অক্ষর প্যাটেল
শেষ আপডেট: 6th March 2025 16:02
দ্য ওয়াল ব্যুরো: খাতায়-কলমে ম্যাচের খুব বেশি তাৎপর্য ছিল না। স্রেফ কে গ্রুপের এক নম্বর আর দু’নম্বর দল হয়ে পরের রাউন্ডে যাবে—তা ঠিক করার লড়াই। তবু মর্যাদার দ্বৈরথ জেতার জন্য দু’তরফের কোনও দলই এতটুকু কসুর করেনি।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৪৯ রান তুলেছিল ভারত (India)। নিউজিল্যান্ডকে (New Zealand) জিততে হলে করতে হত ২৫০। ক্রিজে অধিনায়ক কেন উইলিয়ামস। ঐতিহাসিকভাবে টিম ইন্ডিয়ার ‘পথের কাঁটা’। একা হাতে যখন ম্যাচের রং বদলে ফেলার বন্দোবস্ত করছেন কিউয়ি অধিনায়কক সেই সময় বল করতে আসেন অক্ষর প্যাটেল (Axar Patel)।
ন’ওভার হাত ঘুরিয়ে খুব বেশি রান দেননি ভারতীয় স্পিনার। তবে উইকেটও তোলেননি। মিডল ওভারে পার্টনারশিপ ভাঙতে তাঁর হাতেই বল তুলে দেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। আর স্পেলের শেষ ওভারের শেষতম বলে হাওয়ায় ভাসানো ফ্লাইটেড ডেলিভারির ফাঁদে বন্দি করেন উইলিয়ামসনকে। স্ট্যাম্প আউট। ম্যাচে ফিরে আসে ভারত। একটি উইকেট বদলে দেয় লড়াইয়ের অভিমুখ। অথচ জয়ের শেষে সমস্ত স্পটলাইট সরে যায় অভিষেকেই ৫ উইকেট নেওয়া বরুণ চক্রবর্তীর দিকে। একবার, আরও একবার, উপেক্ষিত নায়ক হিসেবেই অন্তরালে আত্মগোপন করেন অক্ষর।
অথচ ইতিহাস, পরিসংখ্যান বলছে, এ নতুন কিছু নয়, হওয়ারই ছিল। অক্ষর প্যাটেলের ললাটলিপিতে ‘উপেক্ষা’ শব্দটা বরাবর জুড়ে রয়েছে। ‘স্পিনার’ পরিচয়ের খোলস ভেঙে ধীরে ধীরে যখন ‘স্পিনার-অলরাউন্ডার’ হিসেবে অভ্যুদয় ঘটেছে, তখন ক্রিকেটমহলে তাঁর গায়ে এঁটে দেওয়া হয় ‘গরিবের রবীন্দ্র জাদেজা’র তকমা। এই আখ্যা জাদেজার কাছে কতটা গৌরবের সেটা অজানা হলেও অক্ষরের কাছে যে চরম অপমানকর, তা বলাই বাহুল্য।
যদিও এমন নিন্দাবাদকেকে উপেক্ষা নয়, ভূষণ করে তুলেছিলেন তিনি। অপেক্ষা করেছেন। সুযোগ খুঁজেছেন। আর প্রস্তুতিতে নিংড়ে দিয়েছেন নিজেকে। ফসল তুলেছেন ময়দানে।
যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন অক্ষর তা হাতে আসে তিন বছর আগে। ২০২২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। সেখানে একটি ওয়ান ডে-তে ৬৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি। বার্বাডোজের ওই লড়াই জিতেছিল টিম ইন্ডিয়া। আর আচমকাই ‘বোলার’ অক্ষরের ‘ব্যাটিং’ দক্ষতা ক্রিকেট দুনিয়ার নজরে আসে। সেই সুযোগকে মাথায় রেখেছেন অক্ষর। বিস্মৃত হননি। এতদিন বাদে খোলসা করেছেন নিজের উত্থানের রহস্য। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন—‘ওই ম্যাচের পরেই সবাই বুঝতে পারে, আমি ম্যাচ ফিনিশও করতে জানি।‘
