Latest News

কাঁচা খেউড়ের বদলে এখন চ্যান্ট হয়, গ্যালারি কালচার বদলেছি অনেক প্রতিঘাত পেরিয়েই

ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাস

প্রথম জার্সি টিফো থেকে বি.এফ.সি-র বিরুদ্ধে থ্রি ডি টিফো, মেগা কোর্টেও থেকে ৭হাজার ২০০ স্কোয়ার ফুটের বাঙালদের জীবন কাহিনী।  একটি তথাকথিত ময়দানি গ্যালারিকে বদলে ফেলার রাস্তাটা সহজ ছিল না।

সালটা ২০১৩ কম বয়সী কিছু স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সঙ্গে কিছু ইস্টবেঙ্গল পাগল চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ী—তথাকথিত ময়দানি ভাবধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। স্বাভাবিক ব্যাপার বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল তাঁদের। লোকজনকে বোঝাতে হতো, তারা কী চাইছে। কিছু বুঝছিলো আবার কিছু সমর্থকদের বক্তব্য “ওসব করে কিস্যু হবে না। এটা কলকাতা ময়দান। চুপচাপ বসে পড়।” কিন্তু ওই অভিনব ভাবনাকে বেশিদিন চেপে রাখা যায়নি। এগোতে থাকল দিন, আর বাড়তে থাকল সংখ্যা। ৪,৫,১০………

বিশ্বাস ছিল খুব তাড়াতাড়ি সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়াবেই। একটা ছেলে একটা ‘বাঙাল’ লেখা পতাকা রোজ মাঠে নিয়ে যাওয়া শুরু করল।  রোজ উড়ল ওই পতাকা। কখনও ইস্টবেঙ্গল মাঠ, কখনও বারাসত স্টেডিয়াম, কখনও কল্যাণী কিংবা সল্টলেক। প্রতিটি ম্যাচে। কিন্তু মাঝে মাঝে উড়ে এলো ময়দানি কাঁচা শুদ্ধ ভাষা। কুছ পরোয়া নেই!  ওই পতাকা দেখেই আসতে শুরু করল নতুন প্রজন্ম। শুরু হলো বাঙাল গ্যালারির নবজাগরণ।

সেদিনই হয়ত লেখা হয়ে গিয়েছিল আমাদের ক্লাবের মতো, আমাদের লাল-হলুদ রংটার মতো, ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাসও একদিন ভারতীয় ফুটবলে রাজ করবে। শুরু হলো সবাইকে কাজে নিযুক্ত করা। বলে রাখা ভাল, আমাদের নির্দিষ্ট কোনো বাঁধাধরা কাজ নেই। যার যেটা ভালো লাগে, সে সেটাই করতে পারে।

শুরু হলো চ্যান্ট বাঁধা। এক বাড়ির ছাদে বাঁধা হলো চ্যান্ট।  “আমরা করবো শৃঙ্গজয়” সম্বল একটা ছোট্ট ড্রাম। রোজ রোজ ছোট ছোট চ্যান্ট গ্যালারি মাতাতে লাগলো। কিছুদিন যেতেই ঠিক হলো এবার বড়ো কিছু করতে হবে। এলো বাঙালির আবেগের ডার্বি। গোলপোস্টের পিছন থেকে নেমে আসছে বিশাল একটা জার্সি। লোকজন তখনও বোঝেনি ওটাকে আসলে কী বলে। ভারতীয় ফুটবল দেখলো প্রথম জার্সি টিফো। প্রত্যাশা বাড়ল সমর্থকদের মধ্যে, দু’দিন আগেও যাঁরা তিরস্কার করছিলেন, তাঁরাই মন খুলে প্রশংসা করছে। আমরাও ভেবে নিলাম, এ তো সবে শুরু। আরও শক্তিশালী কিছু আনব। আনবই।

