মায়া রাজেশ্বরন
শেষ আপডেট: 6th March 2025 18:31
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মাত্র দু’সপ্তাহ আগের কথা। নিজের এক্স-হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করেন রাফায়েল নাদাল। ক্যাপশনে লেখা ছিল: ‘শিখছি, আনন্দ করছি এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছি একদল প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সঙ্গে।‘
ক্যাপশন সাদামাটা। সঙ্গের ছবিটিও তেমন নজরকাড়া কিছু নয়। ডাইনে-বাঁয়ে কয়েকজন তরুণ টেনিস খেলোয়াড়ের মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নাদাল। অথচ একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, ছবিতে একদম বামদিকে, নাদালের ডাইনে চার নম্বরে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে। কৃষ্ণাঙ্গী। চোখেমুখে নম্রতার ছাপ স্পষ্ট। ডান হাতের তর্জনী বাম হাতে ধরা। শরীরী ভাষায় কিঞ্চিৎ ভীরুতা স্পষ্ট।
বাকিদের ভিড়ে গায়ের রং আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে নিজেকে স্বতন্ত্র করে নিতে পেরেছিলেন মায়া রাজেশ্বরন রেবতী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন, আপাদমস্তক ভারতীয়। কোয়েম্বাতুরে জন্ম। তামিল পরিবারে বেড়ে ওঠা। দক্ষিণ ভারত থেকে রাফায়েল নাদালের অ্যাকাডেমিতে পা রাখাটা শুধু যাত্রা নয়—আদ্যোপান্ত অ্যাডেভেঞ্চার যেন! মুম্বই ওপেনে খবরের শিরোনামে আসা। নিজের চাইতে র্যাঙ্কিংয়ে, বয়সে, ধারে, ভারে এগিয়ে থাকা বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের হেলায় হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা। তারপর আচমকা সাগরপাড়ের ডাক! একে রূপকথা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে?
সত্যিই যেন রূপকথা! শূন্য থেকে আকাশ ছোঁয়া, সমস্ত প্রতিবন্ধকতা জয় করে টেনিস দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের সান্নিধ্যে আসা। অথচ এর শুরুটা হয়েছিল একমেটে কায়দায়। বছর আটেকের এক মেয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা, স্কুলে যাওয়ার ছকবাঁধা রুটিনে ব্যস্ত। ‘বেকিং’ অবসরযাপনের নেশা। পড়ার বাইরের বই পড়তে বেশি উদ্গ্রীব। এই বৃত্তে ‘খেলা’ শব্দটারই কোনও অস্তিত্ব ছিল না।
অথচ দু’বছর বাদে এই পরিচিত পৃথিবীটাই যেন আমূল বদলে যায়। মায়া সিদ্ধান্ত নেয়, টেনিস খেলবে সে। ততদিনে টিভির পর্দায় আরিনা সাবালেঙ্কার উত্থান নজর টেনেছে। লক্ষ্য বদলে যায় নিমেষে। পড়াশোনা কিছুটা ব্যাকফুটে সরে গিয়ে জায়গা ছেড়ে দেয় ক্লে-কোর্ট, হার্ড কোর্ট, ব্যাকহ্যান্ড আর ফোরহ্যান্ডকে।
শুরু হয় অনুশীলন। কঠোর অধ্যবসায়। স্থানীয় স্তরে। আর এরই ফল ফলে নিমেষে। মুম্বই ওপেনে কোর্টে নামার ডাক পান মায়া। কিন্তু তার আড়ালেও লুকিয়ে ছিল রহস্য। কী সেই রোমাঞ্চ?—শোনা যাক ভারতের উঠতি টেনিস তারকার জবানিতে, ‘প্রথমত, আমার মুম্বই ওপেনে নামার কোনও কথাই ছিল না। টুর্নামেন্ট শুরুর দু’দিন আগে ওয়াইল্ড কার্ড নিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, সুযোগ পেলে ভাল খেলব এমনটাও বিশ্বাস থাকলেও এতদূর (সেমি ফাইনাল) এগোব,সেটা কল্পনাতেও আসেনি। তবে আমি প্রতিটি ম্যাচ ধরে ধরে প্ল্যান কষেছি আর নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।‘
মুম্বই ওপেন ইভেন্টের সেমিফাইনালে ২০০৯ সালে জন্মানো খেলোয়াড়দের মধ্যে একমাত্র মায়াই জায়গা করে নেন। প্রতিটি রাউন্ড জয়ের রাস্তায় পরাজিত করেন একের পর বাছাই প্রতিদ্বন্দ্বীকে। শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হন র্যাঙ্কিংয়ে ২৭ নম্বরে থাকা জিল টিচম্যানের হাতে।
মায়া টুর্নামেন্ট জিতবেন—এই আশায় বুক বেঁধেছিলেন দর্শকাসনে বসে থাকা ভারতীয় সমর্থকেরা। তাঁদের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হলেও ভেঙে পড়তে নারাজ তিনি। বছর পনেরোর তামিল-কন্যা অপকটে জানালেন, ‘একটু দুঃখ পেলেও ভেঙে পড়িনি। কারণ মুম্বই ওপেন থেকে অনেক ইতিবাচক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি আমি।‘
এই উত্থানের পেছনে অভিভাবকদের ভূমিকা স্বীকার করেছেন মায়া। অকপটে জানান, ‘আমি খুশি এটা ভেবে যে, মা আমার সঙ্গে যাতায়াত করেন। বাড়িই আমার পরিবার, আমার সাপোর্ট সিস্টেম।‘
ইউরোপের ডাক এসেছে। তাই রাফায়েল নাদালের টেনিস অ্যাকাডেমিই তাঁর এখনকার ঠিকানা। আপাতত গুরুকুলবাসিনী মায়া। নাদালের কঠোর নজরে চলছে রোজকার অনুশীলন। লক্ষ্য অনূর্ধ-বৃত্তে নয়, সিনিয়র লেভেলের টেনিস বিশ্বে শৃঙ্গারোহণ। প্রস্তুতির ফাঁকে বইয়ের পাতায় অবসর খুঁজে নেন মায়া, এখনও। মন জিতেছে চিত্রা ব্যানার্জির উপন্যাস ‘দ্য প্যালেস ইলিউশনস’। দ্রৌপদীর চোখ দিয়ে মহাভারতকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গীতে পেশ করেছেন লেখিকা। মায়াও অন্যতর চোখে খুঁজে চলেছেন তাঁর ভবিষ্যৎ।
আট বছরের যে মেয়ে টেনিস নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহী ছিল না, তার কাছে লক্ষ্যই সব। লক্ষ্যহীন জীবন মানে নোঙর ছাড়া নৌকো, স্টেয়ারিং ছাড়া গাড়ি… আর রাফায়েল নাদাল ছাড়া গ্র্যান্ড স্ল্যাম! জীবনের প্রবাদকেও টেনিসে মিশিয়ে নিয়েছেন মায়া।