সেইন নদীতে জলছে উদ্বোধনের মহড়া। (ছবিঃ রয়টার্স)
শেষ আপডেট: 26th July 2024 21:04
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বোধ হয় এত বড় নিরাপত্তাব্যবস্থা আর দেখেনি প্যারিস।
যুদ্ধ তো প্যারিসে নতুন নয়। একাধিকবার বিদেশী আক্রমণকারীর পদানত হয়েছে প্যারিস। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে আপন মেজাজে। ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধে চার মাস ধরে অবরুদ্ধ রাখার পরে শেষে পতন হয়েছিল প্যারিসের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আক্রমণের বিপদ ঘনিয়ে এসেছিল শহরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টানা চার বছর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দখলে ছিল প্যারিস। শঁস এলিজে ধরে টহল দিয়েছিল জার্মান সেনা। অত্যাচার চলেছিল সাধারণ নাগরিকের ওপর। রসদ সরবরাহ অবধি কমিয়ে দিয়েছিল ওয়েরমাখট। ইহুদিদের ধরে পাঠানো হয়েছিল অসউইৎজে। প্যারিস হার মানেনি। কালের স্রোতে সেইনের জল আপন খেয়ালে বয়ে গিয়েছে।
তারপর অর্ধশতক কেটে গিয়েছে। অথচ আজ, এই একুশ শতকের একটি অলিম্পিক উপলক্ষ্যে যা নিরাপত্তার বহর নামানো হয়েছে, দেখে অনেকেই বলছেন, এ তো যুদ্ধের আবহও হার মেনে যাচ্ছে!
সংখ্যার হিসেব দেখলে তাই মনে হয় বটে। ফরাসি প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, স্রেফ পুলিশই নামানো হয়েছে ৪৫০০০ জন। সঙ্গে ফরাসি বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য ও ২২ হাজার বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কর্মীকে নামানো হয়েছে কাজে। সব মিলিয়ে লন্ডন অলিম্পিকের তিনগুণ কড়া নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে প্যারিসে। শুধু তাই নয়। বিভিন্ন দেশের কাছে নিরাপত্তাকর্মী পাঠানোর আর্জি জানিয়েছে ফরাসি সরকার। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, তার বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা-সহ একাধিক দেশ থেকে নিরাপত্তা আধিকারিকরা উড়ে এসেছেন প্যারিসে। নিউ ইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলিস পুলিশ বিভাগের কয়েকজন শীর্ষ কর্তা এসেছেন প্যারিসে। ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর তরফেও দশটি প্রশিক্ষিত কুকুরকে পাঠানো হয়েছে। সংবাদসংস্থা রয়টার্স বলছে, বিদেশী নিরাপত্তাকর্মীদের সংখ্যাটা প্রায় আঠারোশো ছুঁই ছুঁই।
প্রেম, কবিতা, বিপ্লব, ভালবাসাকে ভাষা দিয়েছিল যে শহর, আজ তা কার্যত দুর্গে পরিণত। শহরের প্রাণকেন্দ্রকে ঘিরে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তার বলয়ে। খরচ বাঁচাতে নতুন স্টেডিয়াম বানানোর চাইতে পুরনো জায়গাকেই ঘষেমেজে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জায়গায় নিয়ে গিয়েছে প্যারিস। ফলে স্কেটবোর্ডিং ও ব্রেকডান্স ইভেন্টের জন্য বাছা হয়েছে প্লাসা দে লা কনকর্দেকে। আইফেল টাওয়ারের সামনে তৈরি হয়েছে বিচ-ভলিবলের বালি ফেলা কোর্ট। এসপ্ল্যানেড দে ইনভ্যালিদেসে নেপোলিয়নের সমাধির পাশে হবে তীরন্দাজি। টেনিসের আসর বসবে বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ওপেনের লালমাটির কোর্ট রোলাঁ গারোতে। ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকের পর এই প্রথম অলিম্পিক টেনিস হবে লালমাটির কোর্টে।
সেসব তো হবে। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে প্যারিস অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার জায়গা হবে উদ্বোধনী। ইতিহাসে এই প্রথমবার অলিম্পিক উদ্বোধনীতে পতাকা হাতে খেলোয়াড়রা স্টেডিয়ামে হাঁটবেন না। নৌকোয় চড়ে নদীতে ভেসে আসবেন আইফেল টাওয়ারের সামনে। প্যারিসের প্রাণভোমরা সেইন নদীর দু'পাশে স্রেফ এই উদ্বোধনী দেখতেই ভিড় হতে পারে প্রায় তিন লক্ষ দর্শকের। যাদের সামলাতে কার্যত নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে নিরাপত্তারক্ষীদের। এদিকে নিরাপত্তাবলয়ের বেষ্টনীতে দর্শকরাও কার্যত দিশেহারা। এমনিতেই এবারের অলিম্পিক নিয়ে আশঙ্কার অন্ত নেই। কিছুদিন আগে অবধি ডামাডোল চলেছিল ফরাসি রাজনীতিতে। একাধিক মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, হামলা চালাতে পারে কোনও ইসলামী জঙ্গিসংগঠন। ফলে ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিঁ রীতিমত লিখিত বার্তায় নিরাপত্তারক্ষীদের জানিয়েছেন, 'আমি কিন্তু আপনাদের প্রত্যেকের ওপর আশা রাখছি। সারা পৃথিবীর নজর আপনাদের ওপরেই থাকবে!'
