অলিম্পিকের জন্য সেজে উঠেছে আইফেল টাওয়ারের শহর।
শেষ আপডেট: 25th July 2024 20:14
এককালে এই শহর পথ দেখিয়েছিল জনতাকে। এককালে এই শহর চোখে চোখ রেখে রাজতন্ত্রকে টেনে নামানোর শপথ নিয়েছিল টেনিস কোর্টে দাঁড়িয়ে। এককালে এই শহর সারা পৃথিবীকে তিন শব্দের মোক্ষম মন্ত্র দিয়েছিল। স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব। শতক পার করেও এই মন্ত্র আজও বিশ্বের নানা দেশে গণতন্ত্রের প্রেরণা জোগায়। এককালে এই শহরের এক নাম-না-জানা গির্জাকে সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণে পাল্টে দিয়েছিল স্রেফ একটা উপন্যাস। আবার কবিতার শহরকে কবিতা দিয়েই বিষাক্ত, অভিশপ্ত ফুলে রূপ দিয়েছিলেন এই শহরের এক কবি।
প্যারিস। রাত পোহালেই, ভারতীয় সময় মধ্যরাতের ঘন্টাখানেক আগে ফ্রান্সের রাজধানীতে শুরু হবে 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'। খেলাধুলোর সর্বশ্রেষ্ঠ মঞ্চ, ২০২৪ অলিম্পিক। ফরাসি বিপ্লবের শহর, ভিক্টর হুগো-বোদলেয়র-মপাসাঁর শহর, নোতরদাম গির্জার শহর মেতে উঠবে ১৮ দিনের জৌলুসে। ৩২ খেলার ৩২৯ ইভেন্টে সাড়ে দশ হাজারেরও বেশি প্রতিযোগী অংশ নেবেন। সরাসরি সেসব দেখবেন সারা পৃথিবীর মানুষ। শুধু ভারত থেকেই এবারের প্রতিযোগী ১১৭ জন।
বিপ্লবের শহর প্যারিস। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে আজ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়ানো হয়, তার পাঠক্রমের অনেক কিছুই তৈরি করে দিয়েছিল এই শহর। অলিম্পিক শুরুর এক মাস আগেও তীব্র ডামাডোলে কার্যত দিশেহারা ছিল প্যারিস। আচমকা নির্বাচন ঘোষণা করে দিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাকরঁ। তার প্রথম রাউন্ডে লাগামছাড়া জনপ্রিয়তা ছিনিয়ে সাড়া ফেলে দিলেন উগ্র দক্ষিণপন্থী মেরিঁ লা পেঁন। দ্বিতীয় রাউন্ডে কড়া চ্যালেঞ্জ করলেন বামপন্থীরা। শেষ অবধি যা অবস্থা হল, তাতে ম্যাকরঁকে ঘোষণা করতে হল, অলিম্পিক অবধি তিনি অন্তর্বর্তীকালীন কেয়ারটেকার সরকারই রাখবেন। নয়ত সব ঘেঁটে যেতে পারে।
প্যারিস অলিম্পিকেরও শহর বটে। এই নিয়ে তৃতীয়বার অলিম্পিকের আসর বসছে প্যারিসে। অবশ্য এর আগের দু'বার যখন বসেছিল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখনও তরুণ নেতা। ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২৪ সালে শেষবার অলিম্পিক হয়েছিল এখানে। তার আগেরবার? ১৯০০ সালে।
অলিম্পিকের বহু লড়াই ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। কখনও ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে উসেইন বোল্ট, কখনও জলে মাইকেল ফেল্পস, কখনও বর্শা হাতে নীরজ চোপড়া, কখনও এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য মিলখা সিংহ, কখনও পিস্তল হাতে অভিনব বিন্দ্রা! ইতিহাসের টুকরো মুহূর্ত প্রতি অলিম্পিকে জায়গা করে নেয়। কথায় বলে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে! অলিম্পিকে এটা উল্টো। এখানে, ওস্তাদের আসল মারটা দেখা যায় প্রথম রাতে! অর্থাৎ, উদ্বোধনে। এখানে অলিখিত নিয়মটাই তাই। পনেরো-কুড়ি দিন ধরে যে যা পদক জেতার জিতে নাও। কিন্তু প্রথম রাতটা উদ্যোক্তাদের জন্য। বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উঠে আসে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য থেকে পৃথিবীর নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সবকিছু। যেমন রিও ২০১৬। মারাকানা স্টেডিয়ামে উঠে এসেছিল ব্রাজিলের অজস্র সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ, সঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়ণ নিয়ে নানা কথা। তার আগের লন্ডন ২০১২-তে অলিম্পিক উদ্বোধনে স্বয়ং রানি এলিজাবেথকে নিয়ে এসেছিলেন 'জেমস বন্ড' ড্যানিয়েল ক্রেগ। পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বিশ্ববিখ্যাত হলিউড পরিচালক ড্যানি বয়েল। তার আগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটাকে অবশ্য অনেকে বলেন, অলিম্পিক ইতিহাসটাই পাল্টে দিয়েছিল। বেজিং ২০০৮। বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়ামে, ৯১ হাজার দর্শকের সামনে চার ঘন্টা ধরে ১৫ হাজার শিল্পী মিলে যে অত্যাশ্চর্য, অতিনাটকীয়, অতিকায়, বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান চলেছিল, দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সারা দুনিয়া। পরিচালনা করেছিলেন বিখ্যাত চিনা পরিচালক ঝাং ইয়িমৌ। চিনের গৌরব ও সাফল্যের সর্বোত্তম বিজ্ঞাপন ছিল সেই অলিম্পিক উদ্বোধনী।
প্যারিস কি পারবে, বেজিংকে টক্কর দিতে?
