
ফুটবলের চলমান ইতিহাসে লিও মেসি একটি সভ্যতার নাম
দেবাশিস সেনগুপ্ত
যাকে নিয়ে এই লেখাটা, সেই লোকটাকে নিয়ে কবীর সুমনের বক্তব্য (‘চন্দ্রিলিয়ে ৩’ // ২৯শে জুন ২০১৫) ছিল এইরকম- “মেসির খেলার ধরন দেখে আমার সালামাত নাজাকাতের পাহাড়ি ঠুংরির গায়কী ও ব্যাপার স্যাপার মনে পড়ে যায় আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখি, আসলে শুনি। দেখি যত, শুনি তার চেয়ে বেশি। ওই তো একটা অমানুষিক সাপাট তান, টুকরো তান, বক্রি তান, ওই তো একটা অভূতপূর্ব কম্বিনেশন, আমার ভাবনারও আগে চলে গেল কোথা থেকে কোথায়। মেসির সকার-ভেল্কিতে আমি পাই সালামাত নাজাকাতের খ্যাপামি, আপনায় আপনি বিভোর থাকা, প্রতিপক্ষকে প্রেমিক বানিয়ে দেওয়ার দম আর কায়দা। মেসি যেভাবে পর পর প্রতিপক্ষ-খেলোয়াড়দের একবার এদিকে একবার ও-দিকে হেলিয়ে দেন, ফেলে দেন স্পর্শমাত্র না করে, সালামাত নাজাকাতের সরগম তেমন। সরগম চলছে সে-কী ঐশ্বরিক নির্লিপ্ততায়, যেন কিছুতেই কিছু যায় আসে না আবার আসে, জিততে হবে, জিতবই, জানি জিতবই, তবে এই ভেল্কিটাকে সত্যি করে তুলে জিতব।”
তা কী কী জিতেছিলেন আর জেতেননি এই লোকটা, এই জয়সর্বস্ব দুনিয়াতে? যারা তাকে ভালবাসে অথবা ভালবাসে না, কম বেশী সবাই জানে সেগুলো। আর্জেন্টিনার হয়ে কোনওদিন বিশ্বকাপ জেতেননি, জেতেননি কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়নশিপ টাইটেলও। দেশের হয়ে জিতেছেন অলিম্পিক সোনা (চীন, ২০০৮) আর অনূর্ধ্ব কুড়ি বিশ্বকাপ (২০০৫)।
তাঁর ক্লাব বার্সিলোনার হয়ে জিতেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ ৪ বার (২০০৫-০৬, ২০০৮-০৯, ২০১০-১১, ২০১৪-১৫), লা লিগা ১০ বার (২০০৪-০৫,২০০৫-০৬,২০০৮-০৯,২০০৯-১০,২০১০-১১,২০১২-১৩,২০১৪-১৫,২০১৫-১৬,২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯), কোপা দেল রে ৬ বার (২০০৮-০৯,২০১১-১২,২০১৪-১৫,২০১৫-১৬,২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮), সুপার কোপা ৮ বার (২০০৫,২০০৬,২০০৯,২০১০,২০১১,২০১৩,২০১৬ ও ২০১৮), উয়েফা সুপারকাপ ৩ বার (২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫), ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ৩ বার (২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫)।
লা লিগায় তাঁর করা গোলসংখ্যা ৪৪০টি। লা লিগাতে ৩৬টি ও ইউসিএল-য়ে ৮টি হ্যাটট্রিক আছে তাঁর। অ্যাসিস্ট সংখ্যা লা লিগাতে ১৭৭ আর কোপা আমেরিকাতে ১২টি। এর সবকটাই এখনও রেকর্ড। কেরিয়ার গোলসংখ্যা ৬৯৯টি, এখন পর্যন্ত।