আবারও একদিন কলকাতা লিগের ম্যাচ। কিন্তু এবার কল্যাণীতে। গ্যালেরির দু-দিকে লাল ও হলুদ ছোট ছোট কাগজ দেওয়া হলো। তৈরি হলো মোসাইক। মাঝখান থেকে উঠলো থ্রিডি টিফো। আবারও ভারতে প্রথম। ভোর সাড়ে পাঁচটা হোক বা রাত সাড়ে ন’টা। চেষ্টার কসুর করছে না ইস্ট বেঙ্গল আল্ট্রাস। কী করে গ্যালারিকে আরও সুন্দর করা যায়। আরও সাজিয়ে তোলা যায়। দিনরাত চলছে নিরলস পরিশ্রম। বারাসতে মোসাইক সঙ্গে স্মোক এবং ম্যাচের আগে ও পরে কোর্টেও। এবার শুধু ঘরেই নয় বাইরেও উড়বে স্মোক। খুলবে টিফো। শিলিগুড়ি ডার্বি দেখতে যাওয়া হবে এবং ওখানেও খুলবে টিফো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। টিফো খুলল কাঞ্চজঙ্ঘার কোলেও। আমরা জিতলাম। এরপর বেশ কিছুটা সময় কোর্টেও আর মোসাইকে কাটছিল।

 

২০১৭ সালের আইলিগের প্রথম ম্যাচ ঠিক হলো ছোট ছোট ১৮০ টা ফ্ল্যাগ সমর্থকদের হাতে দেওয়া হবে এবং থাকবে জায়ান্ট ফ্ল্যাগ। খেলোয়াড়রা মাঠে নামতেই সব উড়লো একসঙ্গে। ঝলমলে রোদ্দুরে চিক চিক করে উঠল চারিদিক। ম্যাচের পর ভিআইপি গলারিতে বসা এক সমর্থকের কথায়, “কিছু বলার নেই। ছবি কথা বলছে।” তবে সমর্থকদের জন্য চমক অপেক্ষা করছিলো ২২ জানুয়ারি ২০১৭-র জন্য। অনেক সমর্থকের মতে ওই দিন মাঠে থাকা খেলোয়াড়দের সাথে কেউ যদি শক্তিশালী বেঙ্গালুরু এফসি-কে হারানোর পিছনে ভূমিকা রাখে, সেটা ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাস। এবং অবশ্যই বাকি সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে। স্মোক শো সঙ্গে থ্রিডি টিফো। স্মোকের ঘনত্ব এতটাই বেশি ছিল যে রেফারি খেলাটা শুরু করতে গিয়েও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের বলার দরকার নেই সেদিন মাঠে থাকা প্রতিটি দর্শক বলেছিল, আমরা কী করেছি। গোলপোস্টের পিছনে যারা ছিল, তারা আজ ৩ বছর পরেও হ্যাংওভার কাটাতে পারেনি। চারিদিকে আলোড়ন পড়ে গেল। প্রশংসা কুড়োলাম আমরা। এ বার শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা।

বারাসতে এবং অন্যান্য জায়গাতেও গ্যালারি বদলে গেল। গোলপোস্টের পিছন হলো আমাদের পার্মানেন্ট গ্যালারি। দিন যেতে থাকল, কর্মকাণ্ডে খুশি হয়ে বাড়তে লাগল বাকি গ্যালারির চাহিদা। কিছুদিন আগেও যারা কটূক্তি করছিল, তারাই বলতে শুরু করল “দাদা আমি তোমাদের জয়েন করতে চাই।” এখানে কিছু ভারতীয় ও বিদেশি মিডিয়া শুরু করল আমাদের নিয়ে ফিচার করা। উল্লেখযোগ্য ‘কোপা ৯০’ এশিয়ার সেরা ৫ টা আল্ট্রাস মুভমেন্টের মধ্যে রাখলো আমাদের। গ্যালেরিকে সাজাতে মাঝে বার কয়েক এসে গেছে স্কার্ফ। ভাবনা চিন্তায় শুরু থেকেই ছিল, যত বেশি সম্ভব সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে এই কালচার। যদিও বিদেশি এই কালচার ভারতীয় ফুটবলে একদম নতুন আয়ত্ত করতে কিছু সময় লাগবেই। এ বার শুধু নিজেদের গ্যালারি নয়, আল্ট্রাস কালচার ছড়াতে লাগলো পড়শী গ্যালারি থেকে ভিন রাজ্যে। যদিও বিশেষ সুবিধা করতে পারলনা কেউ। কয়েকজনের চেষ্টা মাঝে মাঝে ঠিকরে বেরোলেও কিন্তু সেটা ক্ষণিকের।

