শেষ আপডেট: 27th July 2024 20:48
নামেই 'ভিলেজ'। আদতে প্রতি অলিম্পিকে খেলোয়াড়দের যে আস্তানা বানানো হয়, সেটি একটি অতিকায় অভিজাত কমপ্লেক্সের চাইতে কম কিছু নয়। এককালে অলিম্পিক হলে আলাদা 'ভিলেজ' বানানোর নিয়ম ছিল না। খেলোয়াড়দের হোটেল, হোস্টেল, স্কুল-কলেজ ভবন এমনকি নৌকাতেও থাকতে হত। ১৯২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে প্রথম 'ভিলেজ' বানানোর পরিকল্পনা করা হয়। সদ্য শেষ হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তখনও আর্থিক মন্দা। আক্ষরিক অর্থেই অস্থায়ী টিন বা টালির ছাউনি দেওয়া ঘরের মত বানানো হয়েছিল 'ভিলেজ'।
তারপর যত দিন এগিয়েছে, 'ভিলেজ' তত চোখধাঁধানো হয়ে উঠেছে। একতলা কুঁড়েঘরের জায়গা নিয়েছে আকাশছোঁয়া বহুতল। সঙ্গে যোগ হয়েছে পার্ক, বিনোদনের জায়গা, জিম, পুল-সহ আধুনিক পাঁচতারা হোটেলের বন্দোবস্ত। কোথাও ভিলেজের সাজসজ্জা হার মানায় রিসর্টকে। কোথাও আবার ভিলেজকে অত্যন্ত সাদামাটা রাখা হয়। বেজিং অলিম্পিকের পর যেমন খেলোয়াড়রা ভিলেজের জাঁকজমকের তারিফ করেছিলেন। লন্ডন অলিম্পিকে আবার সেই অর্থে ভিলেজের ঘরদোর থেকে অনেকে খুশি হতে পারেননি।
প্যারিস অলিম্পিকের ভিলেজ নিয়ে এবার যদিও সম্পূর্ণ নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে।
প্যারিসের উত্তরে, সেইনের ধারে সেন্ট ডেনিস, সেন্ট ওয়েন ও লিলে' সেন্ট ডেনিস শহরতলিতে তৈরি হয়েছে প্যারিস অলিম্পিকের ভিলেজ। এখানেই অলিম্পিকে অংশ নেওয়া চোদ্দ হাজার ক্রীড়াবিদ থাকবেন। প্রত্যেকদিন তাঁদের জন্য ৬০ হাজার খাবার পরিবেশন করা হবে। রয়েছে ২৪ ঘন্টার দোকানপাট, চিকিৎসাকেন্দ্র, চুল-দাড়ি কামানোর সেলুন, এমনকি উদ্যোক্তারা একটা আস্ত ডাকঘর অবধি বানিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সমস্যা একটাই। এত ব্যবস্থাপনা থাকলেও, অলিম্পিক ভিলেজে কোনও বাতানুকূল ব্যবস্থা নেই।
এবারের অলিম্পিককে যত রকম ভাবে পারা যায়, পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা চালাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এমনভাবে 'ভিলেজ' বানানো হয়েছে, যা অলিম্পিকের পরে একটি ছোটোখাটো শহরতলিতে পাল্টে ফেলা যাবে। অলিম্পিকের পরে ভিলেজের জায়গায় প্রায় আড়াই হাজার নতুন বাড়ি, একটি ছাত্রাবাস, একটি হোটেল, একটি পার্ক, অফিস, দোকানপাট, বাজার সবই গড়ে তোলা হবে। তেমনটাই পরিকল্পনা করা হয়েছে। ঠিক সেইভাবেই, কার্বন নিঃসরণ কমাতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যার অন্যতম, আয়োজকরা ভিলেজে কোনও বাতানুকূল বা এয়ার-কন্ডিশনিং ব্যবস্থা রাখেননি।
এমনিতে প্যারিসের আবহাওয়া এখন খুব গরম নয়। বর্ষা চলছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েছে। আজ, শনিবার, সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলছে। যার ফলে একাধিক প্রতিযোগিতা মাঝেমধ্যে বিঘ্নিত হয়েছে। তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ঘোরাফেরা করছে। কলকাতার হিসেবে, এতে এসির প্রশ্নই নেই। কিন্তু প্রশ্নটা তো অলিম্পিকের। সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীদের বেশিরভাগের জীবনের একমাত্র অভিজ্ঞতা হয়ত। জিতলে ইতিহাসে নাম লেখা হয়ে যাবে। এই অবস্থায় বাতানুকূল ব্যবস্থা ছাড়া কি থাকা যাবে?
