শেষ আপডেট: 6th October 2023 20:33
‘ষোলো আনা বাবলু’ বইটি তখনও দিনের আলো দেখেনি। একদিন আমাদের কসবার অফিস থেকে বেরিয়ে গড়িয়াহাটে এসে হাওড়া ও গলফগ্রিন মিনি বাসে করে ২৩৪ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের সামনে নামলাম।
একটাই লক্ষ্য সুব্রত ভট্টাচার্যের বাড়ি যাব। বাস স্টপেজে নেমে এক চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা বলতে পারেন সুব্রত ভট্টাচার্যের বাড়িটা কোথায়?
চায়ের দোকানদার বললেন, আপনি নিশ্চিন্তে চা খেয়ে নিন। আমি বলে দেব স্যারের বাড়ি কোথায়।
স্যার! আমি আবার তাঁকে বললাম আমি কিন্তু ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্যের কথা বলছি। ওই ফুটপাথের চায়ের দোকানদার ভদ্রলোক বেশ রাগত স্বরে বললেন, ‘আরে বাবা সুব্রত ভট্টাচার্য মানে ফুটবলারই হবেন। এটা আপনাকে বলতে হবে! এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আমি বলেছি যখন ঠিক দেখিয়ে দেব ওঁর বাড়ি।
তারপর চা-কেক খেয়ে পয়সা মিটিয়ে দিতেই ওই চায়ের দোকানদার আমাকে নিয়ে সত্যিই হাঁটা লাগালেন বাবলুদার বাড়ি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।
ওই দোকানদার হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, ‘সুব্রত স্যারকে গলফগ্রিনের মানুষ ভগবান হিসেবে মানেন ও শ্রদ্ধা করেন।’
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, প্রতিদিন সকালে এলাকায় নিয়ম করে হাঁটতে বেরলে এলাকার সব ধরনের মানুষের সঙ্গে গল্পগাছা করেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে।
ওই চায়ের দোকানদারই আরও জানালেন, ‘স্যারের একটা কথায় আমি চিরতরে সিগারেট-বিড়ি ছেড়ে দিয়েছি। একদিন সকালে চা খেতে এসে আমাকে বললেন, হ্যাঁরে আমি এদিকে হাঁটতে এসে প্রায়ই দেখি তুই একটা সিগারেট খেয়েই আরও একটা ধরাচ্ছিস। এটা কেমন ব্যাপার! বাড়িতে সন্তান থাকলে তাদের কথা ভেবে অন্তত এসব নেশা ছেড়ে দে। তাতে তোরই ভাল।’
চঞ্চল নামে ওই ফুটপাথের দোকানদার বললেন, ‘আমি তারপর সিগারেট বিড়ি সব ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু স্যার এখনও সিগারেট খান। এই নিয়ে একদিন চা খেতে এলে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। আমি স্যার ছেড়ে দিয়েছি নেশা। আপনি তো ছাড়েননি। আমাকে উনি বললেন আমার তিনকাল গিয়ে এক কালে গিয়ে ঠেকেছে। তোরা ভাল থাক, সুস্থ থাক।’
এই হলেন বাবলু ভট্টাচার্য। মোহনবাগানের নয়নের মণি। এখনও কোনও বিকেলে শুনশান গলফগ্রিনে গেলে দেখা যায়, বাড়ির ব্যালকনিতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুব্রত। হয়তো ভাবেন তাঁর সোনালি দিনগুলোর কথা।
একবার মোহনবাগানের কোচ থাকার সময় প্র্যাকটিস শেষে বিখ্যাত গোলটেবিলে মধ্যাহ্নভোজ সারার সময় এক অসহায় মহিলা এসে বললেন, ‘স্যার, আমার মেয়ের বিয়ে আটকে রয়েছে দশ হাজার টাকার জন্য। পাত্রপক্ষ ওই টাকা না দিলে বিয়ে করবে না বলছে। কী করব স্যার?’ সুব্রত রণংদেহি হয়ে জানিয়েছিলেন, ‘যে ছেলে পণ নিয়ে বিয়ে করতে চায়, তার হাতে মেয়েকে দেবেন না, সে মনের দিক থেকে ভাল হবে না। তবে যখন আপনারা পছন্দ করেছেন, আমার তো কিছু বলার নেই। একটু বসুন, আমি খেয়ে নিয়ে টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’ এসে ওই মহিলার হাতে দশ হাজার টাকার একটা বেয়ারার চেক সই করে দিয়ে দিয়েছিলেন।
ময়দানের বহু প্রাক্তন ফুটবলারের থেকে মানুষ সুব্রত অন্যরকম। অনেক বেশি উদার। কারও দুঃখ দেখতে পারেন না। একবার সুভাষ ভৌমিক বলেছিলেন, ‘বাবলুর হৃদয়টা নারকেলের মতো। বাইরেটা কঠিন, ভেতরটা তরল।’
সুব্রতর ষোলো আনা বাবলু বইটি পড়ে এভাবেই পরতে পরতে মাঠের বাবলুকে চেনা গিয়েছে। তিনি কথা বলতে গিয়ে নিজের স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছেন। তাঁর হদয়টা সমুদ্রের মতো বিশালাকার। সেখানে ছোট ছোট নুড়িপাথরের কোনও জায়গা নেই। সমুদ্রের তরঙ্গে বালি-পলি, নুড়ি-পাথর সব কালের নিয়মে ভেসে গিয়েছে।
বইটিতে নামী ক্রীড়া সাংবাদিক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় মহাভারতের সঞ্জয়ের ভূমিকা নিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রের সঞ্জয়ের মতো সুপ্রিয় সুনিপুণভাবে বাবলুর বলা কথার ধারাভাষ্য দিয়ে গিয়েছেন তাঁর লেখনির মাধ্যমে। বাবলু এতই খুঁতখুঁতে যে মোট ৬৬ বার অডিও নিয়েছেন সুপ্রিয়। একবারও বিরক্তিপ্রকাশ করেননি। কারণ তিনি জানেন সুব্রত এমন এক মেজাজি চরিত্র, কোনও সময় গল্প করতে করতে মুড অফ হলেই বলে দিতে পারেন, তুমি এসো ভাই, আমার জীবনচরিত লিখে কাজ নেই, আমার মন ভাল নেই!