৭ বছরে খেলা শুরু নিউওয়েল ওল্ড বয়েজ ক্লাবের যুব দলে। সেখানে খেলেছেন ১৩ বছর অবধি। ১৯৯৪-২০০০ ছিল নিউওয়েল ওল্ড বয়েজ ক্লাবের যুব দলে তাঁর সম্ভাবনা জাগানোর দিনগুলি। তারপরে স্পেনের বার্সিলোনায় যুব দলে খেলতে যাবার পিছনে যে অলৌকিক রূপকথা ছিল, তাতে পরে আসছি। ২০০১-২০০৪, এই চার বছর সেখানে খেলেন তিনি। তারপর ২০০৪-০৫এ সালে বার্সিলোনা বি ছুঁয়ে ২০০৫ থেকে সিনিয়র বার্সিলোনা টিমে। সেখানে ৪৭৯ ম্যাচে তার গোল সংখ্যা ৪৪০, এখনও অবধি। অনূর্ধ্ব কুড়ি (২০০৪-০৫) ও অনূর্ধ্ব তেইশ (২০০৮) আর্জেন্টিনার হয়ে তাঁর গোল ছিল ১৮ ম্যাচে ১৪ আর ৫ ম্যাচে ২, যথাক্রমে। সিনিয়ার আর্জেন্টিনার হয়ে ১৩৮টি ম্যাচ খেলে তাঁর করা গোলের সংখ্যা আজ পর্যন্ত ৭০টি। সাথে ছিল ৬টি ব্যালন ডিওর (২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫ আর ২০১৯), ৬বার গোল্ডেন বল (২০০৯, ২০১১ ও ২০১৪) আর ৬বার গোল্ডেন বুট (২০০৯-১০, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯)।
এবার একটু পরিসংখ্যানের বাইরে ঘুরে আসব, কেন না কমবেশী সবাই জানে এগুলো।
কাট টু রোজারিও মার্চ ২০০০।
এবারে আসছি নিউওয়েল ওল্ড বয়েজ ক্লাবের যুব দল থেকে বার্সিলোনায় যুব দলে খেলতে যাবার পিছনের অলৌকিক রূপকথায়। ঘন ঘন জ্বরে ধুঁকত তখন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মানো ছোট্ট লোকটা। কিছু খাবার মত অবস্থাও ছিল না তার তখন। তবু রোজ বিকেল হলেই সে দেখাত তার বাঁপায়ের ফুটবল জাদু। বাবা জর্জ মেসি রোজারিওর স্টিল কারখানার শ্রমিক হলেও দু’বেলাই পেট ভরার মতো খাবার জোটাতে পারতেন তার ফুটবলে আসক্ত ছেলের জন্য। তবু বাড়ছিল না সেই ছেলে, তারই বয়সী অন্যদের মতন। ডাক্তার দেখানো হলে তিনি বললেন, রোগটার নাম “গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি”, যে জন্য এটা হচ্ছে। সেরে ওঠার নিদানও দিলেন সেই ডাক্তারবাবু। কিন্তু বিশাল খরচ হবে সেজন্য। মাথায় হাত বাবা জর্জের। যে ক্লাবের হয়ে সে ছেলে ফুটবল খেলত, যে ক্লাবের হয়ে তার পায়ের জাদু দেখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত দর্শকরা, সেই ক্লাব নিউওয়েল ওল্ড বয়েজও কঠিন রোগে আক্রান্ত ছেলের বাবাকে ফিরিয়ে দিল আর জানিয়ে দিল, ওর চিকিৎসার ভার নেওয়া সম্ভব তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
