শেষ আপডেট: 31st January 2025 19:13
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আপনি কি রিয়াল মাদ্রিদের অন্ধ ভক্ত? দুধ-সাদা জার্সি গায়ে রোনাল্ডো, মার্সেলো, রাউল, রবার্তো কার্লোসদের কথা ভাবলে চকিতে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন? ফ্লাডলাইটের আলোয় উদীপ্ত সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে এমবাপে, ভিনিসিয়াসদের খেলতে দেখলে গায়ের রক্ত ওঠে ছলকে? সোল্লাসে বলে ওঠেন: ‘হালা মাদ্রিদ!’? তাহলে সাত মিনিটের মাথায় ঘরের মাঠে নিয়ম করে প্রতিটি ম্যাচে কার নাম ধরে আজও গান গেয়ে ওঠেন সমর্থকেরা?—এই প্রশ্নের উত্তরটিও নিশ্চয় আপনার অজানা নয়। কী বলছেন? রোনাল্ডো? হল না। জিদান? আবার ভুল।
এর সঠিক উত্তর: হুয়ানিতো। পুরো নাম জুয়ান গোমেজ গঞ্জালেস। সংক্ষেপে: হুয়ানিতো। স্প্যানিশ ফুটবলার। আটের দশকে একের পর এক খেতাবজয়ী রিয়াল মাদ্রিদ টিমের সদস্য। কিন্তু সদস্যই। কোনওভাবেই রোনাল্ডো কিংবা করিম বেঞ্জিমার মতো নিয়ন্তা, ভাগ্যবিধাতা নন। যিনি একা হাতে গোটা মরশুমজুড়ে দলকে ট্রফি জিতিয়েছেন।
তাহলে এত নক্ষত্রদের ছেড়ে কেন হুয়ানিতোর নামে জয়ধ্বনি দেন মাদ্রিদের অনুগামীরা? যেখানে তাঁর খেলোয়াড়জীবন আদ্যোপান্ত বিতর্কে মোড়া। ম্যাচ হেরে রেফারিকে ঘুষি মেরে নির্বাসনে গেছেন। জার্মান তারকা লোথার ম্যাথিউজকে লাথি কষিয়ে পাঁচ বছর ফুটবলের ময়দান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তারপর গাড়ি দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন প্রাণ। এমন বিতর্কিত, ট্র্যাজিক চরিত্রকে ‘নায়ক’ বানাতে কেন দু’বার ভাবেনি রিয়াল-সমর্থককুল? যেখানে সাত নম্বর জার্সি মাদ্রিদের ইতিহাসে বরাবর ‘আইকনিক’। কত তারকার নাম মিশে রয়েছে ওই একটিমাত্র সংখ্যায়!
এর উত্তর: হুয়ানিতো শুধুই ফুটবলার নন। হুয়ানিতো একটা প্রতীকের নাম। তিনি অদম্য স্পিরিটের প্রতীক, হার না মানা অটুট জেদের প্রতীক, খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে ফিরে আসার প্রতীক। এই প্রতীককেই বন্দনা করে মাদ্রিদিস্তারা। এখনও প্রতি ম্যাচে সাত মিনিটের মাথায় গমগম করে ওঠে আঁজলা আঁজলা আলোয় উপচে ওঠা বের্নাবেউয়ের প্রতিটি কোণ। সাত মিনিট গড়ালেই গেয়ে ওঠেন সক্কলে—‘হেই হেই হেই হুয়ানিতো দ্য ওয়ান্ডার!’
