শেষ আপডেট: 10th October 2023 10:01
সারা দেশে জাতি সমীক্ষার দাবি নিয়ে দলকে পথে নামার পরামর্শ দিলেন সনিয়া গান্ধীও। সোমবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রারম্ভিক ভাষণে দলীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে কাস্ট সেন্সাস নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। জানিয়ে দেন, বিহারে নীতীশ কুমার কাস্ট সেন্সাস করিয়ে পথ দেখিয়েছেন। কংগ্রেস দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে গোটা ভারতে জাতি সমীক্ষা করাবে। বিকেলে সনিয়া গান্ধীও কাস্ট সেন্সাসের প্রসঙ্গ তুলে জানিয়ে দেন, দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি শতভাগ একমত।
সনিয়া লোকসভা এবং বিধানসভায় মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ নিয়েও মুখ খোলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে বলেন, অকারণে জনগণনা এবং আসন পুনর্বিন্যাসের পর সংরক্ষণ চালু করার সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। কংগ্রেস ক্ষমতায় আসা মাত্র এই সংরক্ষণ চালু করে দেওয়া হবে।
সনিয়া এদিন সংরক্ষণ নিয়েও নতুন কথা শোনান। বলেন, এখন সংরক্ষণের পরিমাণ ৫০ শতাংশের বেশি করার উপায় নেই। কিন্তু ওবিসি সংরক্ষণ বাড়াতে কংগ্রেস সরকার ৫০ শতাংশের সীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংসদে বিল আনবে। কাস্ট সেন্সাস এবং ওবিসি সংরক্ষণ বৃদ্ধির দাবি নিয়ে দলকে অবিলম্বে মাঠে নামার পরামর্শ দেন প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি।
কাস্ট সেন্সাস নিয়ে আর এক প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী প্রথম থেকেই সরব। নবীন নেতার সঙ্গে সুর মেলান সভাপতি খাড়্গেও। সনিয়ার সোমবারের ভাষণের পর কাস্ট সেন্সাস নিয়ে কংগ্রেস হাইকমান্ড দলের অবস্থান স্পষ্ট করে দিল। অর্থাৎ বিহারে নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদরা যে দাবি তুলেছেন তা এখন কংগ্রেসেরও। বিহারের দুই নেতাই চান ওবিসি এবং তফসিলি জাতি ও উপজাতি সংরক্ষণ বৃদ্ধি করা হোক।
প্রশ্ন হচ্ছে বরাবর কাস্ট পলিটিক্স বা জাতপাতের রাজনীতির বিরোধিতা করে আসা কংগ্রেস নেতৃত্ব জাতি সমীক্ষা নিয়ে এতটা উৎসাহী হয়ে উঠেছে কেন। কেন রাহুল গান্ধীর মতো একবিংশ শতাব্দির নেতা ‘জিতনা আবাদি উতনা হক’ বলে স্লোগান তুলেছেন। কেন বলছেন, জাতিগত সমীক্ষা হল জাতির ডিজিটাল এক্স-রে। রাহুলের কথায়, ভারতকে চিনতে হলে জাতিগত সমীক্ষা ছাড়া অসম্ভব।
ভোট-রাজনীতিতে কংগ্রেসের এই অবস্থান বদল যে পদ্ম শিবিরের শিরপীড়ার কারণ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি অভিযোগ তুলেছেন, কংগ্রেস জাতপাতের রাজনীতি করে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চাইছে।
আশ্চর্যের হল, সাড়ে তিন দশক আগে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং ওবিসি সংরক্ষণ চালু করার কথা ঘোষণা করা পর তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি তথা লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাজীব গান্ধী একই কথা বলেছিলেন যা হাত শিবির সম্পর্কে আজকের প্রধানমন্ত্রী মোদী বলছেন। রাজীবের বক্তব্য ছিল একবিংশ শতাব্দির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জাতের রাজনীতি অচল।
