নতুন বছরে বিশ্বের নজরে এই ফুটবলার।
শেষ আপডেট: 18th December 2024 12:18
যদি প্রশ্ন করা হয়, পেপ গোয়ার্দিওলার পেশাদার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল কোনটা, উত্তর খুঁজতে বেগ পেতে হবে। এর বড় কারণ অবশ্যই, পেপের ঈর্ষণীয় ও ঝলমলে সিভি। বার্সেলোনার মসনদে বসে ঐতিহাসিক ত্রিমুকুট জয় হোক কিংবা ‘আমাদের ইতিহাস নেই কোনও’ বলে মুখ গোমড়া করে থাকা ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগের খেতাব এনে দেওয়া—পেপের মাথার তাজ বরাবর দ্যুতিময়। সেখানে কলঙ্কের আঁচ পড়ার সম্ভাবনা খানিক অস্বাভাবিকই ঠেকে।
তবু খুঁতখুঁতে ফুটবল বিশেষজ্ঞের আতসকাচ যদি ভুলচুক খুঁজতে বসে তাহলে উত্তর হবে: একজন বছর একুশের অ্যাকাডেমি গ্র্যাজুয়েটকে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ধুঁকতে থাকা ক্লাব চেলসির হাতে তুলে দেওয়াই, খুব সম্ভবত, ম্যানেজার পেপ গোয়ার্দিওলার জীবনের অন্যতম ‘ব্লান্ডার’! এতদূর পড়ে গুগল করতে বসলে আপনি নিশ্চিতভাবে সেই তরুণ ফুটবলারের নাম জেনে যাবেন। আরেকটু ঘাঁটলে এও বুঝবেন, কেন ম্যাঞ্চেস্টারের উইদেনশ-এ বেড়ে ওঠা মিডফিল্ডার কোল পালমারকে বলা হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের ‘নেক্সট বিগ থিং’—যার কদর মাপতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বয়ং পেপ গোয়ার্দিওলা!
গত সিজনের নথিপত্র পালমারের প্রতিভার একটা প্রমাণ হতে পারে, পুরোটা নয়। নথি বলছে—৪১ ম্যাচে ২৭ গোল, খান ১৫ অ্যাসিস্ট। প্রায় দেড় হাজার মিনিট মাঠে থেকে ৮১ শতাংশ ‘কমপ্লিটেড পাস’। যার দৌলতে প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা যুব ফুটবলারের তকমা আদায়, এমনকি সেরা ফুটবলারের নমিনেশন লাভ—পালমারের উত্থান এককথায় নজরকাড়া।
অথচ সবকিছুর আড়ালে এর শুরুটা হয়েছিল খানিক ঢিমেতালেই। আর পাঁচজন উঠতি ফুটবলারের মতো স্কাউটদের নজরে আসা, একাধিক ক্লাবে ট্রায়ালের জন্য ছুটে যাওয়া এবং অবশেষে ২০১০-এ ম্যাঞ্চেস্টার সিটির অ্যাকাডেমিতে ভরতি—এ পর্যন্ত চমকপ্রদ কিছু নেই। কিন্তু মোচড় আসে আট বছর পর। ট্রেনিংয়ের মেয়াদশেষে শেষে যখন রিপোর্ট কার্ড বানানো হয়, তাতে লেখা থাকে, পালমারের শারীরিক গড়ন এবং গতি নিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষ না-খুশ। মাঠের ধার বেয়ে ছুটতে হলে যে দুটটো বিষয় একজন উইঙ্গারের থাকাটা একান্ত জরুরি।
এই সময় পাশে দাঁড়ান অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর জেসন উইলকক্স। তিনি বলেন, পালমারের অস্ত্র তার বুদ্ধিমত্তা; গতি কিংবা শক্তি— কোনওটাই নয়… “পালমার এমন কিছু দেখতে পায়, যেটা দেখার ক্ষমতাই কারও নেই।”—ডিরেক্টরের এই মন্তব্যে তার কেরিয়ার বেঁচে যায়। হতোদ্যম পালমার অবসাদ ঝেড়ে শুরু করে দ্বিগুণ পরিশ্রম। লক্ষ্য অবশ্যই স্কিলকে খরশান বানানো। পাশাপাশি শরীরকে মজবুত করা।