২০০০ সালের মার্চ মাসে এক তুমুল বৃষ্টি-বিকেলে রোজারিও শহরে চলছিল ছোটদের ফুটবল। ১৯ নম্বর জার্সি পরা একটা ১৩ বছর ফুল ফোটাচ্ছিল মাঠে। আর তখনই বার্সিলোনা অ্যাকাডেমির হয়ে খুদে ফুটবলার বাছতে আর্জেন্টিনা সফরে ছিলেন প্রাক্তন বার্সা তারকা জোয়ান ক্রুয়েফের প্রাণের বন্ধু কার্লেস রেক্সাস। মাঠের ধারে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে রেক্সাস দেখছিলেন ছেলেটার কান্ডকারখানা। ছেলেটা বাঁ পায়ের গোড়ালি দিয়ে নিজের ডান পায়ের বুটের ডগায় বল মেরে তুলে দিচ্ছে প্রতিপক্ষের মাথার উপর দিয়ে। তারপর ওই বলটাই রিসিভ করে বাঁ পায়ের ইনসুইং-এ সেকেন্ড পোস্টের কোণা দিয়ে জালে জড়িয়ে দিচ্ছে। উত্তেজনাহীন নির্লিপ্ত মুখে সে এগুলি করে যাচ্ছিল, যেন ওটাই তার একমাত্র কাজ এ দুনিয়াতে। এরই ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সে হাঁফ ছাড়ছিল মাঠের মধ্যে। না পারলেও খেলছিল সে। আর সেই ছেলেটা “খেলছে” এবং “খেলতে পারবে না” এই দোদুল্যমানতার সীমান্তরেখায় মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে চোখের জলে চোখ ভেসে যাচ্ছিল তার বাবা জর্জের। রেক্সাস কথা বললেন ক্লাবকর্তাদের সঙ্গে, সাথে ওই ক্রন্দনরত জর্জ মেসির সঙ্গেও। ক্লাবকর্তারা জানালেন ছেলেটির শরীরে বাসা বাঁধা রোগের কথা। জর্জ জানান তার অসহায়তার কথা। সব শুনে রেক্সাস জানিয়ে দেন তাঁর ছেলের সব দায়িত্ব রেক্সাসের। শুধু ভরসা করে ছেলেটাকে বার্সিলোনায় পাঠাতে হবে তাঁর সঙ্গে। বার্সিলোনা অ্যাকাডেমিতে তাকে তুলে আনার জন্য তার অন্য সমস্ত কর্মসূচী বাতিল করেন রেক্সাস। টানা তিন দিন আলোচনা চলে ওই ফুটবলের জাদু দেখানো ছেলের পরিবারের সঙ্গে। বাবা-মার প্রাথমিক আপত্তি পেরিয়ে তাকে নিয়ে যাবার অনুমতি পাওয়া গেল। যখন সব আলোচনা শেষ, তখন হাতের কাছে কাগজ ছিল না। একটা টিস্যু পেপারে চুক্তি লেখেন রেক্সাস। তারপরে ছেলেটার বার্সিলোনা অ্যাকাডেমিতে যাত্রা আর তারপরে ইতিহাসের একটা বিরাট অধ্যায়ের শুরু। সেদিনের সেই ছেলেটা, আর তারপর হয়ে ওঠা আজকের এই লোকটা জানে যে ওই বৃষ্টিবিকেলে রোজারিওতে কার্লেস রেক্সাস না থাকলে, ওখানেই থমকে যেত তার জীবন, “বাড়ছিল না থেকে বার্সিলোনা” পৌঁছনো আর হত না। দুনিয়া ওলটপালট করে দেওয়া অসামান্য ফুটবলার হওয়ার পরেও সেদিনের মত আজও কিন্তু তিন সন্তানের পিতা ওই লোকটা একইরকম উত্তেজনাহীন আর নির্লিপ্ত, ছিটেফোঁটা ঔদ্ধত্যও তাঁকে ছুঁতে পারেনি আজও। পরিবারমুখীনতা এবং বাড়িতে দেওয়ালে টাঙ্গানো আদর্শ ক্রীড়াবিদ মহম্মদ আলির পোস্টার আজও তাঁকে শক্তি যোগায়। সে পোস্টারে মাখানো আছে তার ফেভারিট কোট “Fly like a butterfly, Sting like a bee.”
