মনু ভাকের এবং যশপাল রানা।
শেষ আপডেট: 30th July 2024 09:32
দ্য ওয়াল ব্যুরো: শিষ্যের সেই কবে থেকেই বদনাম, সে নাকি ভারী জেদি। একগুঁয়ে। যা চায়, তা পেতেই হবে তাকে। না পেলে কুরুক্ষেত্র। এমন শিষ্যের গুরু হতে গেলে যে ডবল জেদি হতে হবে, তা বোধহয় বুঝে গেছিলেন কোচ। এ-ও বুঝে গেছিলেন, শিষ্য কোনও ভুল করলে বকাবকি করে কাজ হবে না। তাকে পথে আনতে হবে অন্য অস্ত্রে। যেমন বুনো ওল, তেমনই না হতে হবে বাঘা তেঁতুলকে! এই করতে গিয়ে বিচ্ছেদই হয়ে যায় গুরু-শিষ্যর। ছিল না কোনও সম্পর্ক। শেষে মিলিয়ে দিল অলিম্পিক্স।
প্যারিস অলিম্পিক্সে সদ্য ব্রোঞ্জ জিতেছেন মনু ভাকের। তার পরেই সামনে এসেছে তাঁকে নিয়ে বহু তথ্য। তাঁর জেদ, রাগ, কষ্ট, য্ন্ত্রণা-- এসবই মোটামুটি জেনে গেছেন দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা। কিন্তু তার সঙ্গেই উঠে এসেছে আরও একটি নাম, মনুর কোচ যশপাল রানা। তাঁর জেদ ও রাগেরও বড় ভূমিকা আছে, মনুর জীবনে।
২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিক্সের মাসকয়েক আগেই দু'জনের সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল রাগারাগির জেরে। কিন্তু প্যারিস অলিম্পিক্সের বছরখানেক আগে ফের গুরুর কাছে ফিরে আসেন মনু। এটাই বোধহয় ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত। কারণ রানা-মনুর জুটিই শেষমেশ প্যারিসে প্রথম পদক এনে দিল ভারতকে।
টোকিও অলিম্পিক্সের সময়ে মনু ভাকের সদ্য পার করেছেন কিশোরীবেলা। বয়স পেরোয়নি কুড়ির কোঠা। তাই কোচ যশপাল চেয়েছিলেন, অলিম্পিক্সের ১০ মিটারের ইভেন্টেই নামুক মনু ভাকের। অন্য ইভেন্ট অর্থাৎ ২৫ মিটারের ইভেন্টে মনুর বদলে খেলুক তাঁরই আর এক ছাত্রী, চিঙ্কি যাদব। যদিও ১০ ও ২৫ দু'টি ইভেন্টেই নামার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন মনু, তবু কোচ হিসেবে যশপালের মনে হয়েছিল, ছোট্ট মনুর উপর বেশি চাপ পড়ে যাবে দু'টি ইভেন্টে নামলে।
ব্যস, মনুর রাগ দেখে কে! তিনি যেই শুনেছিলেন তাঁর সঙ্গে চিঙ্কিও যেতে চলেছে অলিম্পিক্সে, কোচের উপর ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন তিনি। সেই ক্ষোভের মুখে রেগে গেছিলেন যশপালও। তিনিও আর অত ব্যাখ্যা করেননি, যে কেন একটিই ইভেন্টে নামতে দিতে চান তিনি মনুকে। তবে কোচ হিসেবে যশপাল আজও মনে করেন, তিনি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। কারণ অত কম বয়সে একসঙ্গে দু'টি বড় ইভেন্টে নামলে, যে কোনও একটিতে প্রস্তুতির খামতি থেকে যেত।
যশপাল যে সেদিন ঠিক ছিলেন, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল আগেই। কারই টোকিও অলিম্পিক্সের কয়েক মাস আগেই নয়াদিল্লিতে ২৫ মিটার শ্যুটিংয়ের একটি ইভেন্টে মনুকে হারিয়ে দিয়েছিলেন সেই চিঙ্কি। এতে হয়তো মনুর বোঝা উচিত ছিল, কোচ কেন তাঁকে বারণ করেছেন ২৫ মিটারে নামতে। কিন্তু ১৯ বছরের মনুর তখন সে বোধ হয়নি। উল্টে প্রচণ্ড রেগে তিনি কোচকে মেসেজ করেছিলেন, ‘শান্তি হয়েছে?’ কোচও কি কম যান! সেই মেসেজের লেখাটাই টি-শার্টে প্রিন্ট করিয়েছিলেন যশরাজ, সেটা পরেই রেঞ্জে এসেছিলেন মনুর সামনেও। ব্যস, এর পরে কথাবার্তা, মুখ দেখাদেখিই বন্ধ হয়ে যায় দু'জনের।