কিছুদিন পরে সমর্থকদের দাবি ছিল, নিজেদের ঘরের মাঠে কিছু করে দেখানোর। শুরু হল পরিকল্পনা। আসতে শুরু করল অর্থ সাহায্য। ২০১৭-র কলকাতা লিগের প্রথম ম্যাচ রেইনবো এফসির বিরুদ্ধে। লাল-হলুদ স্মোক ও পতাকায় ঢেকে গেল গোটা গ্যালারি। সমর্থকদের আমাদের ভালো লাগছে। এই আভাসটা আগের মরসুম থেকেই ছিল। কিন্তু সে দিন কিছুটা অবাক করেই গোটা গ্যালারি একসাথে গর্জে উঠল। গোটা কলকাতা লিগ জুড়ে চলল কর্মযজ্ঞ। বৃষ্টিকে একপ্রকার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিয়ারলেস ম্যাচের দিন ম্যাচের আগে চলল মেগা কোর্টেও শহিদ মিনার থেকে আমাদের ক্লাব পর্যন্ত মিছিল। ১০০ জনের উপরে পা মেলালেন সেদিন। মাঝে বৃষ্টি পড়ুক বা চড়া রোদ্দুর- বাঙাল গ্যালারি দুলছে, গাইছে। এমনকী ছোটদের ডার্বি ম্যাচে মোহনবাগান তাঁবুতেও। এই বছরই খালিদ জামিলের দলের প্রথম ম্যাচ। গ্যালারি আবার তেতে উঠবেই। দিন সাতেকের মধ্যে তৈরি হওয়া টিফো এ বার একটু অন্য ধাঁচে। এক একটা লাল-হলুদ কাপড়ে এক একটা খেলোয়াড়ের নাম লেখা। খেলোয়াড়রা মাঠে নামতেই যুবভারতীর তিন তলা থেকে একসঙ্গে খুলল সবকটা। কিছু পরে এক ভদ্রলোক বললেন “ওগুলো খুলছো কোন? ওগুলো তো ভালই লাগছে!” গ্যালারি যে বদলাচ্ছে সেটা এই কথাতেই বোঝা যায়। দলের পারফরম্যান্স কখনও আমাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি, যেটা করেছিল সেটা বাকি গ্যালেরির জন্য। সমর্থকদের বার বার বোঝানো হলো, দল গোল করলে যেরকম উল্লাস করি, ঠিক সে রকম গোল খেলেও সবার পাশে থাকতে হবে। ওখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সাপোর্ট করে যেতে হবে। মাঠটা নরক করে তুলতে হবে বিপক্ষের জন্য। ঘরে বা ঘরের বাইরে বাকিরা যেন ভয় পায় টিম ইস্টবেঙ্গলকে। যেখানে খেলোয়াড়দের সাথে সমর্থকরাও থাকবে।

২০১৮ সালের কলকাতা লিগের টেকনো এরিয়ান ম্যাচে ডাবল ধামাকা। মেগা কোর্টেও মহামেডান ক্লাবের সামনে থেকে ইডেন ঘুরে আমাদের ক্লাব। চ্যান্ট, স্মোক, জায়ান্ট ফ্ল্যাগ, ড্রামবিট—ম্যাচের দেড় ঘন্টা আগে কেঁপে উঠল ময়দান চত্বর। ইডেনের সামনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল ট্রাফিক। ম্যাচের একদম শেষ লগ্নে পাইরো। গোলের পিছনে সমগ্র জায়গাটা জুড়ে কয়েক হাজার। ভারতীয় ফুটবল তো বটেই, এশিয়ান ফুটবলেও এ রকম পাইরো শো খুব কমই হয়েছে। শুভেচ্ছা এলো, প্রচার পেলো।  কোপা ৯০, ওয়ার্ল্ড আল্ট্রাস, টিফো.নেটের মতো বিশ্ব ফুটবলের বৃহত্তম ফোরাম গুলো থেকে।

