ইউরোর ফুটবল উত্তেজনাকে ছাপিয়ে উয়েফার কাছে বড় আশঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলকান সমস্যা। (ছবিঃ সংবাদসংস্থা)
শেষ আপডেট: 23rd June 2024 17:42
এখনও পুরোদমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। ইউক্রেন দল হিসেবে খেলছে এবারের ইউরোতে। অথচ তার মাঝেই জার্মানিতে ফুটবলকে ছাপিয়ে যুগোস্লাভিয়ার পতনের ইতিহাস উস্কে ঘনিয়ে উঠল বলকান রাজনীতির কালো মেঘ!
'খেলা আর রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলবেন না...', এমনই আপ্তবাক্য প্রায়ই শোনা যায় বিভিন্ন মহলে। অথচ বিশ্বের কোনওকালেই খেলাকে রাজনীতির বাইরে রাখা যায়নি। বরং সক্রিয় রাজনীতি ভাষা পেয়েছে খেলাধুলোর মঞ্চে। ইউরো কাপের মঞ্চেও এবার ধুন্ধুমার ঝামেলা লেগে গেল একাধিক বলকান দেশের। সার্বিয়ার ফুটবল ফেডারেশনের কর্তা রীতিমত হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলেন, অবস্থার বিহিত না হলে তাঁরা ইউরো থেকে দলই তুলে নেবেন!
ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি দল--সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও আলবানিয়া। ভূমধ্যসাগরের উত্তরে আদ্রিয়াটিক সাগরের তীরে উত্তরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও দক্ষিণে গ্রিসের মাঝে পাশাপাশি রয়েছে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হারজেগোভিনা, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো, উত্তর ম্যাসেডোনিয়া, আলবানিয়া ও কসোভো। এককালে আলবানিয়া বাদে এই সবক'টি বলকান দেশ মিলে একত্রে ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়া। রাজধানী ছিল বেলগ্রেড। নয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ বেঁধে যায় বলকান দেশগুলির মধ্যে। চলে নারকীয় তাণ্ডব, হত্যালীলা। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া। এই একুশ শতকে যে যার নিজের ভাগ বুঝে আলাদা হয়ে গেলেও বলকান উপত্যকায় আজও ধিকি ধিকি জ্বলছে জাতীয়তাবাদের ছাইচাপা আগুন। যার অন্যতম, কসোভোকে ঘিরে সার্বিয়া ও আলবানিয়ার দ্বন্দ্ব।
সার্বিয়া ও আলবানিয়ার মাঝে থাকা ছোট্ট দেশ কসোভো। অবশ্য 'দেশ' তকমাটা সর্বসম্মত নয়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা, ডেনমার্ক, ব্রিটেন, আমেরিকা, ইজরায়েল ইত্যাদি রাষ্ট্রপুঞ্জের একাধিক মহাশক্তিধর দেশ কসোভোকে স্বাধীন দেশ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু সার্বিয়ার দাবি, কসোভো আদতে তাদের। জোরগলায় সার্বিয়া জানিয়েছে, কসোভো তাদেরই একটা প্রদেশ। এদিকে কসোভোর জনসংখ্যার নব্বইভাগ আলবানিয়ান। সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ধর্মীয় ইত্যাদি অনেক ব্যাপারে মিল রয়েছে কসোভো ও আলবানিয়ার। দুই দেশের নাগরিকরা প্রকাশ্যেই বলেন, তাঁরা 'ওয়ান নেশন, টু স্টেটস'। উত্তরে খুব সীমিত অংশে বাস করেন কিছু সংখ্যালঘু সার্ব জনতা। এতেই আলবানিয়ার সঙ্গে কার্যত যুদ্ধং দেহি সম্পর্ক সার্বিয়ার। প্রসঙ্গত, কসোভোর স্বাধীনতাকে কখনোই মানতে চায়নি ভারত। রাশিয়া বা চিনও কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়না। উল্টোদিকে, স্বীকৃতি দিয়েছে পাকিস্তান। বলকান দেশগুলির মধ্যেও ক্রোয়েশিয়া বা স্লোভেনিয়ার সঙ্গে অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক কসোভোর।
