Latest News

জেদ রেখে চালিয়ে খেলে যাও হরমনপ্রীত

দেবার্ক ভট্টাচার্য্য 

সালটা ১৯৭৩। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। মহেন্দ্র কুমার শর্মার পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হলো ভারতের মহিলা ক্রিকেটের পথ চলা। তৈরি হলো ‘ভারতের মহিলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’। প্রেসিডেন্ট বেগম হামিদা হাবিবুল্লাহ। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বছরের ইতিহাস কোনও কাহিনীর থেকে আলাদা নয়। যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এক একটা লড়াই, প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার গল্প।

আরও পড়ুন প্লেনে ক্ষিধের চোটে কাঁদছে শিশু, স্তন্যপান করিয়ে থামালেন বিমানসেবিকা

মহিলা ক্রিকেট শুরু হলেও অনেকেই জানতেন না, কারা খেলেন সেখানে। আন্তর্জাতিক মানের কোনও স্টেডিয়ামে খেলা হতো না। খেলার খবরই পেতেন না কেউ। ৮০’র দশকের শেষ দিকে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটে এলেন চারমূর্তি। ডায়ানা এডুলজি, শান্তা রঙ্গস্বামী, সুধা শাহ, সন্ধ্যা আগরওয়াল। বদলাতে থাকল ক্রিকেটের চেহারা। ধীরে ধীরে আম জনতার বাড়িতেও ঢুকতে শুরু করল মহিলা ক্রিকেট।

এদের দেখেই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের মঞ্চে পদার্পন অঞ্জুম চোপড়া, মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামীর। রাজস্থানের জোধপুরের বায়ুসেনা অফিসারের মেয়ে মিতালি পড়ার পাশাপাশি ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলত। এই খেলার আগ্রহেই মাত্র ১৭ বছর বয়সে ভারতীয় দলে সুযোগ মেলে। তারপর থেকে বাকিটা ইতিহাস। ২০০৩ সালে ভারতের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় মিতালিকে। ২০০৫ সালে তাঁরই অধিনায়কত্বে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। কিন্তু ট্রফি মেলেনি। ২০১৭ সালেও তাঁরই নেতৃত্বে দ্বিতীয় বারের জন্য বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও ফের হারের মুখ দেখতে হয়। টেস্ট, ওয়ান ডে ও টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই সবথেকে বেশি রানের মালিক মিতালি। আর তাই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের ‘তেণ্ডুলকর’ বলা হয় মিতালিকে। পেয়েছেন অর্জুন, পদ্মশ্রী পুরষ্কার।

 

ফুটবল, ভলিবল পছন্দ করা চাকদহের বাবুলে’র ক্রিকেটে আসার অবশ্য একটা গল্প আছে। ১৯৯২ সালে টিভিতে বিশ্বকাপ জেতার পর অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বেলিন্দা ক্লার্কের ‘ভিকট্রি ল্যাপ’ দেখেই ঠিক করে নিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলবেন। দাদারা ব্যাট দিত না। তাই বল হাতে তুলে নেওয়া। ভাগ্যিস! না হলে বিশ্বের দ্রুততম মহিলা বোলারকে হয়তো পেত না মহিলা ক্রিকেট। কলকাতায় এসে বিবেকানন্দ পার্কে খেলতে খেলতেই নজরে পড়া। বেঙ্গল রঞ্জি দলের প্র্যাকটিসে বল করতেন। ২০০২ সালে সুযোগ ভারতীয় দলে। বিশ্ব মহিলা ক্রিকেট পেল ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’ ঝুলন গোস্বামীকে। মিতালির পর ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব সামলেছেন। অর্জুন ও পদ্মশ্রী পুরষ্কার পাওয়া ঝুলন ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান ক্যাথরিন ফিজপ্যাট্রিকের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। তিনিই একমাত্র বোলার যিনি ওয়ান ড’তে ২০০’র উপর উইকেট নিয়েছেন।

২০০৫ সালে যখন ভারতের মহিলা দলে অঞ্জুম চোপড়া, মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামীরা দাপিয়ে খেলছেন তখন পাঞ্জাবের মোগা’তে স্বপ্ন দেখছেন হরমনপ্রীত সিং ভুল্লার। স্বপ্ন ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার, ভারতের জার্সি পরে খেলার। সুযোগ মিলল ২০০৯ সালে। বীরেন্দ্র সেহওয়াগের ভক্ত হরমনপ্রীত প্রথম থেকেই বড় শট খেলতে পারতেন। তাঁর বড় শট খেলার সহজাত ক্ষমতাই তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল দলে।

