শেষ আপডেট: 4th February 2025 16:56
রূপক মিশ্র
মেদিনী গ্রাস করেছে রথের চাকা। আর নতশিরে ললাটলিখন মেনে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন বীর কর্ণ। কিংবা নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে তস্করের ছলে প্রবেশ করা লক্ষণের হাতে নিরস্ত ইন্দ্রজিৎ মৃত্যুর আগে হতঃশ্বাস, হতবীর্য।
বিশ্বকাপের ফাইনালে পেনাল্টি মিস করার পর রবার্তো বাজ্জিওর কোমরে হাত দিয়ে মাটির দিকে চেয়ে থাকার স্মরণীয়, বেদনাঘন ইমেজের সঙ্গে এই দুই পুরাণপ্রতিমার মিল কি নেহাতই আপতিক? একদিকে প্রতিভাবান অন্যদিকে ভাগ্যবিড়ম্বিত। একাধারে বন্দিত ও নিন্দিত৷ উত্থান ও পতন, সাফল্য ও ব্যর্থতায় ভরা জীবননাট্যের এই তিন কুশীলবের সংযোগকে কি স্রেফ ‘কষ্টকল্পনা’ বলে এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে?
১৯৯৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ইতালি ও ব্রাজিল। সেবার আয়োজক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ শেষ লড়াইয়ের মঞ্চ ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোল স্টেডিয়াম। সেই প্রথম কোনও বিশ্বকাপ ফাইনাল অতিরিক্ত মিনিট পেরিয়ে পেনাল্টি পর্যন্ত গড়ায়। যেখানে তিন-দুইয়ে এগিয়ে থাকা ব্রাজিলকে চাপে ঠেলতে এবং নিজেদের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতে ইতালিকে গোল করতেই হত৷ এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সেন্টার সার্কেল থেকে ধীর পায়ে হেঁটে আসেন বাজ্জিও৷ টুর্নামেন্টের ফর্মে থাকা গোলদাতা, ইতালির পরিত্রাতা। যাঁকে ছাড়া আজ্জুরিদের ফাইনালে ওঠার ন্যূনতম কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।
ক্লাবের হয়ে নিয়মিত পেনাল্টি নেন। বরাবরই যিনি শান্ত, স্থির, অচঞ্চল স্বভাবের। চলতি টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জেরে যিনি আত্মবিশ্বাসে ফুটছেন—এমন স্ট্রাইকার পেনাল্টি মিস করবেন এবং শুধু মিস না—তাঁর লক্ষ্যহীন শট তেকাঠির টার্গেট পর্যন্ত ছোঁবে না—এটা অতিবড় ব্রাজিল ভক্তও আগাম আঁচ করতে পারেননি। বাজ্জিও নিজেও কি পেরেছিলেন? চাপ সইতে না পেরে পেনাল্টি কিক বাইরে মেরে, দেশবাসীকে দেখানো স্বপ্ন এত লঘুচালে নিজের হাতেই চুরমার করার জন্য কি নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল তাঁর? ক্যালিফোর্নিয়ার রৌদ্রস্নাত স্টেডিয়ামের একটা বড় অংশ যখন উল্লাসে, আনন্দে বাঁধনহারা, হলুদ জার্সির স্রোত বয়ে যাচ্ছে গ্যালারি জুড়ে, তখন ফোটোগ্রাফারদের ক্যামেরা সেই আলোর উৎসার এড়িয়ে লেন্স পেতেছিল বাজ্জিওর দিকে। জুম ইনে ফুটে উঠছিল এক খর্বকায়, নতশির, পরাক্রমী যোদ্ধার অবয়ব। উচ্ছ্বাসের মধ্যে বিষাদ। আবাহনের আড়ালে বিসর্জন। সাফল্যের অন্দরে অবসাদ। জীবনের এই শাশ্বত চালচিত্রই যেন ধরা পড়েছিল রোজ বোল স্টেডিয়ামে৷
এই বিয়োগান্তক অথচ আইকনিক ছবি একজন খেলোয়াড়কে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। রৌদ্রতপ্ত দিনে পেনাল্টি সার্কেলের পাশে দাঁড়ানো একাকী, নি:সঙ্গ বাজ্জিও-ও পুড়ে গেছিলেন। কিন্তু ফুরিয়ে যাননি। ফিরে এসেছিলেন। পরপর তিনটি বিশ্বকাপে গোল করার অনন্য রেকর্ড গড়েছিলেন। ক্লাবের হয়ে জিতেছিলেন সিরি আ খেতাব। চোট-আঘাতে দীর্ণ কেরিয়ারে বারবার শুধু ফিরেই আসেননি। তাকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। ইন্টার মিলান, এসি মিলান, জুভেন্তাসের মতো ইতালির তাবড় তাবড় ক্লাবে খেলেছেন। পারস্পরিক বৈরিতা ভুলে সমস্ত সমর্থকই তাঁকে আপন করে নিয়েছে। হয়ে উঠেছেন ইতালীয় ফুটবলের ‘পোস্টার বয়’!
কিন্তু এত ভাঙন, এত যন্ত্রণা, এত বিতর্ক এড়িয়ে কী করে নিজেকে ধাতস্থ করলেন বাজ্জিও? ‘দ্য ম্যান হু ডায়েড স্ট্যান্ডিং’ (একজন মানুষ যিনি দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন) বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক মুহূর্তটিকে বোঝাতে মিডিয়া এই লব্জই সেঁটে দিয়েছিল যাঁর গায়ে, তিনি কীভাবে কেরিয়ারে কামব্যাক করেছিলেন? বাজ্জিও নিজে কিছুই লুকিয়ে রাখেননি। একবার নয়, বারবার এই রহস্য খোলসা করে জানিয়েছেন—বৌদ্ধধর্মই তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বুদ্ধের বাণীই তাঁর শক্তি৷ যার কৃপায় জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছেন। খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও ঘুরে তাকানোর স্বপ্ন দেখেছেন।