স্টাইলের নিরিখে হুয়ানিতো ছিলেন উইঙ্গার। মাঠের টাচলাইন ঘেঁষে ছুটে যেতেন ক্ষিপ্রগতিতে। শারীরিকভাবে দুর্ভেদ্য। কঠিন ট্যাকল খেয়েও উঠে দাঁড়াতেন তক্ষুনি। যার সুবাদে রিয়ালের দলে জায়গা পাকা করে ফেলেন কড়া ধাতের ফুটবলারটি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত পাঁচটি লিগ খেতাব দখল করে রিয়াল। নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন হুয়ানিতো। ১৯৮৪ সালে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। হাতে আসে ঐতিহ্যাবাহী ‘পিচিচি ট্রফি’।
কিন্তু রেকর্ড তো স্রেফ মহাফেজখানার জন্য। একজন ফুটবলার বেঁচে থাকেন অনুরাগীদের স্মরণে, মননে। আর সেই স্থান পাকা হয় তাঁর খেলোয়াড়ি চারিত্র্যের ঊর্ধ্বে মানুষী আবেগের দৌলতে। হুয়ানিতো রিয়ালে পা রাখার প্রথম দিন থেকেই এই সম্মান অর্জন করেছিলেন। কট্টর প্রতিপক্ষ অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের অ্যাকাডেমিতে নিজেকে তৈরি করেও তিনি প্রথমে চলে যান দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব বোর্হসে। সেখান থেকে দলকে প্রথম ডিভিশনে তুলে আনেন। পান সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান। ডাক আসে স্পেনের জাতীয় ফুটবল দল থেকে। আর সেই সুবাদে নজরে আসেন মাদ্রিদের। চুক্তিতে সই করেন ১৯৭৭ সালে, বার্সেলোনার আগ্রহকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করে।
মাদ্রিদের অন্য একটি ক্লাবে গড়েপিটে ওঠা একজন ফুটবলার চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার ডাকে সাড়া না দিয়ে তাদের ক্লাবে সই করছেন। বেঁটেখাটো চেহারা। অথচ অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বিনা যুদ্ধে সামান্যতম জমি ছাড়তে নারাজ। রিয়ালের স্পিরিটের সঙ্গে খাপ খায়—এমন সমস্ত উপাদান হুয়ানিতোর রক্তে মজুত ছিল। তাই তিনি অচিরেই ক্লাবের বিশ্বস্ত প্রহরীতে পরিণত হন!
কিন্তু আলোর আড়ালেই যেন লুকিয়ে ছিল অন্ধকার! ইস্পাতকঠিন স্নায়ুরই অন্য একটা প্রান্তে জুড়ে ছিল বাঁধভাঙা অসংযম। পরের বছর, ১৯৭৮ সাল থেকেই মিলতে থাকে এর প্রমাণ। সেই মরশুমে আনকোরা সুইশ ক্লাব গ্লাসহপারের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্যভাবে হেরে যায় রিয়াল। ইউরোপিয়ান কাপ (অধুনা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) থেকে বিদায় নিশ্চিত। এই অবস্থায় ম্যাচের শেষ মুহূর্তে রেফারি রিয়ালের একটি গোল অফসাইডের কারণে বাতিল করেন। প্রথমে তর্কাতর্কি। তারপর রাগের মাথায় সেই রেফারিকে ঘুষি মেরে বসেন হুয়ানিতো। রেড কার্ড তো বটেই। শৃঙ্খলাভঙ্গ কমিটি তাঁকে দু’বছরের জন্য নির্বাসিত করে। পরে সেই সাজার মেয়াদ অনেকটা কমানো হয়।
ভুল থেকে শিক্ষা নেয় মানুষ। হুয়ানিতোও নিয়েছিলেন। যার নজির পরের তিনিটে মরশুম। তিনবারই লিগ ঘরে আনে রিয়াল। কাণ্ডারীর ভূমিকায় স্বয়ং হুয়ানিতো। সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ডে সান্টিয়ানা, মিডফিল্ডে পেরি, ভিনসেন্ট ডেল বস্কে আর রক্ষণে গুয়েবাতিনো—তারকাখচিত মাদ্রিদের পতাকাবাহক হয়ে উঠেছিলেন একজনই—হুয়ানিতো।