যশপাল জানান, তাঁর এবং মনুর চরিত্র অনেকটা একইরকম। দু'জনেই অত্যন্ত জেদি, একগুঁয়ে। যা করবেন, তাই ঠিক মনে করেন। তবে ১৯ বছরের মনুর জেদ আর তিরিশের কোঠার শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো যশপালের জেদের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিশাল ফারাক রয়েছে।
সেই ১৯৮৮ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে আমদাবাদে অনুষ্ঠিত ৩১তম জাতীয় শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো জিতে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলেন যশপাল। ১৯৯৪ সালে মিলানে বিশ্বরেকর্ড স্কোর করে ৪৬তম বিশ্ব শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে (জুনিয়র বিভাগ) আন্তর্জাতিক গৌরব অর্জন করেছিলেন। দোহায় ২০০৬ এশিয়ান গেমসে, ২৫ মিটার সেন্টার ফায়ার পিস্তলের ৫৯৯ পয়েন্ট নিয়ে ফের বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন যশপাল। ১৯৯৮-এর কমনওয়েলথ গেমসে মেনস সেন্টার ফায়ার পিস্তল, মেনস সেন্টার ফায়ার পিস্তল পেয়ারস, ২০০২ কমনওয়েলথ গেমসে পুরুষদের ২৫ মিটার সেন্টার ফায়ার পিস্তল এবং ২০০৬-এর কমনওয়েলথ গেমসের পুরুষ ২৫ মিটার সেন্টার ফায়ার পিস্তল জয় করার অভিজ্ঞতা রয়েছে যশপালের।
তাই সেই যশপালের কথা না শোনায়, মনুর যা হওয়ার তাই হয়েছিল। জেদ করে, কোচের কথা অগ্রাহ্য করে, টোকিও অলিম্পিক্সের ১০ মিটার এবং ২৫ মিটার-- দু'টি ইভেন্টেই নেমেছিলেন মনু। কিন্তু কোনও বিভাগেই ফাইনালে পৌঁছাতে পারেননি। শেষমেশ ডুবে গিয়েছিলেন হতাশায়। একটা সময়ে খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। অবসাদ গ্রাস করেছিল তাঁকে। ভারত হারাতে বসেছিল এক বিরাট সম্ভাবনাকে।
এই অবস্থায় ভাগ্যিস একটা দিনের জন্য নিজের ইগো সরিয়ে রেখে যশপালকে ফোন করেছিলেন মনু! গত বছরে মনুর সেই ফোন পেয়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যশপাল। কিন্তু যতই অবাক হোন, নিজের কর্তব্য ভোলেননি। ভোলেননি, তিনি গুরু। মনু তাঁরই শিষ্য। তাই দু'বার না ভেবেই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন মনুকে, 'বলো, কী করতে পারি তোমার জন্য।' মনুও উত্তর দিতে দেরি করেননি, চেয়েছিলেন ফের শুরু করতে। কোচ যশপালের কাছেই।
মনুর প্রস্তাব গ্রহণ করতে দু'বার ভাবেননি কোচ। তাই খেলা ছেড়ে দেওয়ার একেবারে মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শিষ্য মনুকে আবার নতুন করে ডেকে নিয়েছিলেন রেঞ্জে। যত্নে-শাসনে গড়েপিটে নিয়েছিলেন নতুন করে। শেষ একটা বছর কার্যত দমবন্ধ করে প্র্যাকটিস করে গেছেন মনু। পাখির চোখ প্যারিস অলিম্পিক্স। তাঁর পাশেই দমবন্ধ করে প্রতীক্ষা করে ছিলেন কোচ যশপাল।
অবশেষে প্যারিসে যখন জিতলেন মনু, ব্রোঞ্জের মেডেলটি জ্বলজ্বল করে উঠল শিষ্যের বুকে, তখন উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলেন যশপাল। যেন দুই বিচ্ছিন্ন দাগ জুড়ে একটা বৃত্ত আঁকা শেষ হল।