ফরাসি ওপেনের মাঠে অলিম্পিক যুদ্ধে নামার আগে চোট ভাবাচ্ছে নাদালকে।
শেষ আপডেট: 27th July 2024 16:12
কনসাল নেপোলিয়ন বোনাপার্তের সঙ্গে তুলনাটা করা যায় বোধ হয়। জন্মেছিলেন ভূমধ্যসাগরের মাঝে, কর্সিকা দ্বীপে। বাবা-মা দুইজনই আদতে ইতালীয় বংশোদ্ভূত। বাবার দিকে থেকে শিকড় ছিল ইতালির তাস্কানি অঞ্চলের দিকে। মায়ের পূর্বপুরুষরা লোম্বার্দির। অথচ ফরাসি ইতিহাসের কয়েকটা অধ্যায় একাই অন্যভাবে লিখে দিয়েছিলেন নেপোলিয়ন। যার অন্যতম, বিপ্লবের পরে আতঙ্ক ও অরাজকতাকে দূরে সরিয়ে সেইন নদীর তীরে অবস্থিত প্যারিসকে আবার একটা বিশ্বমানের শহর ও শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত করা। তারপরে সেইন দিয়ে বহু জল বয়েছে। দুই বিশ্বযুদ্ধে ছারখার হয়ে গিয়েছে প্যারিস। তবু নেপোলিয়নের বানানো বহু চোখধাঁধানো সৌধ আজও প্যারিসের প্রতীক হয়ে রয়ে গিয়েছে।
রাফায়েল নাদালের নামটা পর-পর নিলে একটু হোঁচট খেতে হয় বটে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো! টেনিস সাম্রাজ্যে প্যারিসের গৌরবময় ইতিহাসের একটা অধ্যায় কি স্রেফ তাঁর একার হাতে লেখা নয়? তিনি তো আদতে স্পেনীয়। ফ্রান্সের প্রতিবেশী। কিন্তু টেনিস-দুনিয়ায় 'ফরাসি ওপেন' শব্দটা এলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও বোধ হয় তাঁর নাম দিয়েই আলোচনা শুরু হবে। একটা প্রজন্ম সম্ভবত ফরাসি ওপেনের লালমাটির ইতিহাস চিনতে শিখেছে তাঁর নামে।
১৯৯২ সালের পর এই প্রথমবার অলিম্পিক টেনিসের ম্যাচ হবে লালমাটির কোর্টে। একেবারে রোলাঁ গারোর ঐতিহাসিক ফিলিপ শ্যাত্রিয়েঁ কোর্টে। যে মাঠ ফরাসি ওপেনের জন্য দুনিয়ার প্রতিটি কোণায় পরিচিত। যে মাঠ রাফায়েল নাদালের এলিজি প্রাসাদ। চোদ্দটা ফরাসি ওপেন খেতাব আছে তাঁর ঝুলিতে। প্রথম জিতছিলেন ২০০৫ সালে। কার্লোস আলকারাজ তখন দু' বছর বয়সে হাঁটতে শিখছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট তখন জাক শিরাক। তারপর নিকোলাস সারকোজি, ফ্রাঁসোয়া ওঁলান্দ হয়ে এখন ইমানুয়েল ম্যাকরঁ এলিজির অধিবাসী। তাঁরও তখত টালমাটাল। অথচ ম্যাকরঁর আমলে, ২০২২-এ ফিলিপ শ্যাত্রিয়েঁ কোর্টের ধুলোয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন নাদাল। ওই শেষবার। ফরাসি ওপেনের ইতিহাসে এই নজির আর কারোর নেই।
অলিম্পিক উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে বোঝা গিয়েছে, তারকাখচিত এই রাতেও স্রেফ একাই দর্শককে উন্মাদ করে দিতে পারেন দুই সেকেলে তারকা! নাদাল তাও অলিম্পিকে আছেন। ফুটবল দুনিয়া থেকে তাঁর বহু আগেই অবসর নিয়েছেন জিনেদিন জিদান। অথচ ফরাসি ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ তারকা যখন অলিম্পিক মশালটা তুলে দিলেন নাদালের হাতে, কেমন শিহরণ দিল গায়ে। দুই তারার একত্রে মহাজাগতিক বিস্ময় কি? নাকি নিতান্তই স্বাভাবিক? ভিক্টর হুগোর শহরে, উপন্যাস-কবিতা-ভালবাসার শহরে এটাই দেখতে হয়?
