শেষ আপডেট: 15th April 2025 18:25
দ্য ওয়াল ব্যুরো: উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব উনিশ টিমের বাছাই চলছে। সার বেঁধে উৎসুক ক্রিকেটারদের ভিড়। মাথায় চড়া রোদ। ঘাম ঝরছে। পাশাপাশি নেটে ব্যাট করছেন অনেকে। সবাই ব্যাটসম্যান। অথচ সেই অনুপাতে বোলারের কমতি ছিল সেদিন৷
বিষয়টি নির্বাচক উৎকর্ষ চন্দ্রের কানে যেতেই তিনি সারিবদ্ধ ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন: ‘তোমাদের মধ্যে কেউ বল করতে পারে?’
জবাব ‘না’ আসবে ধরে নিয়েই জিজ্ঞেস করেছিলেন উৎকর্ষ। কিন্তু মুখের কথা শেষ হতে না হতেই উত্তর আসে ‘হ্যাঁ’। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন এক তরুণ। নাম বিপ্রজ নিগম। ব্যাট ছেড়ে তুলে নেন বল। আর প্রথম ডেলিভারিতেই চমক৷ ব্যাটসম্যান পরাস্ত। উইকেটরক্ষকও বল ধরতে নাস্তানাবুদ। প্রথম বল। তাই ‘ফ্লুক’ ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। ভেবেছিলেন পিচের দোষ। কিন্তু দ্বিতীয় ডেলিভারিতে সেই ধোঁয়াশাও যায় কেটে। এবার আরও বাঁক। বাকি চারটি বলও একইভাবে স্পিন করে।
সেদিনই একজন ব্যাটসম্যানের বোলার হিসেবে নবজন্ম হয়েছিল। বিপ্রজ নিগমের খাতায়-কলমে এখনকার পরিচয় অলরাউন্ডার হিসেবে। কিন্তু বোলার হিসেবেই সমধিক স্বীকৃতি। চলতি আইপিলে নামছেন দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে৷ তুলেছেন সাতটি উইকেট। আর সাতটিই বড় উইকেট: বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, হার্দিক পান্ডিয়া, ক্রুণাল পান্ডিয়া, ডিভন কনওয়ে, এডেন মার্করাম ও শিবম দুবে। জালে বরাবর রাঘব বোয়ালদের বন্দি করেছেন বিপ্রজ। অথচ কেরিয়ারের দীর্ঘ সময় খেলেছেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। আকস্মিকতায় বোলার হয়ে ওঠা।
আইপিএলের আগে বিপ্রজ নিগম আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জার্স ট্রফি। প্রতিনিধিত্ব করেছেন উত্তরপ্রদেশের হয়ে৷ লেগ ব্রেকার বিপিন নজর কেড়েছেন অনেকের। যার স্বীকৃতি দিল্লির হয়ে চুক্তিতে সই৷
কিন্তু এই ‘অ্যাক্সিডেন্টাল ট্রায়ালে’র আগেও রয়েছে একটি অধ্যায়। যেখানে মুখ্য পার্শ্বচরিত্র বিজয় নিগম। বিপ্রজর বাবা। ছিলেন সামান্য মাইনের কেরানি। পরিশ্রম হাড়ভাঙা। মাইনে যৎসামান্য। একদিন পাশে শোয়া ছোট্ট বিপ্রজ তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন: ‘বাবা আমি ক্রিকেটার হতে চাই। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।’
দিনটা আজও মনে পড়ে বিজয়ের। সেদিন ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেও কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি। অর্থকষ্ট বড় বালাই। কীভাবে কিনে দেবেন ব্যাট? জোগাবেন ট্রেনিংয়ের খরচ?
ঠিক তখনই ভাগ্য মুখ তুলে চায়। সরকারি শিক্ষকের চাকরি পান বিজয়। কিন্তু পোস্টিং দেড়শো কিমি দূরে। সেই সময় গত্যন্তর ছিল না। চাকরি নিতে বাধ্য হন। তখন এগিয়ে আসেন বিপ্রজর ঠাকুরদা এবং মা। দুজনে মিলে বারকয়েক ভেঙে যেতেন ৩২ কিমি দূরের কোচিংয়ে। খররৌদ্র, তীব্র শীত—কোনওকিছুই আটকে রাখতে পারত না। ঠিক সময়মতো টিফিন বক্স হাতে পৌঁছে যেতেন দুজনে৷ এই কারণেই বিজয়ের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমি তো স্রেফ টাকা রোজগার করে একজন বাবার কর্তব্য পালন করেছি। আসল ত্যাগ তো আমার বাবা ও স্ত্রী স্বীকার করেছেন।’
সারওয়ার নবাবের ক্যাম্পের ছাত্র ছিলেন বিপ্রজ। নবাবের পরিচিতি, খ্যাতি তরুণ ক্রিকেটারদের পরিচর্যায়। তখনও নেহাতই কাঁচামাল বিপ্রজ। প্রভূত সম্ভাবনা। সবই অপ্রকাশিত। তাই নবাবের হাতে ছেলেকে তুলে দেওয়ার পর বিজয় বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি ক্রিকেটের কিছুই বুঝি না৷ একে নিজের সম্পত্তি মনে করুন। বিপিন আপনার অর্জুন, আপনি এর দ্রোণাচার্য।’
দ্রোণাচার্যের মান রেখেছেন বিপ্রজ। এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। কিন্তু পাখির চোখটি আপাতত ঠিকমতো বিঁধে ফেলেছেন বিপ্রজ নিগম।