শেষ আপডেট: 8th May 2023 15:07
ঠিক ১০ বছর আগে আজকের দিনে সেই মহাজাগতিক যুগের অবসান হয়েছিল।
স্যার আলেকজান্ডার চ্যাপম্যান ফার্গুসন (Sir Alex Ferguson)। গ্রিক মহানায়কের রাশভারি নামটা শেষ অবধি কাটছাঁট হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইংরেজি চারটে অক্ষরে। 'অ্যালেক্স'। এই নামেই তিনি জয় করেছিলেন আলেকজান্ডারের সমতুল দিগ্বিজয়ী ফুটবল সাম্রাজ্য। আজও যাকে ছুঁতে পারেনি কেউ। ঠিক দশ বছর আগে, আজকের দিনেই তিনি অবসর নিয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড (Manchester United) ক্লাব থেকে।
কী দিয়ে বিচার করা যাবে তাঁকে? দ্বিধায় পড়বেন রাশিবিজ্ঞানীরা। তেরোটা প্রিমিয়ার লিগ, পাঁচটি এফএ কাপ, চারটে লিগ কাপ, দুটো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটি ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ, একটি ইউরোপিয়ান সুপার কাপ, একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ, একটি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। ২৬ বছরের কোচিং পর্বে ৩৮-টি ট্রফি। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে অ্যাবারডিনের কোচ থাকাকালীন জেতা তিনটি স্কটিশ লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ, চারটে স্কটিশ কাপ এবং ১৯৮৩ সালের ইউরোপীয় কাপ উইনার্স কাপ। নজিরবিহীন এক সাফল্য, গোটা ক্লাব ফুটবল ইতিহাসে যার সমতুল আর নেই। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড নামটাকেই তিনি নতুন করে লিখে গিয়েছিলেন রেকর্ড বইতে।
জন্ম গ্লাসগোতে, এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। ১৯৪১ সাল, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। ইংলিশ চ্যানেলের এপারে বারকয়েক আছড়ে পড়েছে জার্মান বোমারু বিমানের হামলা। বাবা জাহাজে কাজ করতেন। দুই ভাই, অ্যালেক্স আর মার্টিন, বড় হয়েছিলেন ফুটবলের স্বপ্নকে ঘিরে। নিজের এই শিকড় কখনও ভোলেননি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। আজকের এই গা বাঁচিয়ে চলা রাজনীতির যুগে গলা খুলে ব্রিটিশ রাজনীতিতে লেবার দলকে সমর্থন করতেন। বলতেন, 'লেবারই দিনের শেষে শ্রমিকের কথা ভাবে। টোরিরা সারাক্ষণ ওই নিজেদের মত ধনীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে।'
আরও পড়ুন: সেনাছাউনির পাশেই ‘আরাম’ মিলত মহিলাদের কাছে, কোরীয় যুদ্ধের সে ক্ষত আজও সারেনি
ঠিক দশ বছর আগে কার্যত তুফান উঠে গিয়েছিল ব্রিটিশ ফুটবলে। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের (Manchester United) তরফে ফার্গুসনের (Sir Alex Ferguson) অবসরের কথা সরকারি ঘোষণার আগে কাকপক্ষীকেও জানতে দেওয়া হয়নি। অথচ বহুদিন আগে থেকেই এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিলেন ফার্গুসন। ২০১২ সালের বড়দিনের রাতে নিজের স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন সিদ্ধান্তের কথা। তারপর, ২০১৩ সালের গোড়ায় ইচ্ছের কথা জানান তৎকালীন ম্যাঞ্চেস্টার চিফ এগজকিউটিভ ডেভিড গিলকে।
ঘটনাচক্রে, গিল নিজেই তখন ম্যাঞ্চেস্টার ছাড়ার কথা ভাবছেন। বিবিসির খবর, গিল ভাবছিলেন, ম্যাঞ্চেস্টারের দায়িত্ব ছেড়ে উয়েফার এগজিকিউটিভ কমিটিতে ঢুকবেন। বৈঠক ডেকেছিলেন, সিদ্ধান্তের কথা জানাতে। অথচ তাতে এসে স্যার অ্যালেক্স জানান, তিনিও ম্যাঞ্চেস্টার থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবছেন। চলতি মরসুমই হতে চলেছে তাঁর শেষ মরসুম।
গিল সে'কথা ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানাননি। শুধু গুটিকয়েক শীর্ষকর্তা জানতেন। জানতেন ম্যাঞ্চেস্টারের মালিক গ্লেজার পরিবার। ততদিনে প্রিমিয়ার লিগের শেষ পর্বে দুরন্ত খেলছে ম্যাঞ্চেস্টার। ২২ এপ্রিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অ্যাশটন ভিলাকে ৩-০ হারিয়ে ১৩-তম প্রিমিয়ার লিগ খেতাব জিতে নেয় তারা। ঠিক হয়, পুরো দলকে হুডখোলা বাসে চাপিয়ে ঘোরানো হবে। যদিও ম্যাঞ্চেস্টারে এহেন সেলিব্রেশন বেনজির। কিন্তু তার আগেরবার ম্যাঞ্চেস্টার সিটি গোলপার্থক্যে তাদের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ খেতাব জিতে নেওয়ায় হুডখোলা বাসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। ফলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইউনাইটেডও সেই পথে হাঁটবে, সে আর নতুন কী?