ফল মেলে হাতেনাতে৷ পরের বছরই ৫ ফুট ৭ থেকে ৬ ফুট ২—দেহের উচ্চতা কেরিয়ার-গ্রাফের মতো তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে৷ ২০২০ সালে ম্যান সিটির অনূর্ধ্ব আঠারো টিমের অধিনায়কের দায়িত্বলাভ, দলকে লিগ ও এফএ ইয়ুথ কাপ জেতানো—সিনিয়র টিমের ম্যানেজার গোয়ার্দিওলার নেকনজরে আসা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
পরের সিজনে পরিস্থিতি আরও কিছুটা উজ্জ্বল হয়। যদিও তখন গোয়ার্দিওলার হাত-পা বাঁধা। ইচ্ছে থাকলেও তরুণ প্রতিভাকে দলে জায়গা দেওয়ার সুযোগ নেই। মিডফিল্ডে বার্নাডো সিলভা, কেভিন ডি'ব্রুইন, রাহিম স্টার্লিং, ফিল ফডেনের মতো খেলোয়াড়েরা রয়েছেন সেরা ছন্দে। তাই অনূর্ধ্ব তেইশের হয়েই মূলত মাঠে নামলেও লিগের দুর্বল টিমগুলোর বিরুদ্ধে দু-একটা ম্যাচে পরিবর্ত ফুটবলার হিসেবে খেলতে থাকে পালমার।
কিন্তু তখন নেশা ধরেছে। নিজেকে প্রমাণ করার নেশা। ফলে প্রিমিয়ার লিগের একটি ম্যাচে বিকল্প হিসেবে নামার পর সেদিনই অনূর্ধ্ব তেইশের ডাগআউটে এসে হাজির হন পালমার। কোনওরকম রাখঢাক না করে কোচকে জানান, অসুবিধে না থাকলে তাকে যেন খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে হ্যাঁ… পরিবর্ত হিসেবে নয়, ম্যাচের গোড়া থেকে। কোচ হতভম্ব। সতীর্থরাও। নাছোড়বান্দা পালমার মাঠে নামে। দলকে জেতায়। নিজে হ্যাটট্রিক করে। তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে শেষরাতে বাড়ির পথ ধরে!
পালমারের এই অদম্য জেদ, নিরলস পরিশ্রম পরের বছর (২০২২-২৩) পেপকে সিদ্ধান্ত বদলে বাধ্য করে। চ্যাম্পিয়নস লিগের স্কোয়াডে সুযোগ পায় পালমার। সেভিয়া, লিভারপুল, চেলসির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মাঠে নামে। কিন্তু ম্যানেজারের আস্থা পুরোপুরি মেলে না। সিনিয়র টিমের হয়ে ম্যাচের গোড়া থেকে খেলতে নামার যে-ইচ্ছে, সেটা অধরাই রয়ে যায়৷ সে বছর ম্যাঞ্চেস্টার সিটি ট্রেবল জেতে (চ্যাম্পিয়নস লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ)। পালমারও ট্রফি হাতে বাকিদের মতো উচ্ছ্বাস দেখায়। কিন্তু ভেতর থেকে সে ভালভাবেই জানত, এইসমস্ত জয়ে তার অবদান যৎসামান্য। নিছক দাক্ষিণ্যে পাওয়া খেতাব নয়, অর্জিত সম্মানকেই পাখির চোখ করেছিল পালমার৷
চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার তিন সপ্তাহ পর ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব একুশ দলের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ পায় সে। তার সদ্ব্যবহার করতে ভোলেনি। সেমিফাইনালে গোল, দুটো অ্যাসিস্ট এবং ফাইনালে জয়সূচক ফ্রি-কিকের দৌলতে ইংল্যান্ডের যুব দল ইউরোপ জয় করে। তাও এক বছর, দু-বছর নয়… পাক্কা ৩৯ বছর পর খেতাব ঘরে আনে ইংল্যান্ড! এই ঐতিহাসিক সাফল্য এবং তাতে নিজে ছাপ রাখতে পারাটা পালমারকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
এরপরে আর ‘অনূর্ধ্ব কিছু’ নয়; প্রিমিয়ার লিগে প্রথম টিমে সুযোগ পাওয়ার দরবার নিয়ে গোয়ার্দিওলার চেম্বারে হাজির হয় সে। ‘পরের সিজন তোমার সিজন হবে’ বলে এতদিন শান্ত রাখা গোয়ার্দিওলার কাছে সেদিন গত্যন্তর ছিল না। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এ উত্তর চায় পালমার। একদিকে প্রথম দলে বছর একুশের তরুণকে সরাসরি সু্যোগ দেওয়ার দোনোমোনো ভাব কাটছে না, অন্যদিকে এমন প্রতিভাকে ছেড়ে দেওয়াটাও পরে ব্যুমেরাং হতে পারে—দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে পালমারকে অদ্ভুত প্রস্তাব দেন তিনি। জানান, সিটি তাকে ছাড়তে চায় না। কিন্তু পালমারের আরও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। তারকাখচিত টিমের রিজার্ভ বেঞ্চে বসে সেটা অর্জন করা সম্ভব নয়। বার্নলি তুলনায় ছোটো ক্লাব। সেখানে এক সিজন কাটিয়ে আসুক সে। গেমটাইম মিলবে। অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার জমবে। পরের সিজনে সিটির হয়ে…
পেপকে সেদিন কথা শেষ করতে দেয়নি পালমার। সাফ জানায়: হয় এবার, নয় নেভার। দলে জায়গা না পেলে ক্লাব ছাড়বে সে। ইগোর লড়াইয়ে সেদিন ভুল দান চেলে বসেন গোয়ার্দিওলা। ক্লাবকে জানান, ঠিকঠাক ট্রান্সফার ফি পেলে যেন পালমারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁর সিস্টেমে এই মুহূর্তে বছর একুশের তরুণের স্থায়ী জায়গা জুটবে না। এদিকে দলবদলের উইন্ডো তখন বন্ধ হওয়ার মুখে।
ঠিক সেই সময় অফার নিয়ে হাজির হয় চেলসি। মালিকানা বদল থেকে শুরু করে পুরোনো প্লেয়ার, স্টাফদের ছাঁটাই, লিগে ধরাশায়ী পারফরম্যান্স, বারবার কোচ পরিবর্তন—চেলসির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ ক্রমশ ঘনিয়ে উঠছে। সে সময় ‘মাসিহা’ হিসেবে পালমারকে সই করান ম্যানেজার মৌরিসিয়ো পোচেত্তিনো। সে মরশুমে খেলোয়াড় কেনাবেচায় ১ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি খরচ করেছিলেন ক্লাবের মালিক মার্কিন ধনকুবের টড বোলি। মিখাইলো মুড্রিচ, এনজো ফার্নান্ডেজ, মোইসে কাইসেইডো-দের তুলনায় নগণ্য দামে দলে আসা পালমার চেলসির ভাঙা তরীর কান্ডারী হয়ে ওঠে।
সর্বার্থে চেলসি তখন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। প্রথম সিজনেই ২৭ গোল। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, অনেক হারা ম্যাচ পালমারের একক দক্ষতায় জিতে ফেরে চেলসি। লিগ টেবিলের দু’নম্বর পাতায় ধুঁকতে থাকা টিম লিগ অভিযান শেষ করে পঞ্চম স্থানে। লিগ কাপের ফাইনালে উঠলেও লিভারপুলের কাছে হারতে হয়। সিজন শেষের পরিসংখ্যান মতে— পালমারের সার্বিক অবদান না থাকলে লন্ডনের ক্লাবটিকে হয়তো অবনমন বাঁচানোর লড়াই লড়তে হত!
আর চলতি সিজনের গল্প? এককথায়, অবিশ্বাস্য! দু-কথায়, আপাদমস্তক উলটপুরাণ! একদিকে লিগ টেবিলে দু-নম্বরে উড়ছে চেলসি। অন্যদিকে গত এগারো ম্যাচে আটবার হারের মুখ দেখে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি খেতাবজয় থেকে যোজন দূরে ধুঁকতে শুরু করেছে। মাঝমাঠের রক্তাল্পতায় কোল পালমারের অনুপস্থিতি এবং তুলনায় ‘নামমাত্র’ মূল্যে তাকে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে গোয়ার্দিওলাকে নতুন করে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে!
ইতালির মিডফিল্ড-মায়েস্ত্রো আন্দ্রে পির্লো একবার বলেছিলেন—“ফুটবল খেলতে হয় মস্তিষ্ক দিয়ে। বাদ বাকি হাত, পা—সমস্তকিছু স্রেফ যন্ত্রপাতি মাত্র।” পির্লোর এই মন্তব্য পালমারের প্রকৌশলী-বিদ্যার সারসত্যও বটে। ইংল্যান্ডের এই তরুণ ফুটবলার উইং, অ্যাটাকিং মিডফিল্ড, সেন্টার মিডফিল্ড এমনকি লেফট ব্যাক পজিশন— যে কোনও জায়গায় খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যদিও ‘নাম্বার টেন’ পজিশনে পালমার সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ। স্ট্রাইকারের ঠিক নীচে প্লেমেকার হিসেবে ইতিমধ্যে জাত চিনিয়েছে সে।
ফরোয়ার্ডের সঙ্গে লিঙ্ক-আপ-প্লে, ডিফেন্স-চেরা থ্রু পাস, লো-ব্লকে গেড়ে বসা জমাটি রক্ষণ ছিন্নভিন্ন করা ফাইনাল বল, পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে লং শট, মাঝমাঠ থেকে উঠে এসে ক্লিনিক্যাল ফিনিশ—পালমারের তূণীরে লক্ষ্যভেদী তিরের কমতি নেই। ময়দানের চালু লব্জ ‘ফ্রি রোলে'-ই সবচেয়ে বেশি ক্ষুরধার পালমার। শক্তিশালী বাঁ-পা। কিন্তু মেসির মতো দৃষ্টিনন্দন ঘরানা কিংবা ডাচ কিংবদন্তি আর্জেন রবেনের মতো ক্ষুরধার দ্রুতগতির ‘ওয়ান-ট্রিক পনি’-র সীমাবদ্ধতায় নিজেকে আটকে রাখেননি।
বরং, তার ‘স্টাইল অফ প্লে’ মনে করিয়ে দেয় ম্যাঞ্চেস্টার সিটির মিডফিল্ডার দাভিদ সিলভার কথা। আর মনে পড়ে মহম্মদ আলির সেই স্মরণীয় উক্তি: “ফ্লোট লাইক আ বাটারফ্লাই, স্টিং লাইক আ বি।” মাঝমাঠকে নিজের মুক্তাঞ্চল বানানো কোল পালমারের নান্দনিক দাপট বোঝাতে এর চাইতে অব্যর্থ উপমা কিছু হতে পারে না।
একটা টুকরো ঘটনা উল্লেখ না করলে এ লেখা সম্পূর্ণ হবে না। ২০১৮ সালের এফএ কাপ ফাইনাল। গোল করে দলকে জিতিয়েছে পালমার। সেলিব্রেশনের সময় জার্সি তুলে ভেতরকার টিশার্ট মেলে ধরে সে। সেখানে লেখা: ‘আরআইপি জেরেমি উইস্টন’। বছর আঠারোর জেরেমি ছিল ম্যান সিটিতে পালমারের সতীর্থ। চোটের কারণে দীর্ঘদিন দলের বাইরে থাকার পর কোভিডের সময় ক্লাব ছাঁটাই করে তাকে। জোটেনি নতুন ক্লাব। সিটি কর্তৃপক্ষও পাশে দাঁড়ায়নি। অবসাদে দিদির বাড়িতে আত্মহত্যা করে জেরেমি। বন্ধুর এই অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেনি পালমার। কিন্তু ভেঙেও পড়েনি। অপেক্ষা করেছে, সুযোগ খুঁজেছে, নিজেকে করেছে প্রস্তুত। তারপর ডানা দুটো মজবুত হয়েছে যেদিন, নতুন গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে।
একুশ শতকে বদলে ফুটবল-বিশ্ব আমূল বদলে গেছে। কিন্তু কিছু সত্য আজও ধ্রুব, আজও অক্ষত। ইস্পাতকঠিন স্নায়ু, চাপের মুখেও অনমনীয় থাকা… আর প্রজাপতির মতো উড়ে বেরিয়ে মৌমাছির মতো দংশাতে পারে যে, কালের যাত্রার ধ্বনি বিলক্ষণ তার কানে বেজে চলে। উদীয়মান ইংরেজ মিডফিল্ডার কোল পালমার আরেকবার এই ‘তথ্য’কে ‘সত্য’ প্রমাণ করেছে।