৪-৪-২ রণকৌশল
শেষ আপডেট: 28th January 2025 19:42
রূপক মিশ্র
বিনয় মজুমদারের একটি বিখ্যাত কবিতার নাম ‘ফিরে এসো চাকা’। একটু দুষ্টুমি করে ওই কবিতার ছন্দে পা মিলিয়ে ফুটবল বিষয়ক এই নিবন্ধের নাম রাখাই যেত ‘ফিরে এল চার-চার-দুই’! দুই মানে জোড়া। ‘…আক্রমণভাগে জোড়া ফলা…’--ক্রীড়া সাংবাদিকতার পুরোনো দস্তাবেজ ঘাঁটলে ফুটবলের প্রতিবেদনে ‘জোড়া ফলা’র চালু লব্জটি চোখে পড়বে ঠিক। তা সে ব্যারেটো-ওডাফা হোক, চায় চিমা-কৃশানু কিংবা বাইচুং-সুনীল। দুই স্ট্রাইকার ফর্মুলায় ম্যাচ হাসিলের কৌশল ঘরে-বাইরে ছোট-বড় সমস্ত ফুটবল ক্লাব কিংবা দেশ অনুসরণ করে চলত।
ধীরে ধীরে এই বিন্যাস যে আবছা হতে হতে মুছে গেল, এর পেছনে রয়েছে বদলে যাওয়া ফুটবল-দর্শন। আর উবে যাওয়া একটা একটি ট্যাকটিক্স আবার চেনা চেহারায় অথচ অচেনা মোড়কে যে ফিরে এল, তারও নেপথ্যে রয়েছে সময়ের প্রয়োজন ও প্রয়োজনের দাবি।
ফুটবলের দল সাজানো বা টিম সেট-আপ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। ম্যাচ শুরুর আগে একটা আগাম আন্দাজ করে ফেলা যায়, কোন কোচ কীভাবে ঘুঁটি সাজাতে চাইছেন। তিনি কি মিডফিল্ডে দুই শক্তসমর্থ ফুটবলারের ডবল ইঞ্জিন (ফুটবলের ভাষায়: ‘ডবল পিভট’) রাখবেন নাকি একজনেই কাজ সারবেন? এই প্রশ্নের সরল মীমাংসা মিলবে দল সাজানোর নকশা দেখে। ৪-২-৩-১ হলে প্রথম শর্ত এবং ৪-৩-৩ হলে দ্বিতীয় শর্তটি পূরণ হবে।
সেদিক দিয়ে দেখলে ৪-৪-২ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ফুটবল ম্যানেজারদের পছন্দের রণকৌশল থেকেছে। যদিও অঙ্কের হিসেবে এর প্রাগৈতিহাসিক চেহারাটি এমনতর ছিল না। ৪-৪-২-এর পূর্বসূরী ছিল ৪-২-৪। ফুটবল ঐতিহাসিক জোনাথন উইলসনের মতে, এই কৌশলের ফলিত প্রয়োগ আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবার আগে ঘটিয়েছিল দুটি দেশ: হাঙ্গেরি ও ব্রাজিল। চলছিল পরীক্ষা, নিরীক্ষা, কাটাছেঁড়া। নতুন দর্শন পা রেখেই তো আর ঢেউ তুলতে পারে না। আর জন্য তাকে মাঠের খেলায় ছাপ ফেলতে হয়, অর্জন করতে হয় সাফল্য। যতদিন পর্যন্ত না নয়া দৃষ্টিভঙ্গী খেতাব আনছে, ট্যাকটিক্স বোর্ডে গাঁথা দর্শনকে পরিণত করছে ট্রফিজয়ের ফর্মুলায়, ততদিন তা না পায় ব্যাপ্তি, না ঘোচে সংশয়। ১৯৫৮ এবং তারপর ১৯৭০ সালে ব্রাজিলের বিশ্বজয় এই সন্দেহকে সমূলে উৎপাটিত করে। কারণ ৪-২-৪ ফর্মুলাতেই দুনিয়াসেরা হয়েছিলেন পেলে, গ্যারিঞ্চারা।
