নীরজ চেয়েছিলেন, এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে যেখানে ভারতীয় অ্যাথলিটরা ঘরের মাঠে বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবে, অলিম্পিক্সের মতো চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকবে।
নীরজ চোপড়া
শেষ আপডেট: 6 July 2025 06:54
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে হাজির প্রায় পনেরো হাজার দর্শক এআর রহমানের গানের তালে তাল দিয়ে চলেছেন। অথচ গোড়াতেই তালভঙ্গ! নিজের নামে টুর্নামেন্ট আয়োজন করা নীরজ চোপড়ার প্রথম ছোড়াই ফাউল থ্রো!
ঘাবড়ালেন না, চমকালেন না নীরজ। পোড়খাওয়া অ্যাথলিটের মতোই হাতে তুলে নিলেন জ্যাভলিন। তারপর মাপা রান আপে ছুড়ে দিলেন বর্শা। ল্যান্ড করল ৮২.৯৯ মিটার দূরে! আগের দু’জন, কেনিয়ার জুলিয়াস ইয়েগো (80.০৭ মিটার) ও ব্রাজিলের লুইজের (৮০.৩১ মিটার) চাইতে এগিয়ে থাকলেন।
পরে শচীন যাদব (৮২.৩৩ মিটার) এবং শ্রীলঙ্কার রমেশ পাথিরাগে (৮৪.৩৩ মিটার) সাধ্যমতো টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ হাসি হাসলেন নীরজই। টুর্নামেন্টের আয়োজক হয়েও অতিথিদের বিরস বদনে ফেরালেন। তৃতীয় সুযোগে ছোড়া জ্যাভলিন আছড়ে পড়ল ৮৬.১৮ মিটার দূরে। যা এদিন সোনা জেতানোর জন্য যথেষ্ট ছিল!
বস্তুত, নীরজ চোপড়ার এই জয় শুধু আরেকটি পদক লাভের গল্প নয় বরং এক নয়া অধ্যায়ের শুরু—যেখানে ভারত নিজের মাটিতে বিশ্বমানের অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে এবং তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশেরই একজন আইকনিক অ্যাথলিট! অলিম্পিক্সে বিশ্বজয়ী এক তরুণ আজ দেশের জন্য একাহাতে মঞ্চ তৈরি করে দিচ্ছেন, জ্যাভলিন টুর্নামেন্টের দিগন্ত বুনে দিচ্ছেন—তাঁর স্বপ্নের এনসি ক্লাসিক এখন আন্তর্জাতিক ক্রীড়াজগতে নিয়মিত চর্চার বস্তু।
প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল এক বছর আগে। নীরজ চেয়েছিলেন, এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে যেখানে ভারতীয় অ্যাথলিটরা ঘরের মাঠে বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবে, অলিম্পিক্সের মতো চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকবে। সেই ভাবনারই ফলিত রূপ এবারের এনসি ক্লাসিক। টুর্নামেন্টটি আয়োজন করতে প্রায় ছয় মাস ধরে বিশ্বমানের প্রযুক্তি, মাঠের সরঞ্জাম, ট্র্যাক এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন নীরজ। এমনকি ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্সের বিশেষ পরিদর্শকেরা এসে ঘুরে যান, রিপোর্ট বানান। তারপর মেলে সবুজ সংকেত!
এবারের টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া বিদেশি অ্যাথলেটদের মধ্যে ছিলেন জার্মানির ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন আন্দ্রেয়াস হফম্যান, ফিনল্যান্ডের লাসে তুয়োমিনেন, দক্ষিণ আফ্রিকার রেনহার্ড ভ্যান রেনসবুর্গ। ভারতীয় দলে শিবপাল সিং, দবিন্দর সিং কাং, সুনীল কুমারদের মতো অভিজ্ঞ ও উদীয়মান প্রতিভা। প্রতিযোগিতায় হাজির ছিলেন ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তারা, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের একাধিক প্রতিনিধি।
নীরজের কোচ, তিনবারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন জান জেলেজনি, আয়োজনের আদি থেকে অন্ত শিষ্যের পাশে ছিলেন। কোচিং ছাড়াও তিনি বিদেশি অ্যাথলেটদের সঙ্গে টেকনিক্যাল মিটিং করেন এবং মাঠের কন্ডিশন, বাতাসের ধরন ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন। জেলেজনি প্রতিযোগিতা শেষে বলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে যে রকম আয়োজন হয়েছে, তা ইউরোপের যে-কোনো বড় প্রতিযোগিতার মতো!’
গতকাল গ্যালারির দর্শকদের অনেকেই প্রথমবার কোনও অ্যাথলেটিক্স ইভেন্টের সাক্ষী ছিলেন। নীরজ নিজেও বারবার বলেন, ‘এই টুর্নামেন্ট শুধু আমাদের নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দেখে অনুপ্রাণিত হয়, বুঝতে পারে খেলাধুলার মানে কী, কীভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছনো যায়!’
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে ভারত ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্সের মূল বার্ষিক ক্যালেন্ডারে জায়গা করে নিয়েছে। আগামী বছর থেকে এই আয়োজন বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স কন্টিনেন্টাল ট্যুরের অংশ হতে পারে—এমন পরিকল্পনাও বাতাসে ভাসছে। জেএসডব্লু স্পোর্টস ও অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সহযোগিতায় আয়োজিত এই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন ১২ জন প্রতিযোগী—তাঁদের মধ্যে ৭ জন বিদেশি ও ৫ জন ভারতীয়। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স ইতিমধ্যেই এই প্রতিযোগিতাকে ‘ক্যাটেগরি এ’ মর্যাদা দিয়েছে।
নীরজ এখন শুধু জ্যাভলিন নয়, ভাবছেন অ্যাথলেটিক্সের ভবিষ্যৎ নিয়েও। তাঁর ভাষায়, ‘আমার চাওয়া, এনসি ক্লাসিক যেন একটা ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে। যেন ভারতে ছেলেমেয়েরা অ্যাথলেটিক্স নিয়ে সিরিয়াস হয়। আমাদের দেশে প্রতিভার অভাব নেই, দরকার শুধু সুযোগ আর পরিকাঠামোর।’
ম্যাচের পর নীরজ বলেন, ‘এটা মানসিকভাবে কঠিন ছিল। জিততে চেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু এমন উত্তাল হাওয়া আশা করিনি। প্রথম থ্রো-র পর একটু চাপ এসেছিল। কোচ বললেন, শান্ত হও, সোজা ছোড়ো। আমি সেটাই করলাম। দর্শকদের এমন সমর্থন পেয়ে মনে হচ্ছিল যেন অলিম্পিক ফাইনাল খেলছি।’
চলতি বছর দারুণ ছন্দে রয়েছেন নীরজ। এই নিয়ে পরপর তিনটি বড় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সোনা জিতলেন—২০ জুন প্যারিস ডায়মন্ড লিগ, ২৪ জুন চেক রিপাবলিকের ওসত্রাভায় গোল্ডেন স্পাইক, আর ৬ জুলাই নিজের মাটিতে এনসি ক্লাসিক।