স্পেনের জমিতে জয়ধ্বজ্জা পোঁতা শেষ। এবার ইউরোপ জয়ের পালা। ১৯৮০ এবং ১৯৮৫ সালের (অধুনা) চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দুটি ম্যাচ পোড়খাওয়া মাদ্রিদ সমর্থকেরা এখনও মনে রেখেছেন। প্রথমটা সেল্টিকের বিরুদ্ধে, কোয়ার্টার ফাইনাল। যেখানে ২-০-তে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ রিয়াল মাদ্রিদ ৩-০ ব্যাবধানে জিতে নেয়। আর ১৯৮৫ সালে জার্মান ক্লাব বুরুসিয়া মঞ্চেনগ্ল্যাডব্যাচ ঘরের মাঠে ৫-১ গোলে হারানোর পর সবাই যখন ধরেই নিয়েছিল রিয়ালের ছাঁটাই হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, তখন সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ে ফিরতি লেগে ৪-০ গোলে প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করে মাদ্রিদ। দুটি ম্যাচেই জয়সূচক গোলটি করেছিলেন হুয়ানিতো। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে যখন টাচলাইন ধরে ডাগআউটের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পরম উচ্ছ্বাসে হাত দুটো মুঠো করে ছুড়ে দেন তিনি। আর লাফিয়ে ওঠেন প্রবল উদ্যমে। সেই উদ্যম, সেই উচ্ছ্বাস সংক্রামিত হয় দর্শকদের মনেও। সবাই গেয়ে ওঠেন তাঁর নাম। সেই শুরু… এরপর কখনও ইন্টার মিলান, কখনও বার্সেলোনা, একের পর এক লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েও ফিরে আসার গল্পের নায়ক হয়ে ওঠেন হুয়ানিতো। হয়ে ওঠেন রিয়ালের স্বপ্নের প্রতীক।
কিন্তু আলোর সঙ্গে মিশে থাকা অন্ধকার ফের বেরিয়ে আসে। ১৯৮৭ সালে। ভেন্যু: বায়ার্নের ঘরের মাঠ। উপলক্ষ্য: ইউরোপিয়ান কাপের সেমিফাইনাল। সেই ম্যাচ চলাকালীন মাথা গরম করে লোথার ম্যাথিউজকে জোরে ধাক্কা মারেন হুয়ানিতো। যন্ত্রণায় শুয়ে পড়েন ম্যাথিউজ। কিন্তু এতেই নিরস্ত না হয়ে চালাতে থাকেন লাথি। পরপর। কখনও মুখে, কখনও-বা ঘাড় লক্ষ্য করে। মারাত্মক যখম হন জার্মান তারকা। এই ভয়ঙ্কর ঘটনার জেরে হুয়ানিতো ফের একবার নির্বাসিত হন। এবার পাঁচ বছরের জন্য। যার মেয়াদ বারবার আপিলের পরেও কমানো হয়নি।
রিয়াল ছেড়ে দেয় হুয়ানিতোকে। পাঁচ বছরের নির্বাসন শেষে, যখন তাঁর বয়স ৩৭ বছর, তখন মালাগার হয়ে ফের একবার মাঠে নামবেন তিনি। কিন্তু ততদিনে সূর্য অস্তমিত হয়েছে। কিন্তু খেলার জমি ছেড়ে দেওয়া যে কোনওমতে সম্ভব নয়! তাই ফুটবলারের জার্সি খুলে রাখলেও কোচের জ্যাকেট গায়ে চড়ান হুয়ানিতো। দায়িত্ব নেন স্পেনের দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব মারিডার।
১৯৯২ সাল। রিয়ালের ম্যাচ দেখে বাড়ি ফিরছেন হুয়ানিতো। সেই রাতেই গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চিরচঞ্চল, চির অস্থির এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডার। দুর্ঘটনার খবর প্রকাশ করতে গিয়ে বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘এল পে’ তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিল: ‘হুয়ানিতোর মৃত্যু আসে তাঁর জীবনের দুটি প্যাশনের মাঝ-ঘেঁষে!’
এমন মর্মান্তিক মৃত্যুকে মনে রাখতে চাননি মাদ্রিদের সমর্থকেরা। মনে রাখেননি তাঁরা। তামাম মাদ্রিদিস্তা হৃদয়ে রেখেছেন হুয়ানিতোর সেই অমর উক্তি: ‘সান্তিয়াগোর নব্বই মিনিট লম্বা সময়… অনেকটাই লম্বা সময়।‘ তাই আজও ‘স্পিরিট অফ হুয়ানিতো’র স্মরণে সাত মিনিটের মাথায় টিফো তুলে ধরেন রিয়াল অনুরাগীরা। আজও হারতে থাকা ম্যাচে গেয়ে ওঠেন তাঁর নাম। আর নব্বই মিনিট ছুঁইছুঁই ম্যাচে কখনও বেঞ্জিমার বুলেট হেডার, কখনও রোনাল্ডোর বোমারু দূরপাল্লার শটে ম্যাচে ফেরে, তারপর লড়াই জিতে নেয় রিয়াল। বিশ্লেষকদের মগজ এর ব্যাখ্যা খুঁজে না পেলেও রিয়ালের অনুরাগীরা জানেন এর রহস্য স্রেফ একটিমাত্র গান। যার বুলি: ‘…হেই হেই হেই হুয়ানিতো দ্য ওয়ান্ডার!’