ব্রাজিলের সাফল্য একটা হলমার্ক দেয়। ৪-২-৪ ফুটবল মহলে খ্যাতিলাভ করে। অথচ পাঁচ ও সাতের দশকের অন্তরালে ছয়ের দশকজুড়ে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল একটি নতুন ছক। নেপথ্য কারিগর ভিক্টর ম্যাসলভ। সোভিয়েত কোচ। তিনি এই ৪-২-৪ বিন্যাসকে বদলে ৪-৪-২-এর রূপ দেন। আক্রমণভাগে দু’দিকের দুই ফুটবলারকে নামিয়ে আনেন মাঝমাঠে। এর ফলে ডিফেন্স, মিডফিল্ড এবং স্ট্রাইকারে খেলা ফুটবলারদের দায়িত্ব সুচারুভাবে, নিপুণভাবে বণ্টিত হয়। আর্সেনাল ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতেই নিয়ে আনেন অনুপাতের তত্ত্ব। তাঁর মতে, দুইজন করে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার এবং স্ট্রাইকার মাঠের ৬০ শতাংশ দখল করে রাখে। আর ফুলব্যাকের দুই খেলোয়াড় এবং দুই উইঙ্গার—এই চারজন মিলে কভার করে ৪০ শতাংশ পিচ। ফলে মাঠের দখলদারির প্রশ্নে ‘যৌক্তিকভাবে’ এটাই সবচেয়ে গ্রহণীয় ট্যাকটিক্স।
ষাটের দশকে ফুটবলের অনেক বদলের মধ্যে একটি বদল ছিল: এই সময়ই ম্যান মার্কিংয়ের বদলে জোনাল মার্কিং জায়গা করে নেয়। আগে বিপক্ষের খেলোয়াড়পিছু দলের ফুটবলারদের ভিড়িয়ে দিতেন ম্যানেজারেরা। জোনাল মার্কিং খেলোয়াড়ের বদলে মাঠের জমির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ৪-৪-২ ডিফেন্ডারদের একটি পাকাপোক্ত ভিত্তি দেয়। পাশাপাশি বাকি খেলোয়াড়েরাও একটি পজেশনাল স্ট্রাকচার (পাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা) পায়।
এর ফলে কী হয়? না, দুই স্ট্রাইকার বিপক্ষের রক্ষণে হানা দেওয়ার স্বাধীনতা অর্জন করে। দুই উইঙ্গার বিপক্ষের ফুলব্যাকদের নজরে রাখে, যাতে তারা বিপজ্জনক ক্রস করা থেকে বিরত থাকে। এই পরিস্থিতিতে দুই মিডফিল্ডারও ঝুঁকি নিয়েই শানাতে থাকে আক্রমণ।
এহেন কৌশলেরই সবচেয়ে সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন আলেক্স ফার্গুসন। নিরানব্বইয়ের সেই ত্রিমুকুটজয়ী টিমের ফুটবলারদের কথা মনে করা যাক: আক্রমণে অ্যান্ডি কোল ও ডোয়াইক ইয়র্ক। মাঝমাঠে পল স্কোলস, রয় কিন। আর দুই উইংয়ে বেকহ্যাম, রায়ান গিগস। মাঝমাঠ থেকে উপরে ওঠার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন স্কোলস। আর রয় কিনের উপর বরাত ছিল মিডফিল্ড পাহারা দেওয়ার।
কিন্তু একুশ শতকের গোড়া থেকে এই ৪-৪-২ ধীরে ধীরে আবছা হতে শুরু করে। তার কারণ, বদলে যায় ম্যানেজারদের মানসিকতা, অভিরুচি। ইউরোপজুড়ে সমস্ত দল চেষ্টা করে বল পজেশন ধরে রাখতে—সোজা বাংলায় জমির দখল নিতে। আর এর জন্য দরকার সংঘবদ্ধতা। বিশেষ করে মিডফিল্ডে। ফলে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে ম্যানেজারেরা তাঁদের দুই স্ট্রাইকারের একজনকে নীচে নেমে আসার নির্দেশ দেন। ৪-৪-২-এর সবচেয়ে বড় অ্যাডভোকেট আর্সেন ওয়েঙ্গারও বদলে ফেলেন তাঁর ট্যাকটিক্স। থিয়েরি অঁরি ও বার্গক্যাম্পের মধ্যে একজন নেমে আসেন নীচে। এর ফলে ৪-৪-২-এর ‘দুই’ ভেঙে যায় ‘একে’ এবং গোটা স্ট্রাকচার বদলে যায় ৪-২-৩-১-এ। পঁচিশ বছর পেরিয়েও বিশ্বের বেশিরভাগ টিমই এই ফর্মেশনে দল সাজিয়ে রাখে।
