Advertisement
Advertisement
শেষ আপডেট: 3 March 2024 17:37
ইতিহাসে বারে বারে দেখা গিয়েছে, সাধারণ থেকে অতি সাধারণ ঘরের কোনও মানুষ, তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে অতিমানব বা মহামানব হয়ে উঠেছেন। রোগ, জরা, দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে মানুষের কাছে ত্রাতা হয়ে উঠেছেন তাঁদের কেউ কেউ। যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের অনেকে মনে করেন পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেলে এভাবেই জন্ম নেন কোনও অবতার।
বাংলায় গত দেড়-দু’বছর ধরে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কেও বহু মানুষ দেবজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছেন। ভারতবর্ষ জুড়ে এখন নতুন কর্মসংস্থানের আকাল রয়েছে। বাংলা তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। উপরি রাজ্যে সরকারি স্কুলে নিয়োগে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছিল তাতে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল বাংলার যুব সমাজের মধ্যে।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সেই সব মামলায় মাইলফলক রায় দিয়েছেন। ইডি, সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে আশার আলো দেখিয়েছেন বাংলার মানুষকে। আবার তদন্তে দেরি হলে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকেও ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি। তাঁর নির্দেশে যে তদন্ত হয়েছে, তার অভিঘাতেই প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন জেলবন্দি। প্রাক্তন উপাচার্য, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, কলেজ সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহ শিক্ষা দফতরের বেশ কিছু মুরুব্বি এখন জেলের ভাত খাচ্ছেন। রাতারাতি এই সব গ্রেফতারিতে বিচারব্যবস্থার প্রতি এ রাজ্যের বহু লক্ষ মানুষের আস্থা বেড়ে গিয়েছে।
তা ছাড়া বিবিধ মামলার শুনানিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নিয়মিত ও ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণগুলি ছিল শাণিত ও তীক্ষ্ণ। যেন বেছে বেছে শব্দচয়ন করেছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলি বারবার বিদ্ধ করেছে বাংলার শাসক দল তৃণমূলকে। তাতে আরও সমাদর পেয়েছেন বিচারপতি। হয়তো এতে উৎসাহও পেয়েছেন। সম্ভবত সেই কারণেই এজলাসের বাইরেও তিনি শাসক দল সম্পর্কে ঝাঁঝালো সব মন্তব্য করেছেন। এমনকী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর আয়ের উৎস কী তা সাধারণ মানুষের জানার অধিকার রয়েছে। অভিষেকের উচিত তাঁর আয় ব্যায় ও সম্পত্তির হিসাব সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা, ইত্যাদি।
এই সব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়েই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এখন বাংলার ঘরে ঘরে এক পরিচিত মুখ। কেউ তাঁকে বলছেন মহামানব, কেউ বলছেন মসিহা, কেউ বা বলছেন বাংলার নবজাগরণের কান্ডারি।
এহেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় রবিবার দুপুরে ঘোষণা করেছেন যে তিনি মঙ্গলবার বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে চলেছেন। তারপর তিনি রাজনীতিতে নামবেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অগস্ট মাসে কর্মজীবনের (abhijit gangopadhyay retirement date) মেয়াদ শেষ হবে। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর অবসর নিতে আর ৬ মাস বাকি। তার আগে তিনি যখন রাজনীতিতে নামছেন, তখন ধরে নেওয়া যেতেই পারে লোকসভা ভোটের কথা তাঁর মাথায় রয়েছে। এবং কোনও অঘটন না ঘটলে প্রার্থী হতে পারেন তিনি।
কিন্তু কোন দলে যোগ দেবেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়? তিনি এদিন জানিয়েছেন, তণমূলে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া তৃণমূলের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতেই তিনি রাজনীতিতে নামছেন। তা বাদ দিয়ে বিজেপি, কংগ্রেস বা সিপিএম যে কোনও পার্টিতে যোগ দিতে পারেন তিনি। তবে ঠিক কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন তা রবিবারই খোলসা করতে রাজি হননি বিচারপতি। শুধু এটুকু জানিয়েছেন যে, তাঁকে লোকসভা ভোটে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি ভেবে দেখবেন।
ঠিক এইখানেই আমার একটা প্রত্যাশা রয়েছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যদি লোকসভা ভোটে প্রার্থী হন, তাহলে তাঁর উচিত দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা বা ডায়মন্ড হারবার আসন থেকেই নির্বাচনে লড়া। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা আসন হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের আসন। এই আসন থেকে ছ’বার লোকসভায় জিতেছেন মমতা। আর ডায়মন্ড হারবার হল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচন কেন্দ্র।
সাম্প্রতিক কালে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অধিকাংশ সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল তৃণমূল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার। অর্জুনের মতোই যেন এ ব্যাপারে তাঁর লক্ষ্য স্থির। বিশেষ করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাপারে বারবারই ক্ষুরধার সমালোচনা করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এমনকী আদালত অবমাননার দায়ে অভিষেককে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, ঠিক এই সব কারণেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের উচিত অভিষেকের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া বা দক্ষিণ কলকাতা আসন থেকে ভোটে লড়া। কেননা মহামানবের কাছে সাধারণ মানুষ এক মহানায়কোচিত ব্যবহার ও পদক্ষেপই আশা করে। ঠিক যেমন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন। অধীরের কথায়, ওনার মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য লড়া উচিত। অর্থাৎ অধীরও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প হিসাবে দেখতে চাইছেন।
কিন্তু বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তা যদি না করেন, পরিবর্তে বিজেপিতে যোগ দিয়ে তমলুকের মতো কোনও সহজ আসন বেছে নেন, তা হলে বাংলার অনেক মানুষই হয়তো আশাহত হবেন। কারণ, তাঁদের তখন মনে হতে পারে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তো মহামানবের মতো সাহস দেখাতে পারলেন না। ভোটের আগেই তিনি তো অঙ্ক কষে ফেললেন। যে আসনে জয় সহজতর হতে পারে, সেটাই বেছে নিলেন। আর পাঁচ জন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ যা করতেন তিনিও তো সেই পথে হাঁটলেন।
তমলুক এমনিতেই বিজেপির জন্য ইতিবাচক। শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক দুর্গ। ওই আসন জেতাতে শুভেন্দু যে সমস্ত শক্তি ঢেলে দেবেন তাতে সন্দেহ নেই। তা সে প্রার্থী যেই হোন না কেন!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবে বলে গিয়েছিলেন, খ্যাতিরও বিড়ম্বনা আছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কেও মনে রাখতে হবে, তাঁর খ্যাতির শুধু বিড়ম্বনা নেই, তাঁর থেকে বহু প্রত্যাশাও রয়েছে। কারণ তিনিই নিজেকে নির্ভীক, অকুতোভয় ও সমাজ সংস্কারক হিসাবে বাংলার মানুষের সামনে মেলে ধরেছেন। তিনিই বলেছেন, বাংলা এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাকে মুক্তির আলো দিতে হবে। তাঁরই পছন্দের কথা হল, ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্য দেখেছি, এখন দেখছি চৌর্য সাম্রাজ্য।
সুতরাং এমন এক সংস্কারমনস্ক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন ও অকুতোভয় মানুষের থেকে শুধু একটাই প্রত্যাশা। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সরাসরি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হোন। নিদেনপক্ষে দক্ষিণ কলকাতা। সহজ আসনে প্রার্থী হবেন না প্লিজ। যাতে কেউ আপনাকে কোনওদিন, কখনও সুবিধাবাদী বলতে না পারে।
Advertisement
Advertisement