ফ্রান্সেসকো এসার্বি
শেষ আপডেট: 10 May 2025 07:42
দ্য ওয়াল ব্যুরো: টিভির পর্দার ডানদিকে উপরের এক কোণে জ্বলজ্বল করছে ৯২ মিনিট ৪০ সেকেন্ড।
সান সিরো স্টেডিয়ামের বিলবোর্ডেও সময়ের অঙ্কটা ফুটে উঠেছে। তবে জ্বলজ্বলে নয়, নিভু নিভু রঙে। মিলান সমর্থকেরা শোকে মুহ্যমান, যন্ত্রণায় বাকস্তব্ধ। দু'গোলে এগিয়ে গিয়েও যদি ৩-২ স্কোরলাইনে হারের মুখ দেখতে হয়, এর চেয়ে কষ্টের কিছু হতে পারে কি?
স্টেডিয়ামে সমর্থকদের সমবেত হুইসেল থেমে গিয়েছে। টিফো গোটানোর তোড়জোড় করছেন কেউ কেউ। অনেকেই মাঠ ছেড়ে বাড়ির পথে।
ঠিক সেই সময় প্রজ্জ্বলিত মশাল! জেগে উঠল ইন্টার! জ্বলে উঠলেন ফ্রান্সেসকো এসার্বি।
মঙ্গলবারের ম্যাচ দেখে থাকলে ৯২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের মুহূর্তটা আপনার ভোলার কথা নয়। বার্সা সমর্থক হলে ততক্ষণে বিস্ময়ে স্তব্ধবাক। ইন্টার-ভক্ত বা বার্সা-বিরোধী হলে খুশিতে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নাচানাচি, লাফালাফি শুরু করেছেন। আর ক্লাব ফুটবলে অতটা সড়গড় না হলে, যদি ফুটবলের মরশুমি অনুরাগী হন আপনি, তাহলে লম্ফঝম্পের মধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে বুঝে নিতে চাইছেন গোলদাতার নাম, মেপে নিতে চাইছেন তাঁর এলেম!
টিভি বা মোবাইলের স্ক্রিন দ্বন্দ্ব ঘোচাতে নাম ভাসিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ফ্রান্সেসকো এসার্বি-র পরিচয়ের ছিটেফোঁটাটুকু সেখানে লেখা ছিল না।
পরে আপনি যখন জানতে পারবেন, সারা দেহে রংবেরঙের ট্যাটু-খচিত বছর সাঁইত্রিশের এসার্বি আদতে একজন ডিফেন্ডার, তক্ষুনি মাথায় ঘাই মারবে সঙ্গত, যৌক্তিক প্রশ্ন: একজন রক্ষণভাগের ফুটবলার ম্যাচের সংযুক্ত সময়ে বিপক্ষ শিবিরের পেনাল্টি বক্সে কী করছেন?
এরপর যদি গুগল করে জানতে পারেন: ইন্টারের এই ফুটবলার একজন ক্যানসার-বিজয়ী, দু'বার আক্রান্ত হয়েছেন মারণরোগে, তখন ধাক্কা মারবে দ্বিতীয় প্রশ্ন: এসার্বি ফুটবল মাঠে করছেনটা কী?
‘অনুপ্রেরণাদায়ক’, ‘শক্তিদায়ী’, ‘অনুভূতিপ্রবণ’। বিশেষণগুলো বহুল ব্যবহারে জীর্ণ। কিন্তু এসার্বির জীবনের অপরূপকথা জানতে পারলে এই ক্লিন্ন অভিধাগুলো নতুনতর ব্যঞ্জনায় ফের একবার ব্যবহারের সাধ জাগে ঠিকই!
পনেরো বছর আগের কথা। ফুটবলের মানচিত্রে তখন কোথায় এসার্বি? খেলছেন সেকেন্ড ডিভিশনের একটি ক্লাবে। বুকে স্বপ্ন: একদিন না একদিন বড় টিমের জার্সিতে নামতেই হবে। আজ হোক, কাল হোক—লোকের মুখে মুখে ফিরবে তাঁর নাম।
ফুটবল দেবতা নিরাশ করেননি। মুখ তুলে চেয়েছিলেন। ঘরোয়া লিগে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে এসার্বিকে সই করায় এসি মিলান। মালদিনির মিলান৷ কোস্তাকুর্তার মিলান। নেস্তা, সিডর্ফ, কাফুর এসি মিলান! ডিফেন্ডার তিনি। তাই ইতালীয় রক্ষণের অন্যতম আঁতুড়ঘর এই ক্লাবে যোগ দিয়ে সুখের সপ্তম স্বর্গে উঠে যান এসার্বি।
কিন্তু এহেন বিগ ব্রেকের পরেই ঘনিয়ে আসে জীবনের প্রথম বড় বিপর্যয়। মারা যান এসার্বির বাবা। তাঁকে হারিয়ে টলে যায় পায়ের নীচে জমি৷ কতটা, সেটা পরে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তিনি। অবসাদ-দীর্ণ গলায় বলেছিলেন, ‘আমার দুনিয়া মুহূর্তে উলোটপালোট হয়ে যায়। যেন খেলতেই ভুলে গেছিলাম। কেন খেলছি, সেটাও জানতাম না। মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়ি।’
বিধ্বস্ত জীবনের ধাক্কা আঘাত হানে বল পায়ে নাড়াচাড়ায়। মিলানের মতো বড় ক্লাবে চরম দু:সময়ে সাধারণত সেভাবে সুযোগ জোটে না। এসার্বিও সেই সুযোগ পাননি। সাসৌলোতে লোনে পাঠানো হয়৷ তুলনায় অনেক ছোট ক্লাব—প্রত্যাশায় তো বটেই, পারফরম্যান্সেও!