এমনিতে ইউরোপের অনেক দেশেই বাতানুকূল ব্যবস্থার চল বিশেষ নেই। সম্প্রতি বিশ্ব উষ্ণায়ণের ঠেলায় যদিও অনেক দেশকেই এসির শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কিন্তু এই তালিকাতেও প্যারিস খানিক আলাদা। বহুদিন ধরে বাইরের দেশ থেকে যারা প্যারিসে বেড়াতে বা কাজে আসেন, তাঁরা এই অভিযোগটা তোলেন। এসির ব্যবস্থা এখানে খুব কম। সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে, ইউরোপে প্রতি দশ বাড়ির একটিতে হয়ত এসি খুঁজে পাওয়া যাবে। বরাবর ইউরোপীয় নেতারা দাবি করে এসেছেন, নীলগ্রহকে আমরাই গরম করে তুলছি। এরপর আমরা এসি লাগিয়ে নিজেদের আরামের জন্য একে আরও গরম করে তুললে তো পরে পস্তাতে হবে আমাদেরই। ফরাসি জনসাধারণও মোটের ওপর এসিতে বিশ্বাস করেন না। প্যারিসে অনেক ঝাঁ চকচকে অফিস বা গৃহস্থের ঘর পাওয়া যাবে, যাতে কোনও এসি নেই।
অতএব অলিম্পিকের আয়োজকরা ভিলেজেও অন্য রাস্তা নিয়েছেন। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে ভিলেজে এমন এক ব্যবস্থা বানানো হয়েছে, যাতে যান্ত্রিকভাবে সেইন নদীর ঠাণ্ডা জল ভিলেজের বিভিন্ন আবাসনের তলায় পাইপের মাধ্যমে প্রবাহিত করানো হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে উষ্ণতা প্রায় ১০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকছে। কিন্তু এতে কি রাতে ঘুমের নিশ্চয়তা মিলবে? অনেক দেশের খেলোয়াড়রাই এসি ছাড়া ঘুমোতে অভ্যস্ত নন। অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক কমিটির মুখ্য নির্দেশক ম্যাট ক্যারল যেমন বললেন, 'আমরাও চাই, এইভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো হোক। কিন্তু আমাদের তো বুঝতে হবে, এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিযোগিতা। আমরা তো পিকনিক করতে আসিনি।'
অবশ্য কেউ চাইলে পোর্টেবল এসি মেশিন দেওয়ার অনুরোধ করতে পারেন। চাইলেই তৎক্ষণাৎ সেই ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ!
যেমন আমেরিকানরা। এসি ছাড়া মার্কিন খেলোয়াড়রা এক পা-ও এগোনোর পক্ষপাতী নন। ৫৯২ জনের বিশাল দল এনেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লেব্রন জেমসদের বাস্কেটবল দল যেমন নিজেদের খরচে ভিলেজের বাইরেই থাকছে। কিন্তু যারা ভিলেজে থাকছেন, তাঁরাও আশামাত্র ঢালাও এসি দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। প্রত্যেক মার্কিন খেলোয়াড়ের ঘরে এসি দেওয়া হয়েছে। এমনকি খেলোয়াড়দের নিজস্ব কমন এরিয়াতেও পোর্টেবল এসি দেওয়া হয়েছে। অলিম্পিক আয়োজকরা জানাচ্ছেন, এখনও অবধি ৭০০০ ঘরের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ঘরেই পোর্টেবল এসি দেওয়া হয়েছে।
যথারীতি, এই তালিকা থেকে যতটা সম্ভব দূরে রয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো। যেমন ধরা যাক জার্মানি। সাড়ে তিনশো খেলোয়াড়ের এক বিশাল দল এনেছে জার্মানি। অথচ জারমান দলের এক কর্তা জানালেন, এখনও অবধি মাত্র ১১টি ঘরে এসি দেওয়া হয়েছে। এতেই আপাতত কাজ চলে যাচ্ছে। পরে তাপমাত্রা বাড়লে ভাবা যাবে।