কলকাতা ও প্যারিসের ডার্বি
শেষ আপডেট: 5 May 2025 11:53
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা চেয়েছিল কলকাতাকে প্রাচ্যের লন্ডন বানাতে। কিন্তু কল্লোলিনী তিলোত্তমা লন্ডন নয়, ‘ছবির দেশ, কবিতার দেশ’ ফ্রান্সের সঙ্গে তার আত্মিক যোগ খুঁজে পায়। ভাষার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সুরস্পন্দন থেকে আঁভ-গার্দ শিল্পকলা—দুই শহরের সম্পর্ক, গ্রহণ-পরিগ্রহণ অবিচ্ছেদ্য। কল্লোল যুগের সাহিত্যিকেরা যে-পথ খুঁজতে চান, নবযুগের সাহিত্যের ভাব আর ভাষা কী হবে—এই নিয়ে অবিরত দ্বন্দ্ব আর বিতর্ক চলে, সেই প্রতর্কের অভিমুখ তৈরি করেছিল ফ্রান্স। আবার ফরাসি নবতরঙ্গ বা নিউ ওয়েভের ঢেউকে সেলুলয়েডের পর্দায় বেঁধেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন।
শুধুই সাহিত্য বা চলচ্চিত্র নয়। খেলার ময়দানেও দুই মুলুকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমান্তরালতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। হয়তো এরই নতুন মাত্রা উন্মোচিত হবে ফুটবলের সামনের মরশুমে। এ বছর ফরাসি ক্লাব ফুটবলের প্রথম ডিভিশন লিগ ওয়ানে প্রমোশন পেয়েছে প্যারিস এফসি (পিএফসি)। দীর্ঘদিন ধরে প্যারিসের ক্লাব হিসেবে ইউরোপের মঞ্চে অংশ নিত প্যারিস সঁ জরমঁ (পিএসজি)। এবার সেই সম্মানে ভাগ বসাতে হাজির দ্বিতীয় একটি দল। ঘরোয়া লিগেও বহু বছর বাদে মুখোমুখি হবে দুই টিম। ফ্রান্স দেখবে প্যারিস ডার্বি (পিএফসি বনাম পিএসজি)। আর হিসেব বলছে ভৌগলিকভাবে এই দ্বৈরথই হতে চলেছে ক্লাব ফুটবলের নিকটতম ডার্বি। কারণ, দুই স্টেডিয়ামের ব্যবধান মেরেকেটে ১৯৩ মিটার! পিএসজির পার্ক দে প্রাঁস এবং প্যারিস এফসির ঘরের মাঠের ঢিলছোড়া দূরত্বের কারণে একে ফুটবলের ‘নিকটতম লড়াই’ বলা হচ্ছে।
অথচ মজার বিষয়, এর পরেই যে নামটি চর্চায় উঠে আসছে, সেটা কলকাতা ডার্বি। প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান। ময়দানে দুই দলের নিজস্ব টেন্টের দূরত্ব মোটামুটি ৮০০ মিটার। কিন্তু শর্টকাটে ৫ মিনিটের মধ্যে দুই শিবিরে যাতায়াত সম্ভব।
ইদানীং, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বি নিরপেক্ষ ভেন্যু যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আয়োজিত হয় (ঠিক যেমন ইন্টার ও এসি মিলানের দ্বৈরথের মঞ্চ একটাই—সান সিরো স্টেডিয়াম)। এক লাখ দর্শক বসতে পারে যুবভারতীতে। যে কারণে মুনাফার কথা মাথায় রেখে একেই বেছে নেয় ময়দানের দুই প্রধান।
যদিও এক সময় যুবভারতী নয়, ইডেনে আয়োজিত হত কলকাতা ডার্বি। কিন্তু ইডেন ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ফুটবলের জন্য ততটা উপযুক্ত নয়। ফলে সেখান থেকে যুবভারতীতে সরে যায় ডার্বির ভেন্যু।
সময়ের সরণী বেয়ে আরেকটু পিছনে হাঁটলে দেখা যাবে, ইস্ট-মোহন লড়াই সত্তরের দশকে বহুবার দুই ক্লাবের নিজেদের মাঠে আয়োজিত হয়েছে। ফুটবল অনুরাগীদের অনেকের স্মৃতিতে এখনও সজীব ১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনাল। মোহনবাগান পাঁচ গোলে দুরমুশ করে ইস্টবেঙ্গলকে। সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ হয়েছিল মোহনবাগান মাঠে।
এই ট্রেন্ড চালু ছিল আশির দশক পর্যন্ত। নব্বইয়ের গোড়া থেকে প্রথমে ইডেন, তারপর যুবভারতীতে দ্বৈরথের মঞ্চ সরে যায়। তার আগে বিশেষ করে কলকাতা লিগের ডার্বির জন্য ঘরের মাঠই দুই শিবিরের ক্লাবকর্তাদের প্রথম পছন্দ ছিল।
সে সময় সূদুরপরাহত। আজ যুবভারতীর এক লক্ষ সিটের গ্যালারি কার্যত ফাঁকা পড়ে থাকে। প্যারিসের ডার্বি ‘নিকটতম দ্বৈরথে’র তকমা পাওয়ার পর কিঞ্চিৎ স্মৃতিমদির দুঃখবিলাসিতা ছাড়া কলকাতার ফুটবল-পাগল সমর্থকদের খুব একটা প্রাপ্তি আছে কি?