শেষ আপডেট: 5th August 2024 12:26
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বাংলাদেশের ফের জাতীয় সরকার গঠনের দাবি উঠেছে। ফের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসের নাম জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভেসে উঠেছে। ইউনুস কয়েকদিন যাবত প্যারিসে। সেখানে অলিম্পক কমিটির উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করছেন। সোমবার তাঁর দেশে ফেরার কথা। দেশে চলমান আন্দোলনে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সাহায্য চেয়ে তিনি নতুন করে আওয়ামী লিগ সরকারের বিষ নজরে পড়েছেন।
জাতীয় সরকারের প্রধান হিসাবে শহিদূল আলমের নামও বিবেচনায় আছে। তিনি একজন সাংবাদিক, একটি মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রধান এবং শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফটোগ্রাফার। হাসিনা সরকারের সময়ে তাঁকে পদে পদে অপদস্থ করার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংসটে তত্ত্বাবধায় সরকারের ধারণাও পুরনো। মূলত জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ধরনের সরকার গঠনের দাবি ওঠে। এ বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি তত্ত্বাবধাক সরকারের অধীনে ভোট করার দাবিতে অনড় ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা ভোট বয়কট করে।
আওয়ামী লিগ সরকার দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ভোটে। খালেদা জিয়ার সরকারকে হটিয়ে দায়িত্ব নিয়েছিল তত্ত্বাবধয়াক সরকার। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হাসিনা সরকার তত্ত্বাবধাক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
এবারের সংকটে জাতীয় সরকার গড়ার প্রস্তাব এলেও আওয়ামী লিগ নেত্রী শেখ হাসিনা নানা পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তাঁর পদত্যাগের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। দল ও শরিক নেতাদের তিনি বলেছেন, ছাত্রদের দাবি মেনে নির্ধারিত সময়ের আগেই কোটা বিরোধী দাবি মেনে নিয়েছি। ছাত্ররা এখন সরকার পতনের দাবি তুলেছে বিরোধী দলগুলির উস্কানিতে। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনৈতিক মোকাবিলাও চান তিনি। দেশবাসীকেও পাশে চেয়েছেন তিনি। এমনকী রাষ্ট্রসংঘেরও। তাঁর বক্তব্য রাষ্ট্রসংঘের দেখা উচিত কীভাবে একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চলছে।
হাসিনা তাঁর এই অভিমত প্রকাশ করেন আওয়ামী লিগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোটের নেতাদের বৈঠকে। সেখানে ওয়াকার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা হাসানুল হক ইনুরা আওয়ামী লিগ নেত্রীর সিদ্ধান্তে সায় দেন। এরপপরই ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে আওয়ামী লিগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গির কবীর নানক ঘোষণা করেন, আন্দোলনকারীরা আমাদের দুর্বল ভাবলে ভুল করবেন। আমরা অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। আর দেব না। যদিও হাসিনা বলেছেন, ছাত্ররা চাইলে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে গণভবনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে। আওয়ামী লিগও দলের তিন নেতাকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু বরফ গলেনি।
ওয়াকিবহাল মহলের খবর, বরিবারের আওয়ামী লিগের প্রত্যাঘাত দলটির অনড় সিদ্ধান্তেরই প্রতিফলন। সংঘর্ষে যে একশো ব্যক্তির প্রাণ গিয়েছে তাদের অনেকেই শাসক দলের নেতা-কর্মী। দিনের শেষে আওয়ামী লিগ নেতৃত্ব আত্মবিশ্বাসী দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ভাঙেনি।