সুব্রত এমনি খোলা পাতার মতো। অনর্গল বলে যেতে পারেন। ঘটনা, তথ্য সব মনে রাখতে পারেন। অসম্ভব ভাল স্মৃতিশক্তি। তাই বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে যেন বর্তমান ফুটবল জীবনের গল্প বলছেন।
ফুটবলার জীবনে, কোচিং জীবনে, ব্যক্তিগত জীবনে, এমনকি পারিবারিক জীবনের নানা সুখ-দুঃখের কথা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন, এটাই এই বইয়ের প্রাপ্তি। আত্মজীবনী মানে ভালকে ভাল, মন্দকে মন্দ বলতে পারার সাহস দরকার হয়, কলজে থাকতে হয় সিংহের মতো।
সতীর্থ ফুটবলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা সখ্যের অভাব। কোচের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। ময়দানের রাজনীতি, কর্তাদের সঙ্গে দূরত্ব, এমনকী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মতের অমিল, সবটাই চিরবিদ্রোহী সুব্রত বলেছেন অনায়াসে, অবলীলায়।
প্রেম-বিবাহ, মোহনবাগানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। দুটি সুসন্তান, পাশাপাশি জামাই সুনীল ছেত্রী সম্পর্কে মূল্যায়ণ করেছেন বাড়ির অভিভাবকের মতোই।
বইটি হাতে নিলেই ভাললাগার একটা ব্যাপার চলে আসে। কোথাও যেন মনে হয় এই বইয়ের খোঁজেই যেন ছিল শিক্ষার্থী ফুটবলাররা। সুব্রতর অপরিসীম লড়াই, মাতৃভক্তি নতুন প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় বিষয়। জীবনে কোনওদিন কমফোর্ট জোনে থাকেননি, সবসময় লড়াই করে গিয়েছেন। তাই জীবনের কথা বলতে গেলে সুব্রত এখনও সমান বাস্তববাদী, প্রাসঙ্গিকও।
বইয়ের ছবিগুলি সত্যিই অমূল্য, একেকটি রত্ন। পাতা উল্টোলে মনে হবে আরও জানি, আরও পড়ি। বইটির সম্পাদনা করেছেন যিনি সেই কিংবদন্তি ক্রীড়া সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যের লিখিত বইয়ের সংখ্যা মোট ৫৫টি। তিনি বইয়ের বিন্যাস, সম্পাদনা এত সুনিপুণভাবে করেছেন, মনে হবে কোথাও যেন ‘জিবি-টাচ’ (গৌতম ভট্টাচার্যকে সাংবাদিকমহলে সংক্ষেপে ডাকা হয় জিবি নামে) বইয়ের মান আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
গৌতম সাংবাদিকদের মধ্যে পোলভল্টের সের্গেই বুবকা, যিনি নিজেই নিজের রেকর্ড বারবার ভাঙেন। যাঁর প্রাণশক্তি, বই লেখার অদম্য জেদ হাঁটুর বয়সিদের কাছে বড় প্রেরণা হতে পারে। তিনি বছরের পর বছর এখনও প্রমাণ করে চলেছেন ‘সুদক্ষ সাংবাদিক’ হিসেবে, এটিও প্রেরণার আরও এক জলতরঙ্গ।
দীপ প্রকাশনের মুদ্রণ, বইটিকে এত সুন্দরভাবে পরিবেশন ও প্রচার করেছেন যে বইটি ইতিমধ্যেই হটকেক হয়ে গিয়েছে। দীপের মালিক দীপ্তাংশু মণ্ডলের কাছে বারবার হয়তো অনুরোধও আসছে, বইটির ষষ্ঠ সংস্করণের জন্য। তিনি নিজেও খেলা অন্তপ্রাণ মানুষ। নিজের খরচে কাতার বিশ্বকাপ দেখতে চলে গিয়েছিলেন ফুটবল মহোৎসবে শামিল থাকবেন বলে। খেলাকে ভালবাসেন বলেই খেলা নিয়ে বই প্রকাশ করে বারবার বাকিদের দশ গোল দেওয়ার চ্যালেঞ্জটাও নিতে পারেন অনায়াসে। দীপ্তাংশুরই মন্তব্য, খেলাধুলোর বইয়ের ক্ষেত্রে এটাই সর্বকালীন (বিক্রির) রেকর্ড।
বইয়ের নাম : ষোলো আনা বাবলু
সুব্রত ভট্টাচার্যের বিতর্কিত আত্মজীবনী
অনুলেখক : সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
সম্পাদনা ও বিন্যাস : গৌতম ভট্টাচার্য
প্রকাশক : দীপ প্রকাশন
বইয়ের মূল্য : ৩০০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান : কলেজস্ট্রিট ও সব বইয়ের দোকান