জনপ্রিয়তা ছিল। বালিগঞ্জ স্টেশনের এক ফটাস জল বিক্রেতা দ্য ওয়ালকে বললেন, 'বারুইপুর স্টেশনের গায়েই পাঁচ-ছ'টা ফটাস জলের কারখানা রয়েছে। মূলত জলে চিনি বা স্যাকারিন মিশিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড যোগ করে এই সোডা ওয়াটার তৈরি করা হয়।' অপর এক বিক্রেতা বললেন, 'এই গ্যাস কিন্তু ভয়ানক। একটু বেশি ঢোকালেই বোতল ফেটে যেতে পারে। যেহেতু প্রায় সবক'টি বোতলেই প্রবল চাপে এরকম গ্যাস ঢোকানো থাকে, তাই একটা বোতল ফাটলেই তার অভিঘাতে পর পর অনেকগুলো বোতল ফেটে যেতে পারে। যেটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে যে কোনও সময়। কাঁচের বোতল, কাঁচ ছিটকে আহত হতে পারেন নিত্যযাত্রীরা।'
ঠিক কী গ্যাস, বোঝেন না এই লাইনের বিক্রেতা বা ক্রেতাদের একাংশ। বস্তুত, বাজারচলতি বিভিন্ন কোক-মিশ্রিত বা চিনি-মিশ্রিত সোডা ওয়াটার ব্র্যান্ডেরই সস্তা, দিশি সংস্করণ এই ফটাস জল। বাজারে কোনও ভাল ব্র্যান্ডের সোডা ওয়াটারের দাম পড়বে পনেরো থেকে কুড়ি টাকা। সেখানে মাত্র পাঁচ টাকাতেই দেদার মেলে ফটাস জল। দারিদ্র্য এই লাইনের নিত্যসঙ্গী। এক বিরাট সংখ্যক মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায়। এই ভয়ানক গরমে কুড়ি টাকা দিয়ে প্রতিদিন ঠাণ্ডা পানীয় কিনে খাওয়া সম্ভব হয় না। তাঁদেরই ভরসা এই ফটাস জল। গরমে শান্তি, তৃষ্ণা মেটায়, দামেও সস্তা।
দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষের এই ফটাস জল কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? প্রশ্ন উঠেছে আগেও। বস্তুত, নিরাপত্তার দিকটি ভেবেই ট্রেনে ফটাস জল বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে পূর্ব রেল। এক নিত্যযাত্রী জানালেন, ফটাস জলের স্বাস্থ্যের দিক নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন নেই। 'খুব ভাল জল ব্যবহার করে ওরা। কোম্পানি বারুইপুরের। যদি গ্যাস-অম্বল হয়, এই জল খেলে সেরে যায়। ভাল ডিপ-টিউয়েলের জল এগুলো। অসুবিধে হয় না।'
এই কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ঘিরেই বিপদের কথা বলছেন ক্রেতা-বিক্রেতাদের একাংশ। কার্বন ডাই অক্সাইড জলে মিশলে কার্বনিক অ্যাসিড হয়ে যায়। কিন্তু তাতে অ্যাসিডিটি বাড়ার কথা নয়। কারণ আমাদের ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড বের করে দেয়। যার ফলে আমরা যা-ই খাই না কেন, রক্ত ঈষৎ ক্ষারীয় হয় সবসময়। কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে তখন বিপদের সম্ভাবনা থাকে। তারপরেও অনেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমাতে চান না। কারণ? ফটাস জল বিক্রেতাদের বক্তব্য, ওপেনার দিয়ে খোলার সময় 'ফটাস' করে শব্দ ঠিকমত না হলে অনেক খদ্দেরই কিনতে চান না। ভাবেন, বুঝি জলে ঠিক মত 'পাওয়ার' নেই।