কিন্তু ঘনিষ্ঠমহলে অনেকেই জানত, এই শোভাযাত্রার আয়োজন আদতে শুধু লিগজয়ের আনন্দে নয়। ম্যাঞ্চেস্টারের ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম ম্যানেজারকে বিদায় জানানোর সম্বর্ধনাও বটে!
ফলে ফার্গুসনের সরকারি ঘোষণা অবধি অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আগেই এই বজ্রপাতের মত খবর ঘিরে চূড়ান্ত জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ মিডিয়াতে। বিভিন্ন সাংবাদিকের, ফুটবল ওয়েবসাইটের দপ্তরে কার্যত ফোন আসার বন্যা শুরু হয়। সাংবাদিকদের অনেকে শেষে নাজেহাল হয়ে ফোনই বন্ধ করে দেন। শেষে, ৭ তারিখ সন্ধ্যেবেলাতেই 'ডেইলি টেলিগ্রাফ'-সহ বিভিন্ন মিডিয়ার ওয়েবসাইটে বেরিয়ে আসে সেই খবর।
এক যুগের অবসান। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে আর থাকছেন না স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।
আরও পড়ুনঃ অবশেষে ৭৪ বছর বয়সে মিলল ‘প্রোমোশন’, যুবরাজ থেকে রাজা হলেন চার্লস: একনজরে কিছু অজানা তথ্য
ফার্গুসন যদিও এতে দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর থেকেই আসুক এই খবর। সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর মত এক মহাকবির মহাকাব্যের শেষ যদি অন্য কোথাও বেরিয়ে আসে, সেটা যথেষ্ট অস্বস্তির বৈকি। রায়ান গিগস, ডেভিড বেকহ্যাম, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-সহ বহু মহাতারকার আবিষ্কর্তা স্যার অ্যালেক্স অতঃপর ক্লাবে এসে অত্যন্ত বিনীতভাবে ক্লাবের কর্মী ও সদস্যদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন। তারপর জানিয়ে দেন, যা রটেছে, তা সত্যিই। শেষে ফুটবলারদের একত্র করে সরকারিভাবে জানিয়ে দেন তাঁর সিদ্ধান্তের খবর। তিনি আর থাকছেন না।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের (Sir Alex Ferguson) অবসরের পরে ম্যাঞ্চেস্টারের গল্প আর আগের মত হয়নি। তারপর লুই ভ্যান গল, হোসে মোরিনহো, ওলে গুন্নার সলজস্কিরের মত ম্যানেজারকে নিয়ে এলেও, ফার্গুসন জমানার দাপটে ফিরে আসতে পারেনি রেড ডেভিলরা। একটিও প্রিমিয়ার লিগ জিততে পারেনি তারপর। মোরিনহো ইউরোপা লিগ জিতেছেন, এফএ কাপ ফাইনালে তুলেছেন। কিন্তু ক্লাবের অবস্থা সামাল দেওয়া যায়নি। গ্লেজার পরিবারের মালিকানা নিয়েও এখন ভক্তদের ক্ষোভ চরমে।
১৯৮৬ থেকে ২০১৩। এক অননুকরণীয়, অবিস্মরণীয় ২৬ বছর। প্রতিটি লাল-সাদা জার্সির আবেগে, প্রতিটি গ্লোরি গ্লোরি স্লোগানে, প্রতিটি ইউনাইটেড ভক্তের রাতজাগা ক্লান্ত চোখে তিনি অনির্বাপিত হয়েই থেকে যাবেন। আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস্টারমশাই, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন (Sir Alex Ferguson)।
আরও পড়ুনঃ সবরমতীর তীরে বাঙালির দাপট, সমস্ত বঞ্চনার জবাব ব্যাটেই দিয়ে গেলেন শিলিগুড়ির ঋদ্ধিমান