গ্রুপ বি-তে একইসঙ্গে রয়েছে আলবানিয়া ও ক্রোয়েশিয়া। হ্যামবুর্গে গত ১৯ জুন মুখোমুখি হয়েছিল দুই দেশ। সার্বিয়ার অভিযোগ, খেলা চলাকালীন গ্যালারিতে থেকে নাগাড়ে দুই দেশের সমর্থকরা সার্ব-বিদ্বেষী স্লোগান তুলছিলেন। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, 'মারো, মারো সার্ব দেখলেই মারো!' নয়ের দশকের কুখ্যাত বসনিয়া যুদ্ধের স্মৃতি ফেরানো এই স্লোগানের কথা চাউর হতেই আলোড়ন পড়ে যায় ফুটবলমহলে। তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে। সার্ব ফেডারেশনের সাধারণ সচিব জোভান সুর্বাতোভিচ সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দেন, তাঁরা উয়েফার কাছে সরকারিভাবে অভিযোগ জানাবেন। শুধু তাই নয়, ক্রোয়েশিয়া এবং আলবানিয়া দুই দেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে সার্বিয়া ইউরোতে আর খেলবে কিনা ভেবে দেখবে।
সেই ম্যাচ শেষ অবধি ২-২ ড্র হয়। এদিকে আলবানিয়ার অভিযোগ, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সার্বিয়ার প্রথম ম্যাচে যথেচ্ছ কসোভো-সম্পর্কিত স্লোগান চলে মাঠে। গ্রুপ সি-তে ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক ও স্লোভেনিয়ার সঙ্গে রয়েছে সার্বিয়া। গেলসেনকার্শেনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ চলাকালীন কসোভো নিয়ে নানা পোস্টার দেখা দেয় সার্বিয়া সমর্থকদের গ্যালারিতে। ইংল্যান্ড খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের অভিযোগও ওঠে সার্ব গ্যালারির বিরুদ্ধে। ঘটনাচক্রে, কসোভোর ফুটবল ফেডারেশন উয়েফার সদস্য। তারা ইউরোতে না খেললেও সটান অভিযোগ জানায় উয়েফাতে। যদিও ইংল্যান্ড শিবির থেকে কোনও অভিযোগ ঠোকা হয়নি। কিন্তু তৎপর হয়ে ওঠে উয়েফা। সার্বিয়ার সমর্থকদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। শেষ খবর পাওয়া অবধি, সার্ব সমর্থকদের একাংশকে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এদিকে আলবানিয়া-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের পরে বিতর্কে জড়ান আলবানিয়ার ফুটবলার মারলিন্দ ডাকু। লুকা মদ্রিচদের শক্তিশালী দলকে রুখে দেওয়ার আনন্দে উত্তেজনার বশে রীতিমতো মাইক নিয়ে চেঁচিয়ে অশ্লীল স্লোগান দেন সার্বিয়া ও উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে! তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। ডাকুর জন্ম কসোভোতে, ফলে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে কেন স্লোগান দিলেন, সেসব না হয় বোঝা যায়। কিন্তু উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে আলবানিয়ার সম্পর্ক তো বেশ ভাল। দলের একাধিক ফুটবলার সেদেশে জন্মেছেন। হঠাত উত্তর ম্যাসিডোনিয়া কী দোষ করল? ইউরোতে না থাকলেও উয়েফার কাছে সরাসরি অভিযোগ দায়ের করেছে উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার ফুটবল ফেডারেশন। নিঃশর্তে ক্ষমা চেয়ে নেন ডাকু।
যুগোস্লাভিয়ার ভেঙে যাওয়ার প্রায় দুই দশক কেটে গিয়েছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, সোভিয়েতের পতনের পরের কুড়ি বছরে পশ্চিম ইউরোপ যেভাবে উল্কার গতিতে উন্নতি করেছে, তাতে তাল মেলাতে পারেনি বলকান উপদ্বীপ। যুদ্ধের ছায়া এখনও সমাজের স্মৃতিতে প্রবল। সুস্থিত গণতন্ত্রও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে সার-জল পেয়ে ফুঁসতে থাকে বলকান জাতীয়তাবাদ। তবে উয়েফার কাছে ভরসা, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে আলবানিয়া বা ক্রোয়েশিয়া কারোরই মুখোমুখি হওয়ার আশা নেই। গ্রুপ বি-তে আলবানিয়া-ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে আছে স্পেন ও ইতালি। গ্রুপ সি-তেও সার্বিয়া রয়েছে সবার শেষে, নক-আউটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ইংল্যান্ড ও ডেনমার্কের। আপাতত এই ভেবেই খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন উয়েফা কর্তারা।