সৈয়দ মুস্তাক আলি থেকে সুনীল গাভাসকর হয়ে আজকের সৌরভ... ইডেনের তুলনা ইডেনই!
শেষ আপডেট: 29 April 2024 17:10
আক্ষরিক অর্থেই উলটপুরাণ বলা যেতে পারে! ধরা যাক, খেলা হচ্ছে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা। অথচ বেঞ্চে বসে ব্রাজিলের কোচ কার্লোস তেভেজ, ওদিকে আর্জেন্তিনার কোচ রোনাল্ডিনহো! বা ধরা যাক, আরও বাস্তবসম্মত ব্যাপার! পর্তুগাল-ইতালির খেলা হচ্ছে, একদিকে পর্তুগালের ম্যানেজার কার্লো আনচেলোত্তি, ওদিকে ইতালির বেঞ্চে বসে 'দ্য স্পেশ্যাল ওয়ান', হোসে মোরিনহো! প্রায় এরকমই পরিস্থিতি কি হতে চলেছে আজ ইডেনে? লক্ষণ কিন্তু সেরকমই। দুইদলেই খাতায় কলমে দুইজন কোচ রয়েছেন। দিল্লি ক্যাপিটালসের রিকি পন্টিং। কলকাতা নাইট রাইডার্সের চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত। কিন্তু লড়াইটা আসলে জমতে চলেছে দুই দলের দুই ধুরন্ধর ক্রিকেট মস্তিষ্ক, দিল্লির সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বনাম কলকাতার গৌতম গম্ভীরের।
দেশের ক্রিকেট তারকাদের মধ্যে যাদের বেড়ে ওঠা বড় শহরে, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি কলকাতার আনুগত্যটাই একরকম প্রশ্নাতীত। মুম্বইতে শচীন তেণ্ডুলকর আছেন। দিল্লিতে বীরেন্দ্র শেওয়াগ, বিরাট কোহলি। বেঙ্গালুরুর রাহুল দ্রাবিড়। আইপিএলের দৌলতে এখন রাঁচির মহেন্দ্র সিংহ ধোনি হয়ে গিয়েছেন চেন্নাইয়ের। কিন্তু কলকাতা সৌরভকে নিয়ে যতটা আবেগপ্রবণ, ওই দৌড়ে বোধ হয় বাকিরা খানিক পিছিয়েই থাকবেন। অনেকে তো এও বলেন, শচীন মুম্বইয়ের হতে পারেন। কিন্তু সম্ভবত মুম্বইয়ের চেয়ে বেশি ভালবাসায় তাঁকে ভরিয়ে দিয়েছে কলকাতা। যে কারণে অবসর মুম্বইতে নিলেও আগের ১৯৯-তম টেস্ট মাস্টার ব্লাস্টার খেলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। ধোনির জন্যও কলকাতা পাগল। শচীন-ধোনি দু'জনেই ভাঙা বাংলা বুঝতেও পারেন।
কিন্তু ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেনে সৌরভের মহিমাই আলাদা! ক্রিকেট-মহলে কান পাতলে শোনা যায়, সিডনি-লর্ডস-ওয়ান্ডারার্স-ওভাল যেখানেই খেলো না কেন, যদি সত্যিই ঐশ্বরিক অনুভূতি পেতে চাও, তোমাকে আসতেই হবে ইডেনে। এখানে জনতার সামনে যে কোনও খেলোয়াড়ের অগ্নিপরীক্ষা নেওয়া হয়। ওই পরীক্ষায় পাশ করবে তো? কাউকে রেয়াত করেনি ইডেন। ১৯৪৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সার্ভিসেস দলের বিরুদ্ধে সৈয়দ মুস্তাক আলিকে বাদ দেওয়া নিয়ে গোটা কলকাতা গর্জন করেছিল, 'নো মুস্তাক, নো টেস্ট!' জনতা এমনই উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে, একসময় মহারাজা দলীপ সিংজিকে অবধি ঘেরাও করা হয়। অবশ্য দলীপ সিংজি তো সেকালের কথা! তখন তিনি নির্বাচক। খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা সুনীল গাভাসকরকেও 'গো ব্যাক গাভাসকর' শুনিয়ে দিয়েছিল ইডেন। ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এমনই ধসে পড়ে ভারত যে, উন্মত্ত জনতাকে সামলাতে না পেরে ম্যাচ অসমাপ্ত রেখে শ্রীলঙ্কাকে জিতিয়ে দেন সেদিনের ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামক কলকাতার রাজপুত্রের প্রতি সেই ইডেন যা আনুগত্য দেখিয়েছে, সম্ভবত পৃথিবীর কোনও প্রান্তে কেউ এতটা আশা করবেন না। ২০০৫ সালের নভেম্বর। ভারতের বিরুদ্ধে চতুর্থ একদিনের ম্যাচে সেদিন ইডেনে নেমেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ভারতীয় ক্রিকেটে তখন গুরু গ্রেগ-রাজ চলছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে পরে চোটের অজুহাত দিয়ে ওডিআই টিম থেকেই বসিয়ে দেন গ্রেগ চ্যাপেল। ইডেনে ভারত নামে রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে। ঘটনাচক্রে, ওইদিনই পুণেতে মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির খেলা চলছিল বাংলার। মহারাষ্ট্রের ৩৫০ রান তাড়া করতে নেমে অরিন্দম দাশ, দেবাঙ্গ গান্ধী, সন্দীপ সান্যালদের ঠুকঠুক রানের পরে কার্যত একাই যুদ্ধের রথ হাতে নেন সৌরভ। ভারতের ইডেনে নামার দিনই ১৫৯ রানের বিরাট ইনিংস গড়ে বাংলাকে ৩৭৮ রানে পৌঁছে দেন সৌরভ।
রাহুল দ্রাবিড়দের ভাগ্য ওইখানেই নির্ধারিত হয়ে যায়। টিম হোটেল থেকে বেরিয়েই আঁচ করেন, কী হতে চলেছে। রীতিমত টিমবাস ঘিরে ধরে চেঁচামেচি চলে। তারপরের ঘটনা ইডেনেই সম্ভব। নব্বই হাজার দর্শকের সামনে রীতিমতো বধ্যভূমিতে নামেন দ্রাবিড়, শেওয়াগ, গম্ভীররা। মিডল অর্ডারে যুবরাজ সিংহ-মহম্মদ কাইফের সামান্য কিছু লড়াই বাদ দিলে ৪৫ ওভার ৫ বলে ১৮৮ রানেই অলআউট হয়ে যায় ভারত। তারপর শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার তাণ্ডব। ওপেন করতে নেমে অধিনায়ক গ্রেম স্মিথ আর অ্যান্ড্রু হল দু'জনে মাত্র ৩৫ ওভার ৫ বলে এক উইকেট না হারিয়ে জয়ের রান তুলে নেয়। এক একটা চার মারছেন স্মিথ, ইডেন কার্যত উল্লাসে ফেটে পড়ছে! নব্বই হাজার দর্শকের নিজেদের ঘরের ছেলেকে বাদ দেওয়ার রাগ সেদিন ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝিয়ে দিয়েছিল ইডেন। দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়রাও সেদিন বুঝতে পারেননি, কী হয়ে গেল। জয়ের পর ইডেন যা হাততালি দিয়েছিল, অতটা বোধ হয় জোহানেসবার্গ বা কেপ টাউনেও কখনও দেখেননি তাঁরা। গ্রেগ চ্যাপেল বুঝে গিয়েছিলেন, তিনি ভারতের কোচ, দলের 'বস' হতে পারেন। কিন্তু এটাও কলকাতা!