যদিও আড়ালে গেলেও পুরোপুরি মুছে যায়নি ৪-৪-২। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ম্যানেজার দিয়েগো সিমিওনে এবং ভ্যালেন্সিয়ায় থাকাকালীন উনাই এমরি এই ছকে ঘুঁটি সাজাতেন। তবে মূলধারার স্রোত থেকে আবছা হতে থাকে এই রণকৌশল।
সম্প্রতি বিশ্বের তাবড় ম্যানেজারেরা ৪-৪-২-কে আবার ফিরিয়ে আনছেন। কিন্তু নতুন মেজাজে, ভিন্ন ছন্দে, আলাদা নামে। এর নয়া নাম: ‘৪-৪-২ প্রেস’।
একে বুঝতে গেলে দুটো বিষয়ের ধারণা থাকা জরুরি। ফুটবলে পজেশন দু’রকমের হয়—একটা ‘ইন পজেশন’, আরেকটা ‘আউট অফ পজেশন’। ‘ইন পজেশন’ মানে সোজা কথায়: পায়ে বল থাকা। ‘আউট অফ পজেশন’ মানে: পায়ে বল নেই ঠিকই, কিন্তু বল ছাড়াই একটা শেপ ধরে ক্রমাগত ডিফেন্স করে চলা। ৪-৪-২ টিমকে একটি সুন্দর আকার দেয়। দুই স্ট্রাইকার বিপক্ষের দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারের উপর চাপ বাড়ায়। আর তার নীচে মাঝমাঠ ও রক্ষণের চারজন চারজন করে মোট আটজন মিলে গড়ে তোলে জমাট ডিফেন্স।
৪-৪-২-এর আরেকটা সুবিধে হচ্ছে, খেলতে খেলতেই অন্যান্য ফর্মেশন ভেঙে এটা তৈরি করে ফেলা সম্ভব। যেমন: ৪-২-৩-১-এ তিন জন অ্যাটাকারের মধ্যমণি যে (ফুটবলের ভাষায় নাম্বার টেন), সে আরেকটু উপরে উঠে স্ট্রাইকারের সঙ্গে জুটি বাঁধে এবং বাকি দু’জন নেমে আসে মাঝমাঠে। ব্যাস! ৪-২-৩-১ বদলে গেল ৪-৪-২-এ! এই বদল ৪-৩-৩-এও করে ফেলা সম্ভব। য়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল এবং গোয়ার্দিওলার ম্যাঞ্চেস্টার সিটি 'আউট অফ পজিশন'-বিন্যাসের প্রয়োগ করেছে এবং সফলও হয়েছে।
শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক টিমই নয়, ডিফেন্সিভ দলগুলিও ৪-৪-২-কে মিডব্লকিংয়ের ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। অর্থাৎ, বল ছাড়া এই শেপটি নিখুঁতভাবে ধরে রাখে তারা। ক্রমশ সরতে থাকে নিজেদের রক্ষণের দিকে। শুষে নিতে থাকে বিপক্ষের চাপ। তারপর বিপক্ষ টিম পাসিংয়ে ভুল করলেই দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাকে চলে যায় তারা।
তাই এরপর থেকে টিভিতে চোখ পাতলে শুধু ইন পজিশন টিমের খেলাই উপভোগ করবেন না। দেখবেন পজেশনে না থাকা দল কোন ছকে ঘুঁটি সাজাচ্ছে। তাহলেই আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল আবিষ্কারের মতো একই উত্তেজনায় ফুটবল মাঠের সবুজ গালিচায় আপনি ৪-৪-২-এর সুন্দর অবয়ব ফুটে উঠতে দেখবেন।