শেষ আপডেট: 29th July 2024 15:04
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এসব দৃশ্য উইম্বলডন, রোলাঁ গারো, ফ্লাশিং মিডো বা ওয়েম্বলি-ওল্ড ট্র্যাফোর্ড-সান্তিয়াগো বের্নাবৌয়ের গ্যালারি দেখে অভ্যস্ত। সামনে টেনিস বা ফুটবল ম্যাচ চলছে। গ্যালারি আলো করে বসে তাবড় বিশ্বের তারকারা। অলিম্পিকের কপালে সচরাচর এতটা জোটে না। অজস্র ইভেন্ট চলে সারাদিন জুড়ে। শহরের এ'প্রান্ত থেকে ও'প্রান্ত একাধিক ভেন্যুতে একাধিক খেলোয়াড়ের পরীক্ষা হয়। অথচ তাও, সেইনের তীরে বের্সি এরেনা যেন ব্যতিক্রম। ভেতরে অলিম্পিক জিমন্যাস্টিক্স চলছে। গ্যালারিতে বসে স্বয়ং টম ক্রুজ!
শুধু কি টম ক্রুজ? অলিম্পিকের ফাঁকেই ভক্তদের দেদার সেলফির আবদার সামলাতে হল ক্রুজকে। একদিকে পপ তারকা লেডি গাগা। অন্যদিকে স্নুপ ডগ। সঙ্গে জেসিকা চ্যাস্টেন। আরিয়ানা গ্রান্দে। নিক জোনাস। গ্রেটা গারউইগ। আনা অঁতোর। সকলেই এসেছেন একজনের জন্য। লেডি গাগা যার ছবি ইনস্টাতে পোস্ট করে লিখেছেন, 'এতটা কাছাকাছি রয়েছি, এটাই কতবড় সম্মান আমার জন্য!'
সিমোন বাইলস।
বয়স ২৭। অথচ, অলিম্পিক কেন, জিমন্যাস্টিক্সের ইতিহাসেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা। জিমন্যাস্টিক্স শব্দটাকেই নতুন একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন তিনি। মাত্র একটি অলিম্পিকে পুরো সময় থেকেছেন। তাতেই সাতটি পদক। তিরিশটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। বিরল কয়েকজন অলিম্পিয়ানের একজন, যিনি যতগুলো ইভেন্টে নাম দিয়েছেন, প্রত্যেকটি থেকে পদক এনেছেন। ২০২২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁকে 'প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম' সম্মানে ভূষিত করেছেন।
সিমোন বাইলস। এসেছেন প্যারিস অলিম্পিকে আবার।
সিমোন বাইলসের কাছে টোকিও অলিম্পিক ছিল একটা বিভীষিকা। অথচ সারা পৃথিবী হাঁটু মুড়ে বসে শিখেছিল। জেনেছিল, অলিম্পিক কীভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভার কাছে। রিও অলিম্পিকে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন সিমোন বাইলস। জিতেছিলেন চারটি সোনা, একটি ব্রোঞ্জ। ভল্ট থেকে ফ্লোর এক্সারসাইজ, কিছুতেই দমানো যায়নি তাঁকে। আজ অবধি আমেরিকার ইতিহাসে জিমন্যাস্টিক্সে একটি গেমসে চারটি সোনা জেতার রেকর্ড কারো ছিল না। রিওর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে আমেরিকার পতাকা বহন করেছিলেন সিমোন।
কিন্তু টোকিওতেই সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল তাঁর।
সিমোন বাইলস ছিলেন একমাত্র জিমন্যাস্ট, যিনি প্রত্যেক ব্যক্তিগত বিভাগের ফাইনালে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তারপরেই এক অদ্ভুত সমস্যা দেখা দেয় তাঁর। পোশাকি নাম, 'ট্যুইস্টিজ'। অর্থাৎ, এমন এক অবস্থা, যাতে জিমন্যাস্ট শরীর শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়ার পরে শারীরিক কসরতের ভারসাম্য বুঝতে পারেন না। ফলে শরীর কোথায় 'ল্যান্ড' করবে, কীভাবে 'ল্যান্ড' করবে, খেই হারিয়ে ফেলেন। এটা যে কতটা বিপজ্জনক, একবার কল্পনা করলেই বোঝা যায়। শরীর সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে না থাকলে 'ল্যান্ডিং'-এ গোলমাল হয়ে গেলে সরাসরি মৃত্যু অবধি হতে পারে। মানসিকভাবে কিছুতেই সুস্থ বোধ করেননি বাইলস। একের পর এক ইভেন্ট থেকে সরে দাঁড়াতে থাকেন তিনি। অল-অ্যারাউন্ড থেকে সরে দাঁড়ান। পরে ফ্লোর ফাইনাল থেকে সরে দাঁড়ান। সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছিল। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অলিম্পিকের সোনা জেতার সুযোগ ছেড়ে দেবে? এ' কেমন কথা? কিন্তু কানে তোলেননি সিমোন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আর এভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। জাপানের নাওমি ওসাকা ছিলেন তাঁর রোল মডেল। পরবর্তীকালে একের পর এক জিমন্যাস্ট এসে পাশে দাঁড়ান বাইলসের। 'ট্যুইস্টিজ' যে কী মারাত্মক সমস্যা, সেই ছবিটা স্পষ্ট হতে থাকে।
প্যারিসে সিমোন বাইলস এসেছেন ২৭ বছর বয়সে। অল-অ্যারাউন্ড ইভেন্টে সাতাশ বছরে সোনা জেতার নজির আজ অবধি নেই। অথচ সিমোন বাইলসকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি এরকম দুঃসাধ্য সাধনে এসেছেন। প্রথম দিন আমেরিকাকে শীর্ষে রেখে শেষ করলেন বাইলস। দলগত বিভাগে দ্বিতীয় ইটালির চাইতে তিন পয়েন্ট এগিয়ে আমেরিকা। তাঁর নিজের স্কোরই ৫৯.৫৬৬।
সিমোন বাইলসের ফিরে আসাটা হলিউডি চিত্রনাট্যকেও হার মানাবে। বস্তুত, হলিউডে ইতিমধ্যেই চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। 'দ্য ওয়েট অফ গোল্ড'। তথ্যচিত্রের আদলে দেখানো হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে নখদাঁত বের করে গিলে খেতে আসে খেলোয়াড়দের। সিমোন বাইলস যত এগোবেন প্যারিসে, তত অলিম্পিক জিমন্যাস্টিক্সে নতুন রেকর্ড যোগ হতে থাকবে। সম্ভবত পরের রাউন্ডে আরও অনেক হলিউড তারকা উড়ে আসবেন প্যারিসে। শুধুমাত্র তাঁর জন্য।