অতএব কোনও ঝুঁকিতে যেতে আয়োজকরা রাজি নন। সেইনের ছয় কিলোমিটার অংশ জুড়ে চলবে উদ্বোধন। পুরো জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ইস্পাতের জাল দিয়ে রাস্তার মোড়ে-মোড়ে ব্যারিকেড বসানো। এক ফরাসি পুলিশ ইউনিয়নের কর্তা জানালেন, প্রতি ছয় ফুট অন্তর পুলিশ মোতায়েন করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নদীর ধারে যত ভবঘুরে থাকত, সবাইকে অস্থায়ী বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ট্র্যাফিক প্ল্যান ঢেলে সাজানো হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির এমন সব ক্যামেরা লাগানো রয়েছে, যাতে লাগানো অ্যালগোরদিম ফুটেজে কোনও অস্বাভাবিক ভিড়, আগুন বা কোনও ঝুঁকির লেশমাত্র দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে জানান দেবে। এমনকি ফরাসি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, উদ্বোধনী চলাকালীন প্যারিসের আশেপাশের সম্পূর্ণ আকাশসীমায় উড়ান বন্ধ রাখা হবে।
এখনও অবধি মাছি গলার মত ফাঁক না রাখলেও আয়োজকদের আশঙ্কা একের পর এক বেড়েই চলেছে। সেইন নদীর জলের মান নিয়ে উদ্বোধনের আগেও নানা মহলে প্রশ্ন ঘুরছে। বৃষ্টি হলেই নাকি জলের গুণমান খারাপের দিকে যাচ্ছে। এদিকে ফরাসি হাওয়া অফিস জানিয়েছে, উদ্বোধনের দিনেই নাকি বৃষ্টি হতে পারে। খোলা আকাশের নিচে, নদীর বুকে পরিকল্পনা করা বর্ণাঢ্য উৎসবের জৌলুস বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে না তো? প্রশ্ন অনেকেরই। শেষ অবধি বরুণদেব না বাঁচালে অশেষ দুঃখ আছে দর্শকদের। যারা টিকিট কিনেছেন, তাঁদের ফোনে টেক্সট মেসেজ চলে গিয়েছে, 'বৃষ্টির জন্য উপযুক্ত পোশাক পরে আসবেন। শুধুমাত্র 'রিট্র্যাক্টেবল' ছাতা নিয়ে যাওয়া যাবে।' হাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজ বিকেল গড়াতেই বৃষ্টি বাড়বে। প্রায় মধ্যরাত অবধি চলবে বৃষ্টি। এদিকে উদ্বোধন শুরুই হবে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়, অর্থাৎ ভারতীয় সময় রাত এগারোটায়।
দর্শকরাও মোটামুটি বৃষ্টির জন্য কোমর বেঁধেই আসছেন। মোটামুটি প্যারিস শহরের এখন দুটো ভাগ। এক ভাগে, জীবনযাত্রা মোটের ওপর স্বাভাবিক। অলিম্পিক বলে বাড়তি আগ্রহ নেই। বস্তুত, অলিম্পিক নিয়ে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে স্থানীয়রা অনেকেই তিতিবিরক্ত। অনেকে শহর ছেড়ে চলেও গিয়েছেন পনেরো দিনের জন্য। যারা আছেন, তাঁরাও মোটামুটি অলিম্পিকের চাইতে ফরাসি রাজনীতিতে এরপর কী হবে সেসব নিয়ে বেশি আগ্রহী। আর অপর ভাগে? একাধিক ব্রিটিশ সাংবাদিকের কথায়, এই প্যারিস যেন একটা ভূতুড়ে প্যারিস! সেইন নদীর দুই ধারে, শহরের প্রাণকেন্দ্র জুড়ে শুধু ধাতব জালের বেড়া আর পুলিশি টহল। কোথাও স্বাভাবিক জনজীবনের লেশমাত্র নেই। দোকানপাট খোলা। কিন্তু লোকজন নেই। নিজের বাড়ি বা দোকানে যেতে গেলেও লাগবে 'কিউআর কোড'। দেশবিদেশের যারা অলিম্পিক দেখতে এসেছেন, প্রকাশ্যেই অনেকে বলছেন, এরকম জানলে আসতাম না। টিভিতেই দেখে নেওয়া ঢের ভাল ছিল।