এর পর এলো বহু প্রতিক্ষীত আই-লিগ। এত বছরের না পাওয়ার জ্বালা, সঙ্গে নতুন কিছু করে দেখাবার সংকল্প। প্রথম ম্যাচে কী হবে তা ঠিক করার পর  হাতে ছিল মাত্র ৫ দিন। চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানিয়ে ঝুঁকি নেওয়াই হলো। কিন্তু ভগবান বোধহয় আমাদের সাথে ছিলেন। মাত্র ৩ দিনে আস্ত টিফো তৈরী হয়ে গেল “Bring It Home”। পরপর দুটো অ্যাওয়ে ম্যাচ জিতে, চেন্নাইয়ের সাথে প্রথম ঘরের মাঠে ম্যাচ। প্রথমে সল্টলেকের রাস্তা জুড়ে কোর্টেও, তারপর গ্যালেরিতে টিফো। কিন্তু ম্যাচটা জেতা হলো না। কিন্তু তাতে কী! পরেরটার জন্য তৈরি হও। একের পর এক ম্যাচ যায়, জয়-হার সব মিলিয়ে আসে সেই দিন। ডার্বি। ডং যাওয়ার পর ডার্বি জেতা হয়নি। সেটা যেমন হতাশা, সে রকম আশা ছিল নতুন স্প্যানিশ বসের উপর। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ক্রেচ করে ‘ওদের’ ঠুকে একটা টিফো বানিয়ে নেওয়াই হলো। “বুঝলেন কত্তা!” সবাই জানতাম যদি ম্যাচের ফল অন্য রকম হয়, সেটা ব্যুমেরাং হতে এক সেকেন্ডও লাগবে না। টিফো নামতেই গোটা ৪০ হাজারের ইস্ট বেঙ্গল গ্যালারি চিৎকার করে উঠলো চা চিনি……..। যার প্রতিফলন ওদের খেলাতেও পড়ল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ম্যাচ পকেটে পুড়ে ফেললাম আমরা। এ রকম পরিহাস মার্কা টিফো কোনওদিন হয়নি। সাহসিকতার প্রশংসা কুড়োতে কুড়োতে আরেকটা ডার্বির পরিকল্পনা হয়ে গেল।

তৈরি হবে এশিয়ার অন্যতম বড়ো টিফো। আকার আয়তনে হবে ৭২০০ স্কোয়ার ফুট। যেখানে থাকবে একটা বাঙালির জীবন চিত্র। কী ভাবে আমাদের পূর্বপুরুষ কাঁটাতার টোপকে সংগ্রাম করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে এ পারের ভূখণ্ডে। এই ক্লাবটা আমাদের জীবনের হাসি কান্নার কারণ। ছিন্নমূল বাঙালির আইডেনটিটি। সাইজ শুনে অনেকে শুরুতে ঘাবড়ালেও, ২৫ জনের বেশি ছেলে মেয়ে মিলে প্রায় ১১ দিনের চেষ্টায় আমরা ওটাকে প্রাণ দিতে পেরেছিলাম লিগের দ্বিতীয় ডার্বিতে। অনেকের চোখে জল এনে দিতে পেরেছিলাম দিনের শেষে। ওটা ছিল সব থেকে বড় পাওয়া। “ইলেভেন ফ্রেউন্ডে” নামের জার্মানির একটা ফুটবল ম্যাগাজিন সুদূর জার্মানি থেকে এসেছিল এটা কভার করতে। আমাদের এত বছরের কর্মযজ্ঞের সব থেকে বড় সাফল্য। এখানেই শেষ নয়।

১০০ বছরে ঢুকছি আমরা। সমর্থকদের জন্য চমক থাকবেই। আর এই বছর ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাস আনছে “টিউন্স অফ কলোনি”। যার টিকিট শেষ হয়েছে চার ঘণ্টায়। ২০১৩ তে পথ চলা শুরু। ঠিক করে প্রতিষ্ঠা পেতে ২০১৫। সেখান থেকে ২০১৯- তথাকথিত ময়দানি গ্যালারি বদলেছে অনেকটাই। সে দিনের গ্যালারিতে নিজেদের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয়া কটুক্তি আজ বদলেছে চ্যান্ট করে নিজেদের খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত রাখা। কোনও গালাতাসারে, মিলওয়াল, সেল্টিক বা লাতিন আমেরিকার কোনও আল্ট্রাসের মতো নয়। একদিন আমাদের পরিচয় ভারতের বাইরে হবে ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাস হিসাবে। যেখানে আমাদের ক্লাব কোনও বিদেশি ক্লাবের বিরুদ্ধে খেললে, প্রতিপক্ষ বলতে পারবে ওদের সমর্থকদের জন্য জিততে পারলাম না। এই গ্যালারি একদিন বিপক্ষের কাছে নরকে পরিণত হবেই !!!

You might also like