কাট টু মস্কো বিশ্বকাপ ২০১৮।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনওমতে কোয়ালিফাই করাজনিত বিশ্বব্যাপী অনন্ত সমর্থকের চাপ, দেশ ও দলের কাপ প্রত্যাশার চাপ, হিগুয়াইনের পাশে খেলার চাপ, পেলে-মারাদোনার “আদরের” চাপ, নিজের কাছে নিজের সঙ্গত কারণে চাপ এবং সর্বোপরি ম্যাচের আগের রাতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর অসাধারণ পারফরম্যান্স জনিত সৃষ্টি হওয়া অনভিপ্রেত চাপ, এসব সামলে ১৬ই জুন ২০১৮ তারিখে লোকটার দেশের প্রথম খেলা ছিল আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে, সন্ধে সাড়ে ছ’টায়, মস্কোর স্পার্টাক স্টেডিয়ামে। এবং চাপ খেয়ে নিয়েছিল লোকটাকে। দশটা গোলে নেওয়া শটের একটাও গোল না হওয়া, বারবার অনেকে মিলে কড়া মার্কিংয়ে আটকে যাওয়া, গোলের জন্য দরজা খুলতে না পারা এবং শেষে ওই পেনাল্টি মিস। ভাল শট, গোলে ছিল, দারুণ বাঁচালেন গোলকিপার হ্যাল্ডরসন, এগুলো তখন আর কেউ শুনল না। ১-১ ড্র হয়ে গেল ম্যাচটা। বিদ্বেষীদের কারও কারও মতে, লোকটারই জন্যে। লোকটা জানতেন, এই সেই সময়। যখন দেওয়ালে পিঠ। যখন মাথাটা নিচু। যখন ঘুরে দাঁড়াতে হয়। যখন মাথাটা তুলতে হয়। আগে হয়েছিল। কিন্ত সাময়িক ফিরে আসা পৌঁছে দিল কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি। লোকটার মনটাকে আরও একবার রক্তাক্ত করে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে গেল আর্জেন্টিনা। দেশের সিনিয়ার জার্সি গায়ে অলিম্পিক সোনা ছাড়া ট্রফি নেই। কান্না চোখ ধুয়ে দিয়েছিল অঝোরে। তার আগে ২০১৪-র বিশ্বকাপ ফাইনালে হার, পরপর দুটো কোপায় চিলির কাপ নিয়ে যাওয়া, দেখে দেখে ঘাসে মুখ লুকিয়েছে লিও। অবসর ঘোষণা করেও ফিরে এসেছেন জার্সির টানে। ২০১০-এ স্পেন চেয়েছিল সে দেশের নাগরিত্ব নিয়ে মাঠে নামুক লোকটা। সে রাজি হয়নি। সেটা করলে বিশ্বকাপ হাতে ওঠা অধরা থাকত না। কেননা, ওই বছরই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্পেন।
কাট টু মস্কো বিশ্বকাপ ২০১৮-এর আগে।
২০১৮ সালে আর্জেন্টিনার প্রাক প্রি-বিশ্বকাপ অনুশীলনের সময়ে উরুগুয়েতে তোলা একটা ছবির কথা মনে পড়ছে। সিকিউরিটি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই লোকটার টিমের অনুশীলন দেখতে আসা একটা বাচ্চাকে। বাচ্চাটি কাঁদছে দু’চোখ ভরে। তাকিয়ে দেখছেন বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার সেই লোকটা, একাগ্র আর স্থির দু’টো চোখ দিয়ে, যন্ত্রণার অভিব্যক্তিতে। হয়তো তাঁর মনে পড়ছিল ২০০০য়ের সেই দিনগুলি। ছবিটা একবার দেখেই মুহূর্তে আমি ফ্ল্যাশব্যাকে। ১৩ পেরিয়ে ১৪য় ঢলে পড়া জুলাই ২০১৪র সেই ভেজা ভেজা অবসন্ন, বিধ্বস্ত আর সবহারা মাঝরাতে। বাচ্চাটা যেন বিশ্বকাপটা। যন্ত্রণাক্লিষ্ট লোকটা ঠিক এভাবেই দেখছিলেন সে দিন কাপটার দিকে।