অথচ আইপিএল গ্রহেও সৌরভের ভাগ্য তেমন সঙ্গ দেয়নি। কলকাতার মার্কি প্লেয়ার হিসেবে অধিনায়ক সৌরভের নেতৃত্বে শুরু করেছিল কেকেআর। প্রথম ম্যাচেই চিন্নাস্বামীতে আরসিবির বিরুদ্ধে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সেই ঝোড়ো ১৫৮ আজও অনেকে গুগল না করে বলে দেবেন! কিন্তু লাভ হয়নি আর। তারপরের কেকেআরকে কেউ মনে রেখেছে? আট দলের মধ্যে ছয়ে শেষ করে কলকাতা। পরের মরসুমে সৌরভের কলকাতার জায়গা হয় একেবারে লিগ টেবলের তলায়। ১৪ ম্যাচের তিনটে জয়, দশটা হার। ২০১০ সালেও সেই আট দলের মধ্যে ছয় নম্বর। আর সৌরভকে রাখেননি সিইও বেঙ্কি মাইসোররা। আবার শুরু হয় বিতর্ক! কেকেআর ম্যানেজমেন্ট যদিও খুব হিসেব করে পা ফেলেছিল। অধিনায়ক হিসেবে সই করানো হয় গৌতম গম্ভীরকে। সেবার প্লে-অফে পৌঁছেছিল কলকাতা। ওদিকে সৌরভকে কিনে নেয় তৎকালীন সুব্রত রায়ের সহারা গ্রুপের মালিকানায় থাকা পুণে ওয়ারিয়র্স ইন্ডিয়া।
কলকাতায় পুণে ওয়ারিয়র্স খেলতে এলেও দেখা যায়, সেই একইভাবে দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে ইডেন। স্রেফ একজনের জন্য। কলকাতার ১৫০ তাড়া করতে নেমে ১৪৩ রানেই থেমে যায় পুণে। কিন্তু সেবার পুণের সর্বোচ্চ রান ছিল অধিনায়ক সৌরভের। নেমেছিলেন সাত নম্বরে। বিস্তর প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল সেইজন্য। কলকাতার অনেকেই আক্ষেপ করছিলেন, সৌরভ তাঁর সিগনেচার তিন বা চারে নামলে হয়ত ম্যাচটা জিতে যেত পুণে। ইদানিং সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মত শিল্পপতিরাও এইসব ছকে সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করেন। মোহনবাগানের বিনিয়োগকারী গোয়েঙ্কারা এখন আইপিএলে লখনউ সুপার-জায়ান্টাসের মালিক! এই সুবাদে কলকাতায় খেলতে এলে কেএল রাহুলদের সবুজ-মেরুন জার্সিতে মাঠে নামান সঞ্জীব গোয়েঙ্কার ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু গঙ্গাপারের মাঠে সৌরভের মত আবেগের ছিটেফোঁটাও কখনও তুলতে পারেনি গোমতীপারের দল।
গৌতম গম্ভীর খাঁটি দিল্লির ছেলে। রীতিমত পূর্ব দিল্লির সাংসদ অবধি ছিলেন। কিন্তু আইপিএলে দিল্লির হয়ে শুরু করলেও গম্ভীরের আইপিএল শিখরে ওঠা গঙ্গাপারের শহরে। দুইবার কলকাতাকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন তিনি। কলকাতাও ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছে তাঁকে। পরে তাঁকে সরিয়ে দীনেশ কার্তিক, এখন শ্রেয়স আইয়ারকে অধিনায়ক করেছেন বেঙ্কি মাইসোররা। কিন্তু গম্ভীরের গ্রহণযোগ্যতায় একফোঁটাও চিড় ধরেনি। শেষে আইপিএলের ট্রফি-খরা কাটাতে এবার সেই গম্ভীরেরই দ্বারস্থ হয়েছেন শাহরুখ। ওদিকে একবারও ট্রফি না জেতা দিল্লিরও নাম-ধাম বদলে ফেলেছেন স্পনসররা। ট্রফি জিততে পন্টিং-এর পাশাপাশি সৌরভের মস্তিষ্ককে কাজে লাগাতে চাইছে দিল্লি। ইডেনে কি তাহলে আজও সেই ধর্মসংকটের ছবি ফুটে উঠবে? একে তো কলকাতার দলে বাংলার কেউ নেই। বহুদিন ধরেই বাঙালি ক্রিকেটাররা আইপিএল-গ্রহে বেঙ্কি মাইসোরদের পাত্তা পান না। ঋদ্ধিমান সাহা একাধিক দলে ভাল খেললেও কখনও তাঁকে নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখায়নি কেকেআর। ওদিকে আবার দিল্লির হয়ে আজ নামতে পারেন বাংলার অভিষেক পোড়েল। দুই মেন্টরের পাশাপাশি ঘরের মাঠে দুই কলকাতার লড়াইতেও আজ নজর থাকছে শহরের।