শুধু রাজীব নন, নেহরু, ইন্দিরাও জাতের রাজনীতি থেকে দলকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। ইন্দিরার ‘গরিবি হটাও’-এর ডাকে উঁচু জাত, নিচু জাত ছিল না। ইন্দিরার কথা ছিল, ‘না জাত পর, না পাত পর রাজনীতি করনি হ্যায়।’ সেই কারণেই ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের পাতা উল্টে দেখেননি তিনি। একই পথে চলেন রাজীবও। ওই কমিশন গঠন করেছিল জনতা পার্টির সরকার। ইন্দিরা, রাজীবরা সাফ জানিয়েছিলেন, তফসিলি জাতি, উপজাতি ছাড়া আর কেনও সম্প্রদায় সংরক্ষণের সুবিধা পাবে না। বাকিদের যোগ্যতা দিয়ে চাকরি, শিক্ষার সুবিধা পেতে হবে।
তারপর গত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। রাজীব যে রাজনীতি বাতিল করেছিলেন সেটাই আঁকড়ে ধরছে তাঁর দল এবং সহধর্মিণী সনিয়া এবং পুত্র রাহুল।
আসলে ওবিসি বা অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণির লোকেরা বরাবর কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্কের অংশ ছিল। উচ্চবর্ণ ও মধ্যবর্ণের কথা বিবেচনায় রেখে কংগ্রেস আলাদা করে ওবিসি এবং তফসিলিদের স্বার্থে এতকাল সরব হয়নি। আর সেই সুযোগে বিহার, উত্তর প্রদেশ সহ হিন্দি বলয়ে এই অংশের ভোট চলে গিয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, জেডিইউ-র মতো দলগুলির ঝুলিতে। অন্যদিকে, দাক্ষিণাত্যের আঞ্চলিক দলগুলি প্রথম থেকেই নিজেদের মতো করে জাতের রাজনীতির চর্চা করে এসেছে। আঞ্চলিক দল ঘুরে সেই ভোট বিজেপিতে যাওয়াই এখন কংগ্রেস-সহ বাকিদের চিন্তার কারণ। তাই নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদদের মতো আঞ্চলিক নেতার দাবিকে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব সিলমোহর দিচ্ছে।
ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে কংগ্রেসের বাড়তি উৎসাহের কারণ অবশ্য ভিন্ন। ওবিসি তালিকাভুক্তির মানদণ্ড ধর্ম নয়, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান। ফলে মুসলিম-সহ সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সিংহভাগ এই তালিকার অংশ। ওবিসি সংরক্ষণ বৃদ্ধির মাধ্যমে সংখ্যালঘু কল্যাণ সম্ভব, এই অঙ্ক বিবেচনায় রেখে এগচ্ছে হাত শিবির। এই ব্যাপারে কংগ্রেসের আরও একটি শক্ত জায়গা হল, প্রয়াত বিশ্বনাথপ্রতাপ ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ চালু করার কথা ঘোষণা করলেও তা কার্যকর করেছিলেন কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও।
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, বিজেপি হিন্দুত্বের ছাতার তলায় বর্ণ নির্বিশেষে সব হিন্দুকে একত্রিত করার যে কর্মসূচি নিয়ে এতদূর এগিয়েছে ওবিসি অস্ত্রে তা আটকে দেওয়া সম্ভব।
উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি বাদে বাকি ভারতে কাস্ট সেন্সাসের ফল বিহারের থেকে আলাদা হওয়ার কথা নয় নানা সময়ে হওয়া নমুনা সমীক্ষায় তা স্পষ্ট। বিহারে জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশ ওবিসি বলে জাতি গণনায় জানা গিয়েছে। কংগ্রেস মনে করছে, হিন্দু সমাজের পান্তিক জনগোষ্ঠীকে কাছে টানার সেরা উপায় ওবিসি সংরক্ষণ বৃদ্ধি। তার জন্য আশু প্রয়োজন কাস্ট সেন্সাস। একই সঙ্গে কংগ্রেসের অঙ্ক হল, কাস্ট সেন্সাস ও ওবিসি সংরক্ষণের ইস্যুতে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে দলের মৌলিক রাজনৈতিক দূরত্ব অনেকটা কমিয়ে ফেলা।