যেভাবে বিশ্বাস হারানো মানুষ দেখে এই দুনিয়াটাকে।
যেভাবে দেশে ফেরা পরিযায়ী পাখি পাশ ফিরে দেখে তার বিগত কয়েকমাসের বাসস্থানকে।
যেভাবে একমাত্র সন্তানহারা বাবা শ্মশানে দাঁড়িয়ে ঝাপসা চোখে পারিপার্শ্বিক দেখে নেয়।
যেভাবে চোখের জলে স্বপ্নের চারাগাছে রোজ সার দেওয়া অসহায় কিশোর অবিশ্বাসী চোখে দেখতে পায় রাজনৈতিক আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া বাবা মাকে।
যেভাবে অসহায় চোখে অবসরোত্তর বৃদ্ধ কর্মখালির পাতা দেখে যান স্নাতকোত্তর অটোচালক পুত্রের জন্য।
যেভাবে কৈশোরের সব স্বপ্ন নিলামে তুলে দেওয়া যুবক আজকের রাজনীতির পাড়া নিয়ন্ত্রণ করতে করতেও লোলুপ চোখে দেখে একদা সহপাঠীর টিউটোরিয়াল ক্লাস চালানো।
যেভাবে অসহায় মানুষ দেখে যুযুধান রাজনৈতিক দালালদের বোমাবাজির রোজনামচা।
যেভাবে কোটি কোটি বড় টিমের সমর্থক অসহায় চাউনিতে দেখতে থাকেন কর্পোরেটের ক্ষমতার কাছে ফুটবল নিয়ামকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আত্মসমর্পণ।
যেভাবে নির্বাক চোখে ব্যালটবাক্স লুট হয়ে যেতে দেখেন বিরোধী প্রার্থী।
অথবা যেভাবে নাছোড়বান্দা প্রেমিক শেষবারের জন্য ছেড়ে যেতে চাওয়া প্রেমিকার দু’চোখে রাখে তার নীরব চোখ দু’টো।
কাট টু ইউসিএল ৯ই মার্চ ২০১৭।
“মাঠে কিচ্ছু করে না। মাঠে কিচ্ছু পারে না। শরীর দেয় না আজকাল। ঘেঁটে আছে কেস-ফেস আর দলবদল নিয়ে” ইত্যাদি, প্রভৃতি, শুনতে শুনতে লোকটার শরীর গুলিয়ে উঠছিল। ইউসিএল সেমিফাইনালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে ১ম লেগে পিএসজি-র কাছে বার্সিলোনা ০-৪ (ডি মারিয়া – ২, ড্রাক্সলার, কাভানি) হারার পরে এটা চরমে ওঠে। ৯ই মার্চ ২০১৭ নিজেদের মাঠে ২য় লেগ সেমিফাইনালে সুযোগ এল সব হিসেব মিটিয়ে দেবার। ৬-১ জিতে তা মিটিয়েও দিল তারা। লোকটার পেনাল্টি গোল ছাড়াও সুয়ারেজ, লেভিন, রবার্তো আর নেইমারের ২ গোল ছিল সেদিন। জবাবটা এভাবেই দিত লোকটা। সেইসব দিনে। বার্সিলোনা যদি ইতিহাস হয়, ওই লোকটা তাহলে ওই ইতিহাসের একটা সভ্যতার নাম।
কাট টু যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, ২রা সেপ্টেম্বর ২০১১।
কলকাতায় যুবভারতীতে লোকটা। সাড়ে ৮ বছর হল। যেন এই সেদিন। টিকিট ছিল না আমার। ম্যাচের দিন সকালেও। নিজে দেখতে না গিয়ে অনলাইনে কাটা টিকিট ম্যাচের দিন দুপুরে দিয়েছিল আমার ক্যামাক স্ট্রীট শাখার সহকর্মী শ্যামশঙ্কর। আপ্রাণ ফুটবলপ্রেমী, সুভদ্র শ্যামশঙ্কর। সব মিলিয়ে সল্টলেকের যুবভারতী স্টেডিয়ামে জীবনের সেরা ফুটবল দর্শন সেদিনই।