যদিও ‘ফিনিশার’ নয়, ‘অ্যাঙ্কর’ হিসেবেই তাঁকে দলে নতুন ভূমিকা দিতে চেয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। তাই টেলএন্ডারের রিক্ত বসন ছেড়ে বাহিনীর পঞ্চম সৈনিকের রংদার পোশাক গায়ে ব্যাটিং লাইন আপে এগিয়ে আসেন অক্ষর। এক অর্থে ‘কেড়েই’ নেন জাত ব্যাটসম্যান লোকেশ রাহুলের রোল। যার ব্যাটিং গড় ৫০-এরও বেশি। ঝুলিতে পাঁচটি সেঞ্চুরি।
২০২২ সাল থেকে যা ক্বচিৎ-কখনও নজরে আসত, গত বছর থেকে তা নিয়মে পরিণত হয়। পাঁচ নম্বরে জায়গা পোক্ত করে ফেলেন তিনি। শ্রীলঙ্কা সফরে কলম্বো ম্যাচ অক্ষরের গায়ে ‘স্পিনার-অলরাউন্ডারে’র সরকারি সিলমোহর মেরে দেয়। ওই ম্যাচে ৪৪ রান এবং তার পরের ছ’টি একদিনের ম্যাচে যথাক্রমে ৫২, ৪১ (নট আউট০, ৮, ৩ (নট আউট), ৪২, ২৭ রান করেন তিনি।
যদিও বিশ্লেষকদের মতে, অক্ষরের কদর বুঝতে শুধুমাত্র রেকর্ড যথেষ্ট নয়। মিডল অর্ডারে দীর্ঘদিন ধরে বাঁ-হাতি ব্যাটারের অভাবে ভুগত টিম ইন্ডিয়া। এমন ব্যাটার, যিনি স্পিনারদের বিরুদ্ধে স্বচ্ছন্দ, লম্বা পার্টনারশিপ গড়তে জানেন। অক্ষর এখানেই এগিয়ে গেছেন বাকিদের থেকে। আর তাই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহুলকে ছ’য়ে নামিয়ে তুরুপের তাসটি খেলে ফেলেছেন গৌতম গম্ভীর। তার জন্য ঋষভ পন্থকে দলের বাইরে যেতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এটা যদি বৈষম্য বা অন্যায্য সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে অক্ষর তার আঁচ দলের পারফরম্যান্সে পড়তে দেননি। নিউজিল্যান্ড ম্যাচে মিচেল স্যান্টনার ও মাইকেল ব্রেসওয়েলের বিরুদ্ধে তাঁর ৪২ রানের ইনিংসই এর উৎকৃষ্ট প্রামাণ। এই ইনিংস চোখধাঁধানো নয়, কিন্তু কার্যকরী।
লড়াই আপাতত শেষের মুখে। ফাইনাল ম্যাচ বাকি। সেখানে মিডল অর্ডারে রান করে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পার্টনারশিপ ভেঙে কি ফের একবার খবরের অন্তরালেই রয়ে যাবেন অক্ষর? নাকি অর্জন করবেন প্রাপ্য কদর? যে সম্মান এতদিন হাতে এসেও বারবার হাতছাড়া হয়েছে? ভারতের ফাইনাল জয়ের কাণ্ডারী হয়ে উঠলে তাঁকে ‘গরিবের রবীন্দ্র জাদেজা’ বলা হবে না এটুকু নিশ্চিত। কিন্তু তার জন্য এখনই জাদেজার লিগে ফেলে দেওয়াটাও বোকামো হবে। তবে কেরিয়ারের পড়ন্তবেলায় এসে পৌঁছনো ‘জাড্ডু’র উত্তরসূরী যে অক্ষর এবং একমাত্র অক্ষর-ই, এই নিয়ে এতটুকু দ্বিমতের অবকাশ নেই।