তবে দলে প্রতিষ্ঠা পেতে কিছুটা সময় লাগে তাঁর। কারণ বড় শট খেলতে পারলেও ধৈর্য্য একদমই ছিল না। এখানেই তাঁর জীবনে মিতালি রাজের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিতালির’র সম্বন্ধে যাঁরা একটু আধটু খবর রাখেন, তাঁরা জানেন খেলার বাইরে সারাক্ষণ বই পড়েন মিতালি। নিজেকে শান্ত রাখার এক প্রক্রিয়া। এই শান্ত থাকাটাই বড় দিদির মতো শিখিয়েছেন হরমনপ্রীতকে। আর যত পরিণত হয়েছেন, তত ভয়ঙ্কর হয়েছেন পাঞ্জাবের এই মহিলা ক্রিকেটার।

২০১২ সালে মেয়েদের টি টোয়েন্টি এশিয়া কাপের ফাইনালের আগে মিতালি ও ঝুলন চোট পেয়ে গেলে হরমনপ্রীতকে অধিনায়ক করা হয়। প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানকে ৮১ রানে হারিয়ে নিজের নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটান হরমনপ্রীত। ২০১৭ সালের মহিলা বিশ্বকাপেই নিজের নামকে ভারতের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন হরমনপ্রীত। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১১৫ বলে ১৭১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। তার মধ্যে ১০০ রানের পর থেকে বাকিটা পুরোটাই হ্যামস্ট্রিং চোট সঙ্গে নিয়ে। কার্যত একার ক্ষমতায় ভারতকে ফাইনালে তুলেছিলেন হরমনপ্রীত। ফাইনালে একটুর জন্য পারেননি ভারতকে জেতাতে।

বিশ্বকাপের পরেই হরমনপ্রীতের হাতে অধিনায়কত্ব তুলে দেন মিতালি। অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম বড় টুর্নামেন্টই হল টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। যার প্রথম ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৫১ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেললেন তিনি। এটাই কোনও ভারতীয়র টি টোয়েন্টিতে করা প্রথম সেঞ্চুরি। শুধু খেললেন না ৮ টি ছয় মেরে রীতিমতো ছেলেখেলা করলেন নিউজিল্যান্ডের বোলিংকে। তিনিই একমাত্র ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার যিনি মহিলাদের বিগ ব্যাশ লিগে খেলেছেন। সিডনি থান্ডার্সের হয়ে সেখানেও ব্যাট-বল হাতে সফল হরমনপ্রীত। পাঞ্জাব সরকারের তরফে চণ্ডীগড়ের সাম্মানিক ডিএসপি’র পদও দেওয়া হয়েছে হরমনপ্রীতকে।

ডায়ানা এডুলজি থেকে হরমনপ্রীত সিং। এই দীর্ঘ যাত্রায় ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল। আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে খেলার সুযোগ মিলেছে। এসেছে স্পনসর। আগে দুরদর্শনে কোনও কোনও ম্যাচ দেখানো হতো। সেই যায়গায় আজ স্টার স্পোর্টসের মতো চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে খেলা। বিসিসিআইয়ের পুরষ্কার বিতরণ মঞ্চে বিরাটদের পাশেই জায়গা হচ্ছে মিতালিদের। এমনকী ভারতের নতুন জার্সি উদ্বোধনেও ছেলেদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে হরমনপ্রীতদের।

আর এখানেই ভারতের মহিলা ক্রিকেটের জয়। আজ যেমন ব্যাট হাতে মাঠে যাওয়া প্রতিটা ছেলে স্বপ্ন দেখে বিরাটের মতো খেলোয়াড় হওয়ার, তেমনই ক্রিকেট মাঠে যাওয়া প্রতিটা মেয়ে স্বপ্ন দেখে মিতালি, ঝুলন, হরমনপ্রীতদের মতো হওয়ার। আজ তাঁরা প্রতিটা ঘরের রোল মডেল। শচীন, ধোনি, আজহারের পাশাপাশি তাই কথা হয় মিতালি, ঝুলনের বায়োপিক হওয়ারও। ভারতের সাফল্যের ব্যাটন আজ হরমনপ্রীত, স্মৃতি মান্ধানাদের হাতে। সেই ব্যাটন নিয়ে বোল্টের গতিতে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। আর তাঁদের এই পথচলাকে সাহস যোগাচ্ছে সেই সব পরিশ্রম, কষ্ট, প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার অদম্য জেদ।

The Wall-এর ফেসবুক পেজ লাইক করতে ক্লিক করুন 

You might also like