
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসছে, ফুটবল নিয়ে কথা বলতে এখনও অনিহা বলরামের
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
বাড়ির দেওয়ালে লেখা রয়েছে, ‘‘আমার মৃত্যুর পরে আমার নশ্বর দেহ দাহ করবেন না, দেহটিকে দান করে দেবেন।’’
ঝরঝরে বাংলায় (Bengal) লেখা, আদতে তিনি কিন্তু বাংলার মানুষই নন, অন্ধ্রপ্রদেশের লোক। সেই ১৯৫৭ সালে কলকাতায় এসেছিলেন, তারপর আর ফিরে যাননি তুলসীদাস বলরাম (Tulsidas Balaram)। বাংলার মাটির সঙ্গে তাঁর নাম মিশে গিয়েছে।
হাবাসের ভরসা ‘কে স্কোয়ার’, এএফসি কাপের ঐতিহাসিক ম্যাচে নামছে এটিকে-মোহনবাগান
পিকে-চুনী-বলরাম, ভারতীয় ফুটবলের এক সোনালি অধ্যায়। সেই মহাত্রয়ীর শেষজন এখনও জীবিত, আরও ভাল করে বললে এখনও জীবনের সঙ্গে বাজি রেখে লড়ছেন উত্তরপাড়ার গঙ্গাবক্ষের ফ্ল্যাটে। বিকেলে মাঝেমধ্যে যখন উদাস হয়ে যান, মানসিক যন্ত্রনায় দগ্ধ হতে থাকেন, সেইসময় তিনি চলে যান পাশের গঙ্গা তিরে। একাকী দাঁড়িয়ে থেকে দেখেন বিপরীত দিকের দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। আনমনা হয়ে ভাবতে থাকেন, ঈশ্বর আর কতদিন, জীবনের সবকিছু দেখা হয়ে গিয়েছে, এবার অন্তত আমাকে তুলে নাও!
বলরাম ৮৪, একে একে সব বন্ধুই চলে গিয়েছেন। আচমকা বলে ওঠেন, ‘‘আমি একা নই, বেঁচে আছে তো অরুণ ঘোষও। জানেন, আমাকে দুপুরের দিকে ফোন করে বলে, তুলসী (আমাকে এই নামে ডাকে) আজ রাতে ম্যাঞ্চেস্টারের খেলা রয়েছে, কিংবা বলে মেসির খেলা দেখবি না? আমি প্রতিবারই বলি, হ্যাঁ, দেখব, তুই আমাকে চ্যানেল নম্বরটা বলে দে, তারপর আর দেখা হয় না। কারণ ফুটবল দেখতে আর ভাল লাগে না আমার।’’
কলকাতা লিগের ম্যাচে সেই মহাত্রয়ী, (বাঁদিক থেকে) চুনী, পিকে ও বলরাম।
বলরামের ফুটবলের প্রতি অনিহা গত ১০ বছর যাবৎ। মাঝে শোনা গিয়েছিল তিনি আবারও খেলার খবর রাখেন। তা হলে সেটি কী ভুল ছিল? জিজ্ঞাসা করলে ভারতীয় ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি বলে ওঠেন, ‘‘মারাদোনা মারা যাওয়ার পরে আর ফুটবল দেখি না, ক্রিকেট যেমন দেখি না শচীন অবসর নিয়েছে বলে। টেনিসও দেখতাম, কিন্তু যেদিন রজার ফেডেরার খেলবে না বলল, সেটিও দেখা বন্ধ করে দিয়েছি।’’
ঘরে টাঙানো অলিম্পিকের ১৯৫৬ সালের স্মারক। এমনকি রয়েছে ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকের সেই স্বপ্নের দলের ছবি। তার পাশেই অর্জুন পুরস্কারের মানপত্র। সবকিছু নিজের চোখে দেখার পরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। নামী প্রাক্তন স্ট্রাইকার বলেন, ‘‘সবাই আমাকে বলে আপনি নাকি মহান ফুটবলার, আমার তা মনে হয় না, কারণ আমি তো পদ্মশ্রীই পাইনি। যদি পিকে-চুনীদের মতো গ্রেট হতাম, তা হলে পদ্মশ্রীও পেতাম।’’
এই প্রথম তাঁর দু’চোখে আক্ষেপ ঝরে পড়ল। দৃষ্টিশক্তি ক্রমে কমে আসছে। ঘরের দূরের জিনিসও দেখতে গেলে চশমা লাগে। বলছিলেন, ‘‘হাসপাতালের চিকিৎসক তো বলে দিয়েছেন, চোখে আপনার সমস্যা কাটবে না আর, এভাবেই চলতে হবে।’’
পদ্মশ্রী পেলেন না কেন? এই প্রথম যেন মৌচাকে ঢিল ছোঁড়া হল, জানালেন, ‘‘সেই নিয়ে আমি কিছু বলব না, যাঁদের বিরুদ্ধে বলব তাঁরা এখন পৃথিবীতে নেই। চলে যাওয়া মানুষদের নিয়ে আমি কিছু বলব না। তবে আমাকে যাঁরা ঠকিয়েছেন, তাঁরাও ভালভাবে যায়নি।’’ ক্ষোভ, অভিমান মেশানো গেলায় বললেন অন্তরালে চলে যাওয়া মহাতারকা।
বলরাম মানে এক চলন্ত ইতিহাস। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিও অভিমান রয়েছে। ক্লাব থেকে নানা আমন্ত্রন পান, কিন্তু যান না। এমনকি কিছুদিন আগে ইনভেস্টর ও ক্লাব চুক্তি নিয়ে যে সমস্যা হচ্ছিল, তাতেও কোনও আগ্রহ নেই। জানালেন, ‘‘কী হবে খোঁজ নিয়ে? যারা ক্লাবকে বিক্রি করে দিল, তাদের কথা ভেবে কী হবে!’’
একরাশ হতাশা যেন কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে কিংবদন্তির। একাকী ঘরে বসেও তৃপ্তি পান যখন প্রতিবেশীরা তাঁর খোঁজ নেন। ‘‘এই কারণেই তো বাংলা ছেড়ে যেতে পারলাম না, আমাকে সাধারণ মানুষ যা ভালবাসা দিয়েছে, যে প্রতিদান দিয়েছে, সেই জন্য দেশের বাড়ি থেকে আমাকে চলে আসতে বললেও আমি বাংলাতেই মরব। কোথাও যাব না।’’
বাংলার মানুষ না হয়েও বলরাম যেন বেশি বাঙালি আমাদের থেকেও!