যদিও স্পটলাইটের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসাটা এসার্বির কাছে সেই সময় শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। যত কম চর্চা, তত বেশি করে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ। নিজেকে নিংড়ে ‘চ্যাপ্টার টু’ লিখে ফেলার অবসর!
কিন্তু নতুন অধ্যায় রচনার আগেই হয়তো উপসংহার লেখার তোড়জোড় হচ্ছিল… এসার্বির অলক্ষ্যেই! লোনে খেলার সময়ই তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। টেস্টিকিউলার ক্যানসার। দুরারোগ্য। কিন্তু সময়ে চিকিৎসা হলে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।
সুযোগ দেয়নি মিলান৷ জীবনদেবতা কিন্তু এসার্বিকে নিরাশ করেননি৷ কয়েক মাস বাদে সার্জারি। সফল অস্ত্রোপচার। টিউমার বাদ দেওয়া হয়৷ ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন এসার্বি।
কিন্তু ময়দানে দ্রুতগতির উইংগার কিংবা দীর্ঘদেহী স্ট্রাইকারকে সামাল দেন যে এসার্বি, তিনি জীবনের রুক্ষ ভূমিতে ফসল ফলাতে কতটা দড়? মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে পারবেন তিনি? হয়তো এটাই বুঝে নিতে চেয়েছিলেন জীবন-ঈশ্বর।
হয়তো সেই কারণেই সার্জারির ঠিক পরপরই দ্বিতীয়বারের জন্য ফিরে আসে ক্যানসার। ফের চিকিৎসা শুরু। ফের চালু যন্ত্রণা-জর্জর কেমোথেরাপি।
দাঁতে দাঁত চিপে লড়ে যান এসার্বি। ঠিক যেন স্টপেজ টাইমে তুরগ-গতির স্ট্রাইকারের সঙ্গে ওয়ান-অন-ওয়ান, পায়ে পায়ে জোর টক্কর! একটা ভুল চাল। তাতেই কিস্তিমাত।
স্লাইড ট্যাকলে সেই সময় কোনও ভুল করেননি এসার্বি। মরণকে মরণপণ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সঠিক সময়ে, লক্ষ্যভেদী নিশানায়। ক্যানসার কয়েক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের জন্য পরাস্ত হয়!
এরপরের জীবনটা আর সিসিফাসের পাথরের চাঁই টেনে তুলে হড়কে যাওয়ার নয়। বিশালাকার প্রস্তর সর্বশক্তি দিয়ে পাহাড়ের শীর্ষে তুলে আনেন এসার্বি। সফল হন৷ এতদিনের যন্ত্রণা, স্বপ্নভঙ্গ, পদে পদে স্খলন, শিখরে উঠে মুহূর্তে অতলে তলিয়ে যাওয়া—অসফল জীবনের অভিমুখ একা হাতে বদলে দেন এসার্বি। রসায়ন? সেই অটুট সংযম, নিয়ত অধ্যবসায়। ছোট ক্লাবে ছোট ছোট পা ফেলে ফের একবার বড় লাফ। এবার গন্তব্য লাজিও। রোমের শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব। বনেদি। সমর্থক-বন্দিত।
লাজিও-তে বিশ্ব ক্লাবফুটবলের মানচিত্রে নিজের স্থানাঙ্ক, নতুন পরিচিতি গেঁথে দেন ফ্রান্সেসকো এসার্বি। তখন ক্লাবের কোচ সিমনে ইনজাঘি। তাঁর ছত্রছায়ায় নিজেকে উজাড় করে দেন হার-না-মানা ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ ডিফেন্ডার। পরে ইনজাঘি লাজিও ছেড়ে ইন্টারে যোগ দিলে এসার্বিও তাঁকে অনুসরণ করেন। জেতেন সিরি আ। ওঠেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে।
একের পর এক কাঁটায়-কাঁটায় টক্করে টিমের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছেন এসার্বি। সান সিরোর ফ্লাডলাইটের আলোয় গত মঙ্গলবার এর-ই আরও একটা মুহূর্ত জন্ম নিল।
৯২ মিনিট ৪০ সেকেন্ড শুধু ঘড়ির কাঁটার হিসেব নয়। নয় শুধু সময়ের অঙ্ক। দু’বার মৃত্যুকে পরাজিত করে জীবনের মূলস্রোতে ফিরে আসা এসার্বির কাছে এই ‘অতিরিক্ত সময়’ই যেন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র!