লোকটার এসব কিছুই সেদিন দেখেছিল যুবভারতী। স্কিলের এই বিচ্ছুরণ, বিস্ফোরণ তার আগে হয়তো কোনও দিন দেখেনি কলকাতা। ম্যাচ শেষ হওয়ার আধঘণ্টা পরেও গ্যালারি টপকে শূন্য মাঠে ঢুকে কেউ কেউ ছুঁয়ে দেখছিলেন লোকটার ছুঁয়ে যাওয়া যুবভারতীর ঘাস। ৯০ মিনিট চোখের সামনে মাঠে আমার ফুটবল দেবতাকে দেখে নিয়েছিলাম সেদিন। সাড়ে ৮ বছর পরেও ঘোর কাটেনি আজও। কাটবে না আর কোনদিনও। একটা পাস নিয়ে তৃতীয় পাসের কথা ভেবে ফাঁকা জায়গায় চলে যাওয়া, দু’তিন জনের পাশ দিয়ে অনায়াস চোখধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে বেরিয়ে যাওয়া, হঠাৎ অবিশ্বাস্য গতি বাড়ানো, সেই গতির উপরেই কম্পাস মাপা জ্যামিতিক সেন্টার করা, আর অনাবিল ফাঁকা জায়গা নেওয়া ও তার সদ্ব্যবহার, লোকটার এসব কিছুই দেখেছিলাম সেদিনের যুবভারতীতে। না, সেদিন গোল পাননি ফুটবলের বরপুত্র। একজীবনে সবকিছু হয় না। একজীবনে এমন কিছু হয়, যাতে বাকী জীবনে আর কিছু না হলেও চলে। আমার হয়েছিল ২ সেপ্টেম্বর ২০১১তে।
কাট টু এলোমেলো ভাবনা।
ফুটবলের একটা মায়াকাজল থাকে। সেটা পরিয়ে দেবার লোকটাই হয়তো ফুটবল থেকে চলে যাবে এরপরে কোনওদিন। কোনওদিন বাজে না বকা যে লোকটা অন্যায় আক্রমণ ‘খেয়ে’ গেছে সারাজীবন। মারকুটে ডিফেন্ডার থেকে ঈর্ষাকাতর মহাখেলোয়াড়দের কাছে।
কাট টু ২৪শে জুন ২০২০।
লোকটার মত “গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি” এবং তাকে দশগোল দিয়ে জেতার এলেম আমার কখনও ছিল না।
লোকটার মত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার কোনওদিন ছিল না।
লোকটার মত ফুটবল প্যাশন আমার কস্মিনকালেও ছিল না।
লোকটার মত ফুটবলের প্রতি মাদকতা আমার কোথাও ছিল না।
লোকটার মত মাঠে নেমে ফুটবল খেলার ক্ষমতা আমার কোনওখানে ছিল না।
লোকটার মত দুনিয়াজোড়া ফুটবলধর্মের উপাসক হয়ে কোটি কোটি হৃদয় জেতার প্রাপ্তি আমার স্বপ্নেও ছিল না।
লোকটার মত লোকজনকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে আনন্দে রাখার সামর্থ্য আমার কক্ষণো ছিল না।
লোকটার মত বিদ্বেষের স্বীকার হয়ে বেঁচে থাকার মাধুর্য আমার কোনও অবস্থায় ছিল না।
তবু…..
লোকটা একটা ফ্রিকিকে সবাইকে টপকে জালে বল জড়িয়ে দিলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা একটা ডজে তিন চারজনকে মাটি ধরিয়ে দিলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা একটা ভয়ঙ্কর সোলো রানে বিপক্ষকে চিরে দিলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা একটা চেস্ট ট্র্যাপে বলটাকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা একটা গোল দেবার পরে দু’হাত তুলে আকাশে তাকিয়ে একটা ঐশ্বরিক হাসি হাসলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা একটা স্বপ্নের অ্যাসিস্টে গোল করিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা আনন্দ পেলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
লোকটা আক্রান্ত হলে আমিই ওই লোকটা হয়ে যাই।
আজ লোকটার জন্মদিন। আজ লোকটা ৩৪এ পা রাখলেন।
শুভ জন্মদিন লোকটা।