তিন বছর আগের টোকিওতে কোভিডের জন্য অনেকটাই ফিকে ছিল উদ্বোধনী। এবারে আর সেই কোভিড-ভীতি নেই। কিন্তু ইতিহাসে প্রথমবার অলিম্পিকের পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে অলিম্পিক স্টেডিয়ামের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে প্যারিস। হিসেব মত ফ্রান্সের জাতীয় ক্রীড়াঙ্গন 'স্টেড দে ফ্রান্স'-এর মাঠে না হয়ে এবার উদ্বোধন হবে প্যারিসের প্রাণভোমরা সেইন নদীতে। কলকাতার যেমন গঙ্গা, লন্ডনের যেমন টেমস, ভিয়েনার যেমন দানিয়ুব, কোলনের যেমন রাইন, বাগদাদের যেমন টাইগ্রিস... প্যারিসের তেমনই সেইন। আজ একুশ শতকের যান্ত্রিক জীবনেও সেইন প্যারিসের আমজনতার কাছে বড়ই আবেগের। সেই সেইনের ৬ কিলোমিটার লম্বা একটা অংশকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। ছোট ছোট নৌকোয় করে খেলোয়াড়দের চাপিয়ে ওই অংশটা ভাসিয়ে আনা হবে একেবারে শহরের মধ্যিখানে। ওটাই অলিম্পিকে প্যারেড। প্রতিটি নৌকোয় লাগানো থাকবে অত্যাধুনিক ক্যামেরা। যাতে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে একেবারে 'ক্লোজ আপ' ফ্রেমে দেখা যাবে।
পুরো যাত্রাপথের দু'পাশে দর্শকদের বসার জন্য পেল্লায় সব গ্যালারি বসানো হয়েছে। তাছাড়া দাঁড়িয়েও দেখা যাবে। শহরের পুবদিকে, অস্তেঁরলিৎজ সেতুর পাশ থেকে নৌকোর দল ছাড়বে। একাধিক সেতুর তলা দিয়ে ভেসে পশ্চিমে আসবে তারা। পথেই দেখা যাবে একাধিক অলিম্পিক ভেন্যু। দেখা যাবে গ্র্যান্ড প্যালেস, এসপ্ল্যানেদ দে ইনভ্যালিদেস, নোতর দাম গির্জা। তারপর একেবারে গার্ডেন অফ ত্রোকাদিয়েরোতে এসে নৌকো থামবে। উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে প্যারিসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক, আইফেল টাওয়ার।
প্যারিসের সময় সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় শুরু অনুষ্ঠান। চলবে রাত এগারোটা অবধি। ভারতীয় সময় অবশ্য রাত এগারোটাতেই শুরু উদ্বোধনী। চলবে মাঝরাত অবধি। প্যারিসের মেয়র বলেছেন, আগামীকাল সারারাত শহরের সমস্ত ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ খোলা থাকবে। চাইলে সারারাত কেউ রাস্তায় থাকতে পারবেন। ইতিমধ্যেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট চড়া দামে বিকোচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ৯০ থেকে ২৭০০ ইউরো অবধি টিকিটের দাম পৌঁছে গিয়েছে। অলিম্পিক মশাল বহনের জন্য প্যারিসে এসে পৌঁছেছেন স্নুপ ডগ, সালমা হায়েকের মত তাবড় শিল্পীরা।
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপরেই, আমাদের অপেক্ষা শুরু। তাকিয়ে থাকব এবারের নতুন নীরজ চোপড়া, অভিনব বিন্দ্রাদের দিকে। টোকিও অলিম্পিকের পর ভারতের পদক স্বপ্ন কার্যত আকাশছোঁয়া। কাল অলিম্পিকে ভারতের নৌকোয় পতাকা বইবেন পিভি সিন্ধু ও শরৎ কমল। শোনা যাচ্ছে, ভারতীয় খেলোয়াড়রা সাবেক ভারতীয় পোশাকেই থাকবেন। পুরুষরা পরবেন কুর্তা, মহিলারা শাড়ি।
ইউরো শেষ। কোপা শেষ। উইম্বলডন শেষ। টি-২০ বিশ্বকাপ শেষ। এবার শুরু সব খেলার সেরা... অলিম্পিক।