অথচ নাদাল জানেন, আজ তাঁর ঘরের মাঠেও তাঁর কঠিন পরীক্ষা। রোলাঁ গারোঁ তার সমস্যা নয়। এই মাঠের ধুলোয় দাগ সাদা দাগ মুছে গেলেও তাতে রাফায়েল নাদালের কীর্তি লেখা থাকবে। কিন্তু নাদালের শত্রু তাঁর একাধিক চোট। বিশেষ করে, হাঁটু। চোটে রীতিমত জেরবার স্পেনীয় তারকা। দীর্ঘদিন বড় টুর্নামেন্টের বাইরে। তাঁকে অনুশীলন করাতেও স্পেন দলের ফিজিওকে নজর রাখতে হচ্ছে। স্পেনীয় কর্তারা কোনও বাড়তি কথায় যাচ্ছেন না। সব মিলিয়েই একটা সাবধানী ভাব।
নাদাল অবশ্য চাপমুক্তভাবেই অনুশীলন করেছেন। অলিম্পিক তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। ভিলেজে তিনি অন্তত সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা। ভারতীয় খেলোয়াড়দের অনেকেই নাদালের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। মোট তিনবার অলিম্পিক খেলেছেন নাদাল। প্রথম ২০০৪ সালের এথেন্স। তার পরের বছর থেকে ফরাসি ওপেন শাসন শুরু করেন নাদাল। ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে সেমিফাইনালে নোভাক জোকোভিচ ও ফাইনালে ফেরনান্দো গঞ্জালেসকে হারিয়ে সোনা জিতেছিলেন নাদাল। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে স্পেনের পতাকা বয়েছিলেন নাদাল। সিঙ্গলসে না পারলেও ডাবলসে মার্কো লোপেজকে নিয়ে সোনা জিতে রিও ছেড়েছিলেন নাদাল।
আজ শনিবার, অলিম্পিকের প্রথম দিনেই রোলাঁ গারোতে ধুন্ধুমার টেনিস যুদ্ধ। একই দিনে কোর্টে নামবেন নাদাল, জোকোভিচ, কার্লোস আলকারাজ, ইগা শিয়নটেক, নাওমি ওসাকা। দিনের প্রথম ম্যাচে ফিলিপ শ্যাত্রিয়েঁ কোর্টে নামবেন চারবারের ফরাসি ওপেন চ্যাম্পিয়ন পোল্যান্ডের শিয়নটেক। তাঁর প্রতিপক্ষ রোমানিয়ার ইরিনা-ক্যামেলিয়া বেহু। তারপরের ম্যাচে জোকোভিচ সিঙ্গলসে খেলবেন অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু এবডেনকে। তারপরে রাতের সেশনে ধুন্ধুমার ডাবলস ম্যাচে আর্জেন্তিনার ম্যাক্সিমো গঞ্জালেজ ও আন্দ্রে মোলতেনির বিরুদ্ধে নামছেন নাদাল ও উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন কার্লোস আলকারাজ। সব শেষে, রাতের ম্যাচে একেবারে দুই প্রাক্তন বিশ্ব ১ নম্বর তারকার লড়াই। জার্মানির অ্যাঞ্জেলিক কের্বেরের বিরুদ্ধে নামছেন জাপানের নাওমি ওসাকা।
ডাবলসে না হয় আলকারাজ আছেন। আর্জেন্তিনার প্রতিপক্ষরা খুব হেভিওয়েট নন। কিন্তু সিঙ্গলস? স্পেনীয় টেনিস দলের কর্তারা এই নিয়ে কোনও কথা বলতে চাইছেন না। কিন্তু সূচি তো ভাবাচ্ছে। কাল, রবিবারই সিঙ্গলসে নামার কথা নাদালের। হাঙ্গেরির মার্তন ফুকসোভিক্স তাঁর প্রতিপক্ষ। কিন্তু সেই ম্যাচ জিতলে, দ্বিতীয় রাউন্ডে নাদাল পড়বেন একেবারে নোভাক জোকোভিচের সামনে। ফরাসিটা নাদালের থেকে ভাল বলেন জোকোভিচ। কিন্তু চোটের সঙ্গেও তাঁর অদ্ভুত সম্পর্ক। নাদাল চোট সারিয়ে ফিরতেই নাজেহাল হচ্ছেন। জোকোভিচ সেখানে ফরাসি ওপেনের মাঝপথে অস্ত্রোপচার করিয়ে উইম্বলডনে গিয়ে ফাইনাল খেলে এলেন। এই অবস্থায় অনেকেই মনে করছেন, সম্ভবত জোকোভিচের সামনেই ৩৮ বছরে শেষ ম্যাচ খেলে ফেলতে চলেছেন নাদাল।
প্যারিস বলে নেপোলিয়নের নাম দিয়ে শুরু করতে হল। তবে শেষপাতে অপর এক তারকার নাম না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ইউরোর রুদ্ধশ্বাস ফুটবল-যুদ্ধেও রোনাল্ডো-ভক্তরা চেয়েছিলেন, অন্তত বর্ণময় কেরিয়ারের শেষটা ইউরো জিতে বর্ণময়ভাবেই শেষ করুন রোনাল্ডো। হয়নি। নাদালের প্রিয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক্তন তারকাকে বয়সের সঙ্গে যুদ্ধ করে মাঠ ছাড়তে হল। নাদালের গল্পটাও কি প্রায় একইরকম হতে পারে? নাকি পাল্টে দেবেন স্পেনীয় তারকা? ফরাসি ওপেনের মাঠে সোনা জিতে নাদাল মাঠ ছাড়ছেন, এই দৃশ্যের অপেক্ষাতেই এবার প্রহর গোনা শুরু।