ইউনুসকে এর আগে তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে ২০০৭ থেকে প্রায় দু-বছর তত্ত্বাবধায় সরকার ক্ষমতায় ছিল। ইউনুস রাজি না হওয়ায় সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন আর এক অর্থনীতিবিদ ফখরুদ্দিন আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর সমান ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করেন। সেই সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পিছনে ‘মাইনাস-টু ফরমুলা’ কাজ করেছিল বলে ওয়াকিবহাল মহলের মত। বলা হয় সেনা এবং আমেরিকা-সহ কিছু বিদেশি রাষ্ট্র চেয়েছিল বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনীতিক শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে তাদের পাকাপাকিভাবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া। তারপর ইউনুস বা তাঁর মতো রাজনীতির বৃত্তের বাইরের কাউকে প্রধানমন্ত্রী করা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা সেবার সফল হয়নি। পরে ইউনুস একটি রাজনৈতিক দল গড়েও সফল হননি। তাছাড়া একাধিক অবকাশে বলেছেন, দেশ চালানোর বাসনা তাঁর নেই। যদিও বারে বারেই রাজনৈতিক সংসটে তাঁর নাম সামনে আসে। আওয়ামী লিগের অভিযোগ, মার্কিন সরকারের দীর্ঘদিনের বাসনা ইউনুসকে বাংলাদেশের শাসকে ভূমিকায় দেখা।
এবার বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একাংশ এবং একাধিক নাগরিক সংগঠন জাতীয় সরকার গঠনের দাবি তুলেছে ইউনুস অথবা শহিদুল আলমের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। তবে বিশ্ব পরিচিতি এবং নোবেল বিজেতা হওয়ায় ইউনুসের নামই সর্বাগ্রে আছে। তাঁর পাশে আছে আমেরিকা। বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে তাঁর সখ্য দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা তুলে নিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোনও করেছিলেন সাবের মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিনটন।
শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ইউনুসের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দুর্নীতির মামলায় তাঁর বিচার চলছে দেশে। তিনি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং গ্রামীণ টেলিফোন কোম্পানির অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ। তিনি এখন জামিনে মুক্ত।
জাতীয় সরকারের ধারণাটি হল নির্বাচন কমিশনের নথিবদ্ধ দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন। সেই ক্ষেত্রে বর্তমান আওয়ামী লিগও তাতে জায়গা পাবে। সেই সরকার দেশে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার এবং অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর পর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করা হবে।
এমন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি ওঠায় অনেকেই মনে করছেন আন্দোলনকারীদের পিছনে বিএনপি-র যোগ আছে। কারণ, ২০২২-এ জাতীয় সরকার গড়ার দাবি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল প্রধান বিরোধী দলটি। কিন্তু সাড়া পায়নি। পরে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি তোলে।
পড়শি দেশে একাধিকবার রাজনৈতিক সংকটে জাতীয় সরকার গড়ার প্রস্তাব এসেছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় সেটিকেও জাতীয় সরকার হিসাবে গড়ে তোলার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আওয়ামী লিগ নেতৃত্ব তা মানেনি।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুরকে হত্যার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ প্রস্তাব দিয়েছিল দেশ শাসনে জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। সেই দলের নেতা কর্নেল আবু তাহেরের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলাকালেই জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন। পরে আর এক সেনা শাসক হুসেই মহম্মদ এরশাদও ক্ষমতায় এসে একাধিক দলের নেতাদের ভাঙিয়ে এনে নিজের সরকারকে জাতীয় সরকারের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। একই চেষ্টা করেছেন খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাও।
তবে জাতীয় সরকার ধাঁচের আগের সরকারগুলির প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সরকার প্রধানেরা তাঁর শাসনামলকে সকলের সরকার হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এবার প্রেক্ষাপট আলাদা। ছাত্ররা শনিবার থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। ফলে কোটা আন্দোলন চলে গিয়েছে সরকার পতনের আন্দোলনে। হাসিনা সরে গেলে দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে সেই ভাবনা থেকেই জাতীয় সরকার, জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার ইত্যাদি নামে বিকল্পের কথা বলা হচ্ছে। আর প্রস্তাবিত সেই সরকারের মাথায় মহম্মদ ইউনুসকে বসানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে খবর।