মার্সেলো বিয়েলসা
শেষ আপডেট: 28 April 2025 09:03
দ্য ওয়াল ব্যুরো: বিশ্বফুটবলে এমন অনেক ম্যানেজার রয়েছেন, যাঁরা খালি চোখে ‘সফল’ নন৷ অর্থাৎ, প্রভূত ট্রফি, গাদাখানেক লিগ টাইটেল—কিচ্ছুটি জেতেননি। তারকা ফুটবলারদেরও সেভাবে ‘ম্যানেজ’ করেননি। তবু ফুটবলের ইতিহাসে ছকভাঙা কোচেদের তালিকায় তাঁরা জায়গা করে নিয়েছেন। খেলার দর্শন, জ্যামিতি আর নকশা নিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন অবিরত নিরীক্ষা। ব্যর্থ হয়েছেন। হয়তো হয়েই চলেছেন। তবু নিজের পথ ছেড়ে একচুল সরেননি।
এমনই এক একগুঁয়ে, কিছুটা ‘খ্যাপাটে’ গোছের ম্যানেজার মার্সেলো বিয়েলসা (Marcelo Bielsa)। আর্জেন্তিনায় (Argentina) জন্ম। খেলোয়াড় হিসেবে সেভাবে নাম করতে পারেননি। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ‘অসফল’। তবু ১৯৮৭ সাল থেকে ম্যানেজার হিসেবে যাত্রা শুরুর পর একাধিক বড় ক্লাব, বড় দেশের দায়িত্ব সামলেছেন। সেই বড় তালিকায় নাম রয়েছে আর্জেন্তিনা জাতীয় দল থেকে শুরু করে ফ্রান্সের বনেদি ক্লাব মার্সেইয়ের (Marseille)। কখনও ইতালির ফুটবল টিম লাজিও-র (Lazio) কুর্সিতে বসেছেন। কখনও লিডস ইউনাইটেডের (Leeds United) ম্যানেজার পদে আসীন হয়ে দলকে দ্বিতীয় ডিভিশন (Championship) জিতিয়ে বহু বছর বাদে প্রিমিয়ার লিগে (EPL) ফিরিয়ে এনেছেন।
আপাতত তিনি উরুগুয়ের (Uruguay) দায়িত্বে। যারা বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জনের টেবিলে তিন নম্বরে দাঁড়িয়ে। আর্জেন্তিনার পরে, ব্রাজিলের আগে৷ আল্ট্রা ডিফেন্সিভ, ফিজিক্যাল ফুটবল খেলার যে ‘কুখ্যাতি’ অর্জন করেছিল উরুগুয়ে দল, সেই সাবেকি পন্থা থেকে সরিয়ে সুয়ারেজদের নিজস্ব ঘরানায় আক্রমণাত্মক ধাঁচে খেলতে শিখিয়েছেন বিয়েলসা!
অথচ দেখে মনে হবে না, এই মানুষটাই যে কোনও দলের দীর্ঘদিন যাবৎ অনুসৃত মত ও পথকে সমূলে উৎখাত করে একদম টাটকা দর্শন চারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ধরেন! জুবুথুবু চেহারা। পরনে ছাপোষা ট্র্যাকশ্যুট। চোখে চশমা। টাচলাইনজুড়ে অস্থির পায়চারি। কথা বলেন, মেপে। সবমিলিয়ে প্রথম দর্শনেই যে কারও নজর কাড়তে পারেন এই স্বল্পভাষী আর্জেন্তিনীয় ম্যানেজার। অনুরাগীরা যাঁকে ডাকেন 'এল লোকো' নামে। বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় 'খ্যাপাটে'।
ভুল কিছু বলেন না তাঁরা। বাড়িতে চড়াও সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে যিনি গ্রেনেড হাতে তাড়া করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের ট্রেনিংয়ে নজর রাখতে যিনি রীতিমতো পয়সা দিয়ে 'স্পাই' পোষেন এবং তা দরাজ গলায় স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন না—তাঁকে 'পাগলাটে' ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে?
এই নিয়ে একটা গল্প বলা যাক। তখন বিয়েলসা স্পেনের অ্যাথলেটিক বিলবাও দলের কোচ। বার্সেলোনার বিরুদ্ধে খেলা। প্রতিপক্ষ শিবিরের কোচের নাম পেপ গোয়ার্দিওলা। সেই ম্যাচে বিয়েলসা বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। ৪ গোলে বিলবাওকে দুরমুশ করেছিল বার্সেলোনা। কিন্তু রেফারি শেষ বাঁশি বাজানোর পর আসল 'খবর' সামনে আসে। বার্সেলোনার চেঞ্জিং রুমে একটি ইয়াব্বড়ো চার্ট পাঠিয়ে দেন বিয়েলসা। সেখানে জাভি, ইনিয়েস্তা, মেসিদের যাবতীয় খুঁটিনাটি—ট্যাকটিক্স কাটাছেঁড়া যাকে বলে—সেটা ধাপে ধাপে সাজানো। বার্সেলোনার দুর্বলতা আর শক্তিকে পর পর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যা নেড়েচেড়ে ‘থ’ বনে যান স্বয়ং পেপ গোয়ার্দিওলা। তক্ষুনি ছুটে গিয়ে দেখা করেন বিয়েলসার সঙ্গে। আর জড়িয়ে ধরে বলতে বাধ্য হন, 'আপনি তো বার্সেলোনাকে আমার চাইতেও হাড়ে হাড়ে চেনেন দেখছি!'
সেদিনের তাজ্জব ঘোর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি পেপ। বহু বছর পরের কথা। বিয়েলসা যখন লিডস ইউনাইটেডের কোচ। প্রিমিয়ার লিগে লিডসের মুখোমুখি ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। তার আগে প্রি-ম্যাচ কনফারেন্সে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গোয়ার্দিওলা অকপটে জানান: বিয়েলসা তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ ম্যানেজার।
এই দরাজ সার্টিফিকেট শুনে অনেকেই হয়তো ভুঁরু কোঁচকাবেন। প্রশ্ন উঠবে, কী এমন অর্জন করেছেন বিয়েলসা যে তাঁকে এক্কেবারে 'সেরা' বলতে হবে? একথা সত্যি 'এল লোকো'-র ট্রফি ক্যাবিনেট মোরিনহো কিংবা অ্যান্সিলোত্তির মতো ঈর্ষণীয় নয়। চ্যাম্পিয়নস লিগ, ওয়ার্ল্ড কাপের মতো বনেদি খেতাব জেতেননি তিনি। তাহলে শ্রেষ্ঠত্বের রহস্য কোথায়?
আসলে বিয়েলসার কৃতিত্ব অন্য জায়গায়। সেটা পুরোপুরি 'দর্শন'-এর। ফুটবল দুনিয়ায় বেশ কয়েকটি নতুন ধারা আমদানি করেছেন এই পোড়খাওয়া কোচ। নতুন ছক, প্রথাভাঙা ফিটনেস মন্ত্র, ট্রেনিং মেথডে বিপ্লব আনায় জোর দিয়েছেন একসময় দুঁদে শারীরশিক্ষার শিক্ষক বিয়েলসা। সাজানো বাগানে রঙিন ফুল-ফল ফোটানোর চাইতে ঊষর জমিকে সুফলা করে তোলাকেই সার বলে মেনেছেন তিনি। নইলে কেউ সেকেন্ড ডিভিশনের ক্লাবের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে? চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে প্রোমোশন পেয়ে দলকে প্রিমিয়ার লিগে টেনে আনা সে অর্থে মহাকাব্যিক সাফল্য নয়৷ কিন্তু ওই! খ্যাপাটে লোকেদের চিন্তাধারাই যে একটু অন্যরকম হয়! ট্রফির গুনতি ভুলে ক'জন তরতাজা নতুন প্রতিভা তাঁদের হাতে তৈরি হল, সেই কড়ি গোনাতেই বুঁদ হয়ে থাকেন তাঁরা। বিয়েলসারা সবদিক থেকে বিরল। তাই তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতা মাপার নিক্তি আজও অধরা।