শেষ আপডেট: 2nd February 2025 11:04
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ‘নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান’ নামে একটি ছোটগল্প লিখেছিলেন মতি নন্দী। এই গল্পের যদিও ময়দানি সংযোগ তেমনটা নেই। তবু কাহিনির মূল স্পন্দনটুকুর সঙ্গে ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহার জীবনের ওঠানামা, আসা-যাওয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর আগমন প্রত্যাশা জাগানো৷ আর বিদায়লগ্নের অবসরে মিশে থাকে বিষণ্ণতা, অপ্রাপ্তি, প্রত্যাশাপূরণ সত্ত্বেও ‘আরও কিছু রয়ে গেল বাকি'-র সুর।
২০০৭ থেকে ২০২৫৷ যাত্রাপথটা বেশ দীর্ঘ৷ সময়ের নিরিখে তো বটেই। উত্থান-পতন, আশা-নিরাশার নিক্তিতেও খুব মসৃণ কিছু নয়। অবসর নিলেন শনিবার। পূর্ব ঘোষণামতো। আগে থেকেই মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছিল পাঞ্জাবকে হারালেও বাংলার রঞ্জি অভিযান এবারের মতো শেষ হতে চলেছে। বাকি দলগুলির হারজিতের অঙ্ক মিলে যাওয়া একপ্রকার অসম্ভব ছিল। তার কোনওটাই বাংলার পক্ষে যায়নি। বিহার পারেনি কেরলকে বিরাট ব্যবধানে হারাতে। তাই পাঞ্জাবকে এক ইনিংস ও ১৩ রানে পর্যুদস্ত করার পরেও বিদায় নিতে হল।
আর এই লগ্নেই অবসর নিলেন ঋদ্ধিমান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। প্রথম ইনিংসে শূন্য করে আউট হন। কিন্তু রেকর্ডের খাতায় এটা তো নিছকই একটা তথ্য হয়ে থেকে যাবে। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেবে ম্যাচ শেষে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে বিদায় অভিবাদন গ্রহণ, বিপক্ষের খেলোয়াড়দের দেওয়া ‘গার্ড অফ অনারে'র সৌজন্য, পরিবার-স্বজনের সঙ্গে তোলা গ্রুপ ফোটো এবং স্ত্রী রোমি, যিনি জীবনের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার সময় পাশে ছিলেন, বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভরসার হাত, তাঁর সঙ্গে নিভৃতে কাটানো দু-চার পল। আর এই টুকরো টুকরো, খণ্ড-বিখণ্ড মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল ইডেন। যে উদ্যানে তাঁর বাংলার জার্সি গায়ে অভিষেক, অভিসার। এবং একদিন অভিমান ভরে চলে গিয়েও শেষমেশ তিক্ততা ঝেরে ফিরে আসা।
ঋদ্ধির ‘ফিরে দেখা'য় অবশ্য বিষাদ নয়, মালিন্য নয়। ধরা দিল সৌজন্য, স্বীকৃতি ও সৌহার্দ্যের ছোঁয়া। গতকাল নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ক্রিকেটের সমস্ত ফরম্যাটকে বিদায় জানানোর পর তিনি লেখেন, ‘যাত্রা শুরুর পর আঠাশ বছর পেরিয়ে গেল। নিজের দেশ, রাজ্য, বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা, ক্লাব, কলেজ ও স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করা অত্যন্ত সম্মানের৷ আজ আমি যতটুকু, আজ আমি যেখানে, তার পুরোটাই ক্রিকেটের জন্য। এই যাত্রাপথ উত্থান-পতন, স্মরণীয় স্বীকৃতি ও আনন্দদায়ক মুহূর্তের সাক্ষী। যা আমায় মানুষ হিসেবেও এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু যে কোনও বিষয়েরই একটা শেষ থাকে। এই কারণে আমি সমস্ত ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আমি বাকি জীবন আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে কাটাব। আর অপেক্ষা করব নতুন কোনও অধ্যায়ের, নতুন কোনও শুরুয়াতের। আমার বাবা-মা, দাদা (অনির্বাণ সাহা) ও আমার পরিবার যেভাবে পাশে থেকেছেন, নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করে আমায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন, তার জন্য আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ। আমার স্ত্রী (রোমি), মেয়ে (অন্বি) ও ছেলে (অন্বয়) আমায় নানান চড়াই-উতরাইয়ে পাশে থেকেছেন, ভরসা জুগিয়েছেন। যে কারণে জীবনের সমস্ত বাধাবিপত্তি আমি অতিক্রম করতে পেরেছি৷ তাঁদের সকলকে ধন্যবাদ।’
২০০৭ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মঞ্চে প্রবেশ। এরপর মরশুমের পর মরশুম ধরে গেঁথে চলা রেকর্ড যে কোনও উদ্যমী ক্রিকেটারের কাছে যথেষ্ট শ্লাঘনীয়। ১৪২ ম্যাচ, ২১০টি ইনিংস, ৭১৬৯ রান। গড় ৪১.৪৩। স্ট্রাইক রেট ৪৮.৬৫। শতরান ১৪টি, অর্ধশতরানের সংখ্যা ৪৪। দেশের হয়ে ৪০ খানা টেস্টে ১৩৫৩ রান। ৩টি সেঞ্চুরি ৬টি হাফ-সেঞ্চুরিতে সাজানো। আইপিএলে কলকাতা, চেন্নাই, পাঞ্জাবের মতো একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলেছেন। টেস্টে যিনি ধরে খেলায় স্বচ্ছন্দ, টি-টোয়েন্টির মঞ্চে তিনিই বিদ্রোহী মেজাজে ধরা দেন। ৪০-এর স্ট্রাইক রেট ১২০ পেরিয়ে যায় এক অদ্ভুত রহস্যে!
জীবনের সুর-তাল-ছন্দে অবশ্য কোনও ধোঁয়াশা পুরে রাখতে চান না ঋদ্ধিমান৷ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা, মফস্বলের গলি থেকে স্বপ্নের উড়ান দেওয়া ‘পাপালি’র এই গোটা জার্নিটাই নিখাদ বাস্তবের জমিতে দাঁড়ানো। পরিশ্রম করো ফসল ফলবে। গায়ের ঘাম ঝরাও সাফল্য আসবে। যে দরজা দিয়ে তোমায় বের করে দেওয়া হবে সেই দরজাই তোরণ সাজিয়ে তোমায় ফের বরণ করে নেবে। তুমি শুধু লড়ে যাও। নত নয়, প্রণত হতে শেখ। আর এই প্রণতির সুরই ধরা থাকে বিদায়-বার্তার শেষ অংশে। যেখানে আর সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর পালা সাঙ্গ হলে ঋদ্ধিমান লেখেন, ‘... আর বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই আমার কোচ জয়ন্ত ভৌমিককে। যিনি ছেলেবেলাতেই আমার মধ্যে ক্রিকেটার হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তিনি এখনও জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমায় ভরসা জুগিয়ে চলেন।’
প্রত্যেক কোনির একজন করে ক্ষিদ্দা থাকেন। প্রত্যেক ঋদ্ধির জীবনেও যেন এভাবেই আশার আলো জুগিয়ে চলেন পